কামেল মোর্শেদ বা গুরু ছাড়া ধ্যান-সাধনা নিষ্ফল

আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

হাদিস শরিফে খেজুর বৃক্ষকে মুমিনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ফুল রেণু মিলন বিনে খেজুর বৃক্ষে ফল ধরে না। সেভাবে মুরিদ যতক্ষণ না পর্যন্ত, কোনো কামেল মোর্শেদের তালকিন ও ফয়েজ গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার অস্তিত্বে মারেফতের ফল ধরবে না। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলে করিম (সঃ) এরশাদ করেন, একটি গাছ আছে, যার পাতা কখনো ঝরে না। এর উদাহরণ হলো মুসলিম ব্যক্তির মতো। বলে তো, সে গাছ কোনটি? সাহাবায়ে কেরাম বন-জঙ্গলের বিভিন্ন গাছের কথা ভাবতে লাগলেন। আমার মনে হলো, এটি খেজুর বৃক্ষ। কিন্তু মুরুব্বিদের উপস্থিতিতে আমার তা বলতে লজ্জা লাগলো। শেষে সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এটি কোন গাছ? রাসুলে করিম (সঃ) বললেন, এটি হলো খেজুর গাছ। রেণু মিলন না ঘটা পর্যন্ত তা ফল দেয় না। (এমদাদুস সুলূক, পৃষ্ঠা ৮২, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমার আত্মাকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাদের সাথে একান্ত কর। যারা সকাল-সন্ধ্যায় তোমার প্রভুকে ডাকে। প্রভুর সন্তুষ্টির আশায়। (সুরা রুম, আয়াত ১৭)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানু ইত্তাকুল্লাহা ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াছিলা’। (সুরা মায়িদা, আয়াত ৩৫)
অর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং অছিলা তালাশ কর।
এই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় হযরত আবু কাতাদাহ (রাঃ) বলেন, ‘ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াছিলা আয় তাকাররাবু ইলাইহি বিত্তআ ওয়া বিমা ইয়ারদিহ।’
অর্থঃ আল্লাহর সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে কর্মগুলি সম্পাদন করা প্রয়োজন সেগুলো কর।
আল্লাহপাক এরশাদ করেন-“কুনু মায়াস্সাদিকিন” (সুরা তাওবা, আয়াত ১৯)
অর্থঃ ‘তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বসরি বলেছেন