মহান আল্লাহতায়ালার মনোনীত ইসলাম ও দয়াল নবীর সত্য তরিকতে সূফীবাদের দাওয়াত নিয়ে
খাজাবাবা কুতুববাগীর ভারত সফর
রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সত্য তরিকতের বাণী প্রচারের লক্ষ্যে এ জামানার মোজাদ্দেদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান কয়েকজন আশেক মুরিদ সঙ্গে নিয়ে ভারতের বেশ কয়েকটি জেলায় সফর করেন। সফর থেকে ফিরে ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা ২য় পর্ব আত্মার আলো’র এ সংখ্যায় লিখেছেন- মোঃ শাখাওয়াত হোসেন
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রোজ শুক্রবার রাতে মাহফিল ছিলো। কেবলাজান সেখানে উপস্থিত হতে পারেন নাই, সফরসঙ্গীরা সে মাহফিলে অংশ নিলাম। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে প্রতিটি মাহফিলই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হচ্ছে এবং এ সব মাহফিলে অসংখ্য মানুষের সমাগম দেখে বারবার অবাক হচ্ছিলাম! যদিও ধুপগুড়ি, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ির এসব অঞ্চলে মুসলমানের বসবাস আছে বেশ, তবুও বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে গিয়ে দয়াল নবীজির সত্য তরিকার বাণী ও সূফীবাদের দাওয়াত দেওয়া এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সকল মানুষের অংশগ্রহণ দেখে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরানা আদায় করছি। মাহফিলের মঞ্চে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ অনেক মসজিদের ইমামরাও ছিলেন এবং তাঁরাও সূফীবাদের দীক্ষার প্রয়োজনীতা সম্পর্কে মানুষের মাঝে তাঁদের বক্তব্যে তুলে ধরেন। এমন সময় কেবলাজান ফোনকলে বললেনÑ ‘শাখাওয়াত বাবা, মাহফিল শেষ করে তাড়াতাড়ি লজে এসো ১৮ তারিখ ধুপগুড়ি সদরে একটি মাহফিল হবে।’ কেবলাজানের জবানে এ কথা শুনে যেমন আনন্দিত হলাম তেমনই অবাক হলাম এই ভেবে যে, শুনেছি ওখানকার হিন্দুরা নাকি কট্টর! তাছাড়া একদিনের মধ্যে মাহফিলের আয়োজনই বা কেমন করে হবে? যা-হোক, মাহফিল শেষ করে এসে দেখি, শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত কেবলাজানের কাছে। তাঁরা বলেছেনÑ বাবাজান, আপনাকে আমাদের ওখানে নিতে পারলে আমাদের জীবন ধন্য হবে। আপনার সত্য বাণীর আলোয় আমরা আলোকিত হবার বাসনা রাখি, আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন। কেবলাজান তাঁদেরকে সম্মতি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে আপনারা মাহফিলের আনজাম করেন আর সঙ্গে আমার এই জাকেরদেরকেও রাখেন, তারাও আপনাদের সহযোগিতা করতে পারবে। এই বলে আমাদের কার কি দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন, কবি নাসির আহমেদ ভাইজানসহ স্থানীয় একজন শিক্ষক জনাব বদিয়ার সাহেব ও আমাকে হুকুম দিলেনÑ ‘আপনারা থানায় গিয়ে মাহফিলের অনুমতি নিয়ে আসেন।’ আমরা গভীর রাতে থানায় উপস্থিত হলাম। আল্লাহর কামেল অলীর কি কেরামতি! দেখি ওসি সাহেব থানাতেই আছেন, আমরা কেবলাজানের আগমন ও মাহফিলের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিলেন।
ধুপগুড়ি সদরের সুবিশাল কমিউনিটি সেন্টার কানায় কানায় ভরে গেল নানা ধর্মের মানুষের ভিড়ে। সেখানে অনুষ্ঠিত হলো ‘ধর্মসভা’, আস্তে আস্তে মানুষের ভিড় বাড়তে লাগলো আশপাশের রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েও শুনছে মাহফিল ও ধর্মসভার আলোচনা। আল্লাহর মনোনীত ইসলাম ও রাসুল (সঃ) এর সত্য তরিকার মর্মকথা এবং সূফীবাদের ছায়াতলেই যে শান্তির নীড়, সে কথা তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নাই। এমন নিবিড় লোকসমাগম দেখে আমরা সত্যিই আশ্চর্য্য হলাম! কেবলাজান আল্লাহর দরবারে সবার জন্য খাস দোয়া করলেন। মোনাজাত শেষে কেবলাজানকে দেখে মানুষজন বলাবলি করছিলেনÑ ‘এত ‘দেবতা’ আমাদের মাঝে মানুষরূপে এসেছেন! মাহফিলের আয়োজক কমিটির ভাইজানেরা বাবাজানের কাছে সবিনয় আবেদন জানালেন, প্রতি বছর ধুপগুড়িতে পবিত্র ওরছ ও বিশ^জাকের ইজতেমা করার। আশেপাশের অনেক জেলার মানুষ সবিনয়ে আবেদন করেছেন তাদের এলাকায় একটা মাহফিল করার। কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য বাবাজান সে সব স্থানে যেতে পারেন নাই। কেবলাজান বলেছেনÑ ‘ভাগ্যে থাকলে যাওয়া হবে।’ ধুপগুড়ির আলতা গ্রামে ‘কুতুববাগ খানকা শরীফ’ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে আল্লাহর দরবারে তাঁর বাণী মোবারক এবং রাসুলুল্লাহর (সঃ)এর সূফীবাদের প্রচার ও প্রসারের জন্য দোয়া করলেন।
১৯ সেপ্টেম্বর, সোমবার) মাহফিল হলো উত্তর দিনাজপুর জেলায়। পূর্বেই নির্ধারিত কেবলাজান সেখানে তাসরিফ নিবেন, কিন্তু আমরা জানি না যে, কে বা কারা আয়োজন করবেন? নিজের মধ্যে চিন্তা হচ্ছে কেমন করে হবে ওখানের মাহফিল! আমরা গিয়ে পৌঁছালাম অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের ভিড় জমে গেল, কেবলাজানকে একনজর দেখা এবং এখানে তাঁর আগমনের কথা শোনার পর, সঙ্গে সঙ্গে মাহফিলের আয়োজন করতে নেমে গেলেন মানুষজন। মহল্লায় মহল্লায় মাইকিং করে কেবলাজানের আগমন উপলক্ষে মাহফিল ও ধর্মসভার কথা ঘোষণা দিলেন। এরই মধ্যে স্থানীয় এক ডেকোরেটর মালিক জনাব বাপ্পী ভাইজান এসে বললেনÑ বাবাজান, ডেকোরেটরের যা কিছু লাগে আমি সব ব্যবস্থা করবো। আপনি আমাদের মাঝে এসেছেন এতেই আমরা ধন্য, আর এজন্য আমি সামান্য কিছু করতে পারলে নিজেকে অতি ভাগ্যবান মনে করবো। এরই এক ফাঁকে এলাকার একজন নামকরা মাওলানা ও স্বনামধন্য ‘নাতে রাসুল’ রচয়িতা ও ‘নাতে রাসুলের শিল্পী’ জনাব মাওলানা সাহেদ সাহেব, কেবলাজানের সঙ্গে সাক্ষাতে আসলেন এবং এসে প্রথমেই আমাদের সফরসঙ্গী শরিফুল আলম ভাইজান ও আমাকে সামনে পেয়ে নানা ধরণের প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং আমাদের সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। আমরা আমাদের সাধ্যমত বললাম, কিন্তু মনে হলো তিনি এতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। এরপর আমাদের হাতে কেবলাজানের ছবি মোবারক দেখে তিনি বিষ্মিত আর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ তাকিয়ে থেকে থেকে শুধু বললেনÑ ‘এত নূর! সোবাহানআল্লাহ! সাধারণ মানুষের এ নূর থাকার কথা নয়, তিনি নিশ্চয়ই আল্লাহর খাস-বান্দা-অলী। আমার হৃদয় তাঁর এ নূরকে চিনতে পেরেছে। তিনি হচ্ছেন লাইট আর আমি হলাম পোকা। পোকা যেমন লাইট দেখলে ছুটে আসে আমিও তেমনই তাঁর কাছে ছুটে যেতে চাই। আমাকে তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে নিয়ে চলুন। আমি বাইয়াত গ্রহণ করবো। কেবলাজানের কদমে গিয়ে বললেনÑ ‘বাবা, আমাকে আপনার নগন্য খাদেম হিসেবে কবুল করেন’।
২০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার, স্থানীয় কয়েকজন মিলে উত্তর দিনাজপুর শহরের ইসলামপুর নামক স্থানের এক বিশাল ময়দানে দ্বিতীয় মাহফিলের আয়োজন করলেন। সেখানেও সমবেত হলো হাজার হাজার মানুষ এদের মধ্যে নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধা শিশু-কিশোর কেউ যেন বাদ নাই। দেখতে দেখতে মাহফিলের কার্যক্রম শুরু হলে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মানুষের ঢল। কেবলাজানের সুললিত মধুর কণ্ঠ মোবারকে সত্য তরিকার বাণী শুনে তাদের মধ্যে যে, দীর্ঘদিনের অজানা কুসংস্কার, কু-শিক্ষা, গোড়ামীর মনোভাব ছিলো তা মুহূর্তেই যেন ুছে ফেলে রাসুলুল্লাহর সত্য তরিকায় শামিল হয়েছেন। আখেরী মোনাজাতের পর এলাকার লোকজন বাবাজানের কাছে সবিনয় আবেদন করলেন, ইসলামপুরে একটা খানকা শরীফ নির্মাণ করতে চায় তারা এবং বাবাজান যেন সে খানকার নাম ও ভিত্তি স্থাপন করে যান। বাবাজান, আশেকের মনের জ¦ালা নিবারণ করতে তাদের ইচ্ছার গুরুত্ব দিয়ে, ‘কুতুববাগ খানকা শরীফ’ নামকরণ করে ভিত্তি স্থাপন করে দিলেন। এরপর মাহফিল ছিল বেলকোবা নামক স্থানে এখানকার লোকজনের আতিথিয়তা দেখে অবিভূত হলাম!
