নামাজে হুজুরীদিল ছাড়া কেহ আল্লাহর নৈকট্য বা দিদার লাভ করিতে পারিবে না

আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

আল্লাহতায়ালা বান্দাদের ওপর তাওহীদের পর নামাজ হইতে অধিক প্রিয় আর কোন জিনিস ফরজ করেন নাই।

পবিত্র কোরআনের সূরা আন্‌কাবূত-এর ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়া আক্বিমুস্ব্ স্বালা-তা ইন্নাস্ব স্বালা-তা তান্‌হা আনিল্ ফাহ্শা ই ওয়াল্ মুনকার’।অর্থ: নামাজ কায়েম কর, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে পাপের কাজ হইতে বাঁচাইয়া রাখে’। বর্তমানে অধিকাংশ নামাজীদেরই কী রকম অবস্থা তাহা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন। অনেক নামাজী নামাজ পড়ে, আবার তারা ঘুষ গ্রহণ করে, রেশওয়াত, মিথ্যা, ধোঁকাবাজী করে, পরকে ঠকায়। এসব গুনাহ্য়ে কবিরা ও গুনাহ্য়ে ছগিরা। মোট কথা যত প্রকার গুনাহ্ আছে, এর সবই অনেক নামাজীগণ করিতেছে। কোন রকম গুনাহ্ই নামাজী বাদ দিতেছে না। আল্লাহতায়ালা বলিতেছেন, নামাজ নামাজীকে কঠিন গুনাহ্র কাজ হইতে বাঁচাইয়া রাখে। কিন্তু এখন নামাজ যে গুনাহ্র কাজ হইতে বাঁচাইয়া রাখে না, ইহার কারণ কী? আল্লাহতায়ালা তবে কি মিথ্যা কথা বলিয়াছেন? (নাউজুবিল্লাহ)। না, আমরা মূলে নামাজই পড়িতেছি না, আল্লাহতায়ালা কখনো অসত্য বলিতে পারেন না। বরং আমরা হাকিকতে নামাজই পড়িতেছি না। আমরা অধিকাংশই কেবলমাত্র সমাজ রক্ষা করিয়া আসিতেছি। এই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত (নামাজ) আমরা কিভাবে সম্পূর্ণ করিয়া থাকি, তাহা নিজে নিজে গভীরভাবে চিন্তা করিলে বুঝিতে পারিবেন। দায় ঠেকাভাবে কি আমরা এই নামাজ পড়ি না! মাথার বোজা নামাইয়া ফেলার মত কি আমরা নামাজ আদায় করি না? লোকলজ্জার ভয়ে, সমাজের ভয়ে, গুরুজনের ভয়ে কি আমাদের অনেকের নামাজ পড়া হয় না? তবে কী করিয়া সে নামাজ আমাদিগকে নানা প্রকার গুনাহ্র কাজ হইতে বাঁচাইবে? নামাজে হুজুরী দিল না হইলে পুরুষ ও মেয়েলোক কাহারও নামাজ শুদ্ধ হইবে না। অর্থাৎ, নামাজের মধ্যে মন সর্বদা খোদার ধ্যানে একাগ্র না হইলে নামাজ শুদ্ধ হইবে না। কেননা, সহিহ্ হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘লা ছালাতা ইল্লা বিহুজুরীল ক্বালব’। অর্থ: হুজুরী দিল ব্যতীত নামাজ শুদ্ধ হয় না’। মনে সর্বদা খোদাতায়ালার ধ্যান থাকা ও তাহার প্রেম ও ভালোবাসা ব্যতীত নামাজ শুদ্ধ হয় না। আল্লাহতায়ালা কোরআন শরীফে আর একস্থানে ফরমাইয়াছেন, ‘ফামন কানা ইয়ারজু লিক্বা আ রাববিহী ফাল্ ইয়া’ মাল্ স্বা-লিহাও ওয়ালা- ইউশর্কি বি ইবা-দাতি রাববিহী আহাদা’। অর্থ: যে ব্যক্তি তাহার পালনকর্তার সহিত সাক্ষাত ও তাহার দিদারের আশা রাখে, তাহার উচিৎ যে, সে যেন নেক কাজ করে ও তাহার পালনকর্তার ইবাদতে কাহাকেও শরিক না করে’। (সূরা : কাহাফ, আয়াতÑ ১১০)। বর্তমানে নামাজীদের নামাজের কী অবস্থা তাহা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন। আমরা সূরা ফাতেহা (আলহামদু)তে যখন পাঠ করি ‘ইয়াকা না-বুদু ওয়াই-য়াকা নাস্তাইন’ (অর্থ : আমি তোমারই বন্দেগী করি ও তোমারই নিকট সাহায্য প্রাথনা করি), পড়ি, তখন কাহার কথা বা কাহার রূপ ধ্যানে থাকে এবং এই কথা কাহাকে বলা হয়। প্রায়ই দেখা যায়, যে যাহা ভালোবাসে বা যাহার চিন্তা দিলে পোষণ করে, তাহার কথাই তখন তাহার ধ্যানে আসে। বরং অন্য সময় অপেক্ষা নামাজের মধ্যেই নানা প্রকার সাংসারিক চিন্তা ও বাজে বাহুল্য বিষয় হৃদয়ের ভিতরে আরও বহুগুণে বেশি ঘনীভূত হইয়া উপস্থিত হয়। এমনকি অনেক সময় নামাজের রুকু, সেজদা, তসবিহ্ ও বৈঠক রীতিমত হয় না। এই প্রকার ভুল ও বেখেয়ালী নামাজীকে শাস্তির সংবাদ দিয়া আল্লাহতায়ালা (সূরা মা‘উন-এর ৪, ৫ ও ৬ নং আয়াত) ফরমাইয়াছেনÑ ‘ফাওয়াইলুল লিল মুস্বাল্লীন’। ‘আল্লাযীনা হুম আন স্বালা তিহিম সা-হূন’। ‘আল্লাযীনা হুম ইউরা- ঊন’। অর্থ: যে মুসল্লি (গায়ের-আল্লাহর চিন্তায়) নামাজে ভুল করে, তাহার জন্য দোজখের ঐ স্থান যাহার নাম ‘ওয়ায়েল’ এবং তাহার জন্য যে ‘রেয়া’ (লোককে দেখানোর জন্য এবাদত) করে।

