কামেল মুর্শিদ বা পীরের কাছে যাওয়ার অকাট্য দলিল

আলহাজ মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ্ নকশ্‌বন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

কিছু কিছু মানুষের ভুল ধারণা, তারা কথায় কথায় বলে থাকে, ‘মা-বাবা জীবিত থাকলে পীরের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। তাদের অযুক্তিক কথা খন্ডনের জন্য, আমি একটি হাদিস তুলে ধরলাম, ‘উত্‌লুবুল ইল্‌মা ওয়ালাউ কানা ফিচ্চীন’। অর্থ: রাসুলেপাক (সঃ) এরশাদ করেছেন, জ্ঞান অর্জন করার জন্য সুদূর চীন দেশে যেতে হলেও যাও, তবুও এলেম হাছিল করো। তদ্রুপ কামেল পীর-আউলিয়াদের দরবারও এল্‌মে মারেফত বা তাসাউফ শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে পীরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে, নিজেকে চেনা-জানার মত ও পথে আমলের দ্বারা আল্লাহতায়া’লার নৈকট্যলাভ করাই পীর-আউলিয়াদের দরবারে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য।

সুরা মায়িদার ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘লিকুল্লিন্ জ্বাআল্‌না মিন্‌কুম শির আতাও অমিন্ হাজ্বা’। অর্থ : আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য দুইটি পথ দিয়েছি, একটি হলো শরিয়তের পথ অপরটি হলো মারেফতের পথ’। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, শরিয়তের এলেমের দ্বারা শরীরের বাহিরের দিক অর্থাৎ, জাহেরকে দূরস্থ করে এবং এল্‌মে মারেফতের দ্বারা, শরীরের ভিতরকে পাকপবিত্র করে।সুরা কাহাফ এর ১৭ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘অমাই ইয়ুদ্বলিল ফালান্ তাজ্বিদালাহু অলিয়্যাম মুরশিদা’। অর্থ: তারাই হতভাগা বা গোমরাহ, যারা কামেল মুর্শিদ বা পীরের সান্নিধ্যে গেল না এবং ছোহবত লাভ করল না। হক্কানী পীরকামেলের ছোহবতে না গেলে, আল্লাহতায়া’লা তাদেরকে পথভ্রষ্ট বা গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুরা তওবাহ’এর ১১৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজ্বিনা আমানুত্ তাকুল্লাহা অকূনূ মাআছ্ ছোয়া দিক্বীন’। অর্থ: হে ঈমানদার বিশ্বাসীগণ! তোমরা সত্যবাদিদের সঙ্গী হইয়া যাও। এই আয়াতে পীরকামেলর নিকট এবং সত্যবাদিদের কাছে যাওয়ার জন্য আল্লাহতায়া’লা হুকুম করেছেন। হে পাঠকগণ, আপনারা চিন্তা করিয়া দেখুন, আল্লাহর আদেশ অমান্য করিলে তার পরিণাম কী হইতে পারে।

সুরা মায়িদাহ-এর ৩৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজ্বিনা আমানুত্ তাকুল্লাহা অবতাগূ ইলাইহিল অসীলাতা ওয়াজ্বাহিদু ফি ছাবিলিহী লা আল্লাকুম তুফলিহুন’। অর্থ : হে ঈমানদার বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আল্লাহকে পাইবার জন্য উছিলা অন্বেষণ কর। তার পথে জেহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’। মশহুর তাফসিরে উছিলা দ্বারা শুদ্ধ মানুষ বা চৈতন্য গুরু ধরার কথা বলা হয়েছে। (এখানে ‘চৈতন্য গুরু’ দ্বারা কামেল পীর বা মুর্শিদ বুঝানো হয়েছে।)