২৩ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার মাহফিল ছিল কুচবিহার জেলার হলদিবাড়িতে। সেখানেও হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষের ঢল দেখে নিজের ভিতরে একটা অনুশোচনা কাজ করতে ছিলো যে, আমরা বাংলাদেশে এত এত মাহফিল করি। কিন্তু এত মানুষের সমাগম তো দেখি না, তবে কোথাও কোথাও যে এর ভিন্নতা নাই তা কিন্তু না। মাহফিলে মহিলাদের জন্য পর্দার ভিতরে আলাদা ব্যবস্থা করা হল। ওই দেশের নিয়ম ধর্মীয়সহ যে কোন অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের বসার স্থান একসঙ্গে কিন্তু খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান সে নিয়মের ভীত ভেঙে মহিলাদের জন্য পর্দার ব্যবস্থা চালু করে দিলেন এবং পুরুষের জন্যও পর্দার নসিহত দিলেন। সত্যিই আশ্চর্য্যরে ব্যাপার হলো এতে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে কোর রকম বিরোধী মনোভাব দেখতে পেলাম না। তারাও সানন্দে গ্রহণ করেছেন এ নিয়মকে। আমরা যখন গোসাইর হাটে প্রথম মাহফিলে গিয়েছিলাম সেদিন আমরা উঠেছিলাম আফতার উদ্দীন ভাইজানের বাড়িতে, তিনিও কেবলাজানের আশেক। ওই সময়ে তার মেয়ে ছিলেন গর্ভবতী এবং সে ধুপগুড়ির এক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবুও আফতার ভাইজান কেবলাজানের সঙ্গেই ছিলেন এক মুহূর্তের জন্যও কেবলাজানের থেকে আলাদা হন নাই। দুদিন পর ফোন এলো তার মেয়েকে গুরুতর অবস্থায় জলপাইগুড়ি জেলার একটি হসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। আখতার ভাইজান তার পরিবারকে ফোনে বলে দিলেনÑ ‘আমার মুর্শিদ কেবলাজানকে রেখে আসতে পারবো না। আমার দৃঢ় বিশ^াস খাজাবাবা কুতুববাগীর উছিলায় আমার মেয়ের সুস্থসবল সন্তান হবে ইনশাআল্লাহ।’ পরদিন আফতার ভাইজান কেবলাজানকে বলে হাসপাতালে গেলেন, কারণ সন্তান ডেলিভারীর সময় হয়ে এসেছে। আল্লাহপাকের কি অশেষ মেহেরবানী তিনি হাসপাতালে পৌঁছা মাত্র বিনা অপারেশনে সন্তান ভূমিষ্ট হল। অথচ আগে থেকেই ডাক্তার বলেছিল অপারেশন ছাড়া সন্তান ডেলিভারী করানো সম্ভব না।
কেবলাজানের সফরসঙ্গী মাওলানা গোলাম আম্বিয়া, মাওলানা কুতুবুল আজিজ, মোঃ আকবর, মোঃ অরূপ, মোঃ এহসান আহমেদ এবং মোঃ নাজির হোসেন ভাইজান এবং এ নিবন্ধকার। এ সফরে ভারতের মাটিতে অগনিত মানুষের মাঝে সূফীবাদের আলো ছড়িয়ে, দীর্ঘ কালের কুসংস্কারাচ্ছন্ন রীতি-নীতির পট পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার সময় কেবলাজান শুধু এটুকুই বললেন, ‘এই আত্মাগুলো আমার সঙ্গে লউহে মাহ্ফুজে ছিল, তাইতো এদেরকে এতো আপন, এতো কাছের মনে হয়। এদের ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।’ লক্ষ্য করলাম কেবলাজানের মন যেন কেমন হয়ে গেল, জাকের ভাইদের কান্ন্কাটি দেখে কেবলাজান বললেন, ‘আবার দেখা হবে এখানে নয়তো কবরে, মিজানে, হাশরের পুলসিরাতে। আমরা আলমে আরওয়ায় একত্রে ছিলাম, এখানে এসেও দেখা হল। আবার একত্র হব হাশরে।’
লেখক : সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (ফিন্যান্স), আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও খাদেম, কুতুববাগ দরবার শরীফ