হযরত নবী করীম (সঃ) ফরমাইয়াছেন, ‘সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট চোর ঐ ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। অর্থাৎ লোককে দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করিয়া থাকে। কোন এক কবি এ সম্বন্ধে বলিয়াছেন,

‘জাবা দর জেকরে ওয়া দেল দর ফেকরে খানা,
চে হাসেল শোদ জী নামাজে পাঞ্জে গানা।
চে শোদ গার মসহা-ফাহ দর পেশে বাশোদ,
চু দেল দর ফেকের গাওউ মেশে বাশোদ’।

অর্থ: মুখে আল্লাহর জিকির ও হৃদয়ে বাড়ি-ঘরের চিন্তা থাকিলে, সেই প্রকার পাঞ্জেগানা নামাজে তোমার কী লাভ হইবে? তোমার মনে যদি গরু ও মেষের ভাবনা বা চিন্তা থাকে, তবে সম্মুখে কোরআন খুলিয়া রাখিলে কি ফল হইবে? অতএব, খোদার ইবাদতে ঘোড়া, গরু, ভেড়া, বকরি, স্ত্রী-পুত্রকে গায়রুল্লাহ্ ভাবিয়া আমরা বাতেনে মোশরেক হইতেছি। ইহা কত বড় ভয়ঙ্কর পাপের কাজ করিতেছি! এসকল শিরক হইতে মুক্তির ব্যবস্থা করা কি আমাদের কর্তব্য নহে? হযরত রাসুলপাক (সঃ) ফরমাইয়াছেন, ‘এমন অনেক নামাজী আছে, তাহাদের পরিশ্রম ও ক্লান্তি ব্যতীত নামাজ হইতে আর কিছুই লাভ হয় না। ইহার কারণ এই যে, তাহারা কেবল শরীরকে কষ্ট দিয়া এবং ক্লান্ত করিয়া নামাজ পড়িয়া থাকে। অথচ তাহাদের অন্তর আল্লাহতায়ালা হইতে বহু দূরে থাকে। হযরত হাসান বস্রী (রহ:) বলিয়াছেনÑ ‘যে নামাজ একাগ্রচিত্তের সহিত না হয়, সে নামাজ শাস্তির যোগ্য। অর্থাৎ যে নামাজী নামাজকে একাগ্রচিত্ততার সহিত পড়িবার জন্য চেষ্টাও করে না, কিংবা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়িয়া থাকে, তাহার নামাজ শাস্তিযোগ্য। অন্য আর এক হাদিসে আছে, যে নামাজী স্বীয় নামাজকে বাজে কল্পনা ও নানাবিধ চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিতে চেষ্ট করে না (অর্থাৎ বাজে চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিতে চেষ্টা করে না) সে আল্লাহতায়ালার দরবার হইতে বিতাড়িত হওয়া ব্যতীত উক্ত নামাজে কোন ফল পাইবে না। এখন বোধ হয়, জাহেরা আলেমগণ হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সাহেবের দায় দিয়া অব্যাহতি পাইতে চেষ্টা করিবেন।

হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সাহেব যে রায় দিয়াছেন, নামাজের প্রথম তাকবিরের সময় আল্লাহতায়ালার স¦রণ হইলেই নামাজ হইয়া যাইবে। ইহার অর্থ এই নয় যে, নামাজের অন্য অংশে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করিতে হইবে না। বরং উহার মর্মে এই বোঝা যায় যে, নামাজের সকল অংশেই আল্লাহকে স্মরণ রাখিতে হইবে। কিন্তু কেহ যদি কোন ওযরবশত: উহাতে অক্ষম হয়, তবে প্রথম তকবিরে খোদাতায়ালাকে স্মরণ করিলেও তাহার নামাজ কোন রকমে আদায় হইয়া যাইবে। ইহা তিনি নাচারী অবস্থায় মত দিয়াছেন। তাই বলিয়া তিনি ইহা বলেন নাই, তোমরা জীবনভরই ওইভাবে নামাজ পড়িও। অথচ তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে, কোরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধে যদি তোমরা আমার কোন কথা দেখিতে পাও, তবে উহা বাদ দিয়া কোরআন ও হাদিসমতে আমল করিও। অনেক লোক আছে, তাহারা নিজে নিজে নামাজে হুজুরীর জন্য খুব চেষ্ট করিয়া থাকে, কিন্তু কোন কামেল অলির সাহায্য নেয় না। তাহারা বলে, নামাজে হুজুরী দিলের জন্য চেষ্টা করার হুকুম আছে। আমরা হুজুরীর জন্য চেষ্টা করিয়া থাকি, তাহা সত্বেও যদি হুজুরী দিল না হয়, তবে আমরা আল্লাহর হুজুরে দায়ী হইবো না। নিশ্চয় তাহারা হুজুরীর জন্য দায়ী হইবে। কেননা, আল্লাহতায়ালা মানুষকে পাপের সাগর হইতে মুক্ত করার জন্য সবসময় সব দেশে অলি পাঠাইয়া আসিতেছেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সঃ) অলিদের নিকট গিয়া মানুষের আমলকে শুদ্ধ করার জন্য আদেশ করিয়াছেন। সেই অলিদের সাহায্য না নিয়া, এখন যদি নিজে নিজে শত চেষ্টাও করা হয়, তবে সেই চেষ্টার কোন মূল্য নাই। দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের কাজ অতি কঠিন ও আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া অতি তুচ্ছ ও মূল্যহীন। সেই কাজের জন্য অন্যের সাহায্য নিতে এতো আপত্তি কেন? ইহা শয়তানের ধোকা ভিন্ন আর কিছু নহে। ইহা তাহাদের ঈমানের কমজোরী এবং তাহাদের ভিতরে আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর মহব্বত ও ভয় না থাকার নিদর্শন।