সুরা ফতেহার ৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘ইহ্দিনাছ্ ছিরাত’ল মুস্তাক্বীম” অর্থ : আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’। ৬ নং আয়াত ‘ছির ত্বোয়াল্লাজ্বীনা আন্ আম্‌তা আলাইহিম’। অর্থাৎ, ‘সেই সকল মানুষের পথে, যাদেরকে আপনি নিয়ামত এবং বাতেনি চক্ষু দান করেছেন’। ৭নং আয়াত, গাইরিল মাগদুবি আলাইহীম ওলাদ-দ্বোয়াল্লীন’। অর্থ :  সেই সমস্ত মানুষের পথে নয়, যেই সমস্ত মানুষ আপনার গজবে নিপত্তি এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে’। হুজুর পুরনূর (সঃ) এরশাদ করেছেন, ‘ত্বোয়ালেবুল ইল্‌মি ফারিদ্বাতুন্ আলা কুল্লি মুসলিমিন ওয়া মুসলিমাতিন’। অর্থ : প্রত্যেক নর-নারীর জন্য এলেম তলব করা ফরজ’। (রাওয়াহুল বায়হাক্কি ওয়া ইবনে মাযহা)।

আমরা জাগতিক বা জাহেরি শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রথমে মক্তব-মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, কলেজ, ইউনির্ভাসিটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন করে থাকি। তেমনি আল্লাহকে পাওয়া এবং তার নৈকট্যলাভ করার জন্য, হক্কানি কামেল পীর বা আউলিায়াদের তরিকার পথ অনুসরণ করতে হয়। তাঁরা আত্মাকে এছলাহ্ বা আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা ও নামাজে হুজুরি লাভের উদ্দেশ্যে, হরহামেশা অজিফা-কালাম, ধ্যান-মোরাকাবার শিক্ষা দিয়ে আল্লাহতায়া’লার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে থাকেন।

মসনবি শরীফে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন, ‘এল্‌মে বাতেন হামসু মছকা এল্‌মে জাহের হামসু শির, কায়বুওয়াদ বে শরীরে মছকা বায় বুওয়াদ বে পীরে পীর’। অর্থ: জাহেরি শিক্ষার জন্য যেমন একজন মাস্টার বা শিক্ষকের কাছে যেতে হয়, তেমনি আত্মাকে এছলাহ্ বা নিজেকে চেনার জন্য একজন আধ্যাত্মিক গুরু বা কামলে পীর-মুর্শিদ ধরতে হয়। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী আরোও বলেন, ‘খোদ বা খোদ কামেল না শোদ মাওলানায়ে রুম, তা গোলামে শামসে তিবরিযী না শোদ’। অর্থ: আমি ততক্ষণ পর্যন্ত মাওলানা  হইতে পারি নাই, যতক্ষণ না পর্যন্ত  আমার পীরের পায়রবী করলাম। মাওলানা রুমী আরোও বলেন, ‘দর হাকিকত গাশ্‌ তায়িদূর আয্ খোদা, গর শুভি দুর আয্ ছোহবতে আউলিয়া’। অর্থ : সত্যিকারে ওই ব্যক্তিই আল্লাহতায়া’লার নিকট হইতে দূরে আছে, যে ব্যক্তি অলি-আল্লাহর নিকট হইতে দূরে থাকে’। চার ইমামের প্রধান ইমামে আজম আবু হানফা (রহ.) বলেন, ‘লাওলা ছিনতানে হালাকা নোমান’। অর্থ : আমি নোমান যদি দুই বছর আমার পীর ইমাম বাকের (রহ.) এর গোলামী না করতাম, তবে ধ্বংস হয়ে যেতাম’। হে পাঠকগণ, এখন চিন্তা করিয়া দেখুন, তিনি একজন এত বড় ইমাম হওয়া সত্যেও, তার পীর ইমাম বাকের (রহ.)-এর কাছে, নিজেকে একেবারেই আত্ম-বিলিন করে দিয়েছিলেন। অতএব, পীরকামেলের কাছে না গেলে আমাদের কী অবস্থা হইবে, আপনারাই ভেবে দেখুন।

(Visited 4,499 times, 1 visits today)
Share