এখন জানা আবশ্যক যে, এমন কি কোন হাদিস বা কোরআনের বাণী আছে যে, প্রথম তকবীরের সময় হুজুরীদিল হইলেই নামাজ শুদ্ধ হইয়া যাইবে? বরং নামাজের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত হুজুরী দিলে নামাজ পড়া সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত ও হাদিস রহিয়াছে। নামাজের মধ্যে অন্ত:করণকে (দিলকে) হাজির রাখিয়া ভীতি ও ভক্তি সহকারে প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালাকে হাজির-নাজির জানিয়া, তাহার ধ্যান ও নামে বিভোর হইয়া, নামাজ পড়াকে নামাজের প্রাণ বলা হয়। এই মর্মেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে সূরা ত্বোয়া’র প্রথম রুকুতে ফরমাইয়াছেনÑ ‘ওয়া আক্বিমুস্বস্বালা-তা লিয্কিরী’। (আয়াত নং ১৪)। অর্থ : আমাকে (আল্লাহকে) স্মরণ করার জন্য নামাজ কায়েম কর। ইহা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সমগ্র নামাজেই আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করিতে হইবে এবং তাহার স্মরণ ও ধ্যানই নামাজের আসল উদ্দেশ্য। তাই রাসুল করিম (সঃ) ফরামাইয়াছেনÑ ‘আন তা‘য়াবু-দাল্লাহা কা আন্নাকা তারাহু ফাইন্ লাম তাকুন্ তারাহু ফাইন্নাহু ইয়ারাক’। অর্থ : তুমি এমনভাবে আল্লাহতায়ালার বন্দেগী কর, যেন তুমি আল্লাহকে দেখিতেছ। যদি উহা না পার, তবে এইরূপভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন আল্লাহ তোমাকে দেখিতেছেন। এই হাদিস দ্বারা ইহাই প্রমাণ হইতেছে যে, সমস্ত নামাজেই আল্লাহাতায়ালার মোশাহেদা (দর্শন) লাভ করিতে হইবে। যদি উহাতে অক্ষম হয়, তবে কমপক্ষে আল্লাহ দেখিতেছেন, এই খেয়ালে সমস্ত নামাজ আদায় করা আবশ্যক। ইহার ব্যতিক্রম হইলে নামাজ শুদ্ধ হইবে না। অন্য আর এক হাদিসে আছে যে, রসুল করিম (সঃ) ফরমাইয়াছেনÑ ‘আচ্ছালাতু মিরাজুল মো‘মিনিন’। অর্থ: নামাজ মোমিনদের জন্য মেরাজ’। অর্থাৎ, খোদাপ্রাপ্তির সোপান।

আমি এখন তরিকতের বিদ্বেষী এবং শুধু শরিয়ত অবলম্বী আলেম ও মুসল্লিগণকে জিজ্ঞাসা করি, নামাজে আপনাদের মেরাজ কয়দিন হইয়াছে? এতকাল নামাজ পড়িয়া যদি কোন দিন মেরাজ না হইয়া থাকে, তবে রাসুলুল্লাহ (সঃ) কি অসত্য বলিয়াছেন? (নাউযুবিল্লাহ), তিনি সত্যই বলিয়াছেন। কেবল আমাদের নিজের শৈথিল্যে নামাজকে মেরাজ করিয়া তুলিতে পারি না। ইহা করা অসম্ভব নহে, কামেল-মোকাম্মেল মুর্শিদের তাওয়াজ্জুহ্ গ্রহণ করিয়া, কঠোর সাধনা ও চেষ্টা করিলেই তাহা সম্ভব হইবে। যদি অসম্ভব হইত তাহা হইলে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এই কথা বলিতেন না। হযরত আনাছ (রা:) হইতে অন্য এক হাদিসে রেওয়ায়েত আছেÑ যথা : ‘ইন্নামাল মু‘মিনুনাইয়া কানা ফিছ্ছালাতি ফাইন্নামা ইয়ুনাজি রাব্বাহু’। অর্থ: নিশ্চয় মোমিন ব্যক্তি নামাজের মধ্যে তাহার পালনকর্তার সহিত কথোপকথন করিয়া থাকে। প্রিয় সম্মানিত পাঠকগণ, এ পর্যন্ত কোরআন ও হাদিসের যে সমস্ত বাণী উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে চিন্তা করিয়া দেখুন যে, পুরুষ ও মেয়েলোক উভয়ের জন্যই হুজুরী দিলে নামাজ পড়া ফরজ কিনা? কেহ যদি নিজে নিজে চেষ্টা করিয়া হুজুরীদিল ঠিক করিতে না পারে, তবে যে ব্যক্তি হুজুরীদিল ঠিক করিয়া দিতে পারেন, তাহার নিকট গিয়া হুজুরী দিলে নামাজ পড়ার জন্য চেষ্টা করা ফরজ কি না? জ্ঞানীমাত্রই একথা স্বীকার করিবেন যে, হুজুরী দিলে নামাজ পড়া ফরজ এবং হুজুরী দিলে নামাজ পড়ার জন্য কামেল মোকাম্মেল মুর্শিদের তাওয়াজ্জুহ গ্রহণ করিয়া চেষ্টা করাও ফরজ।

(Visited 2,104 times, 1 visits today)
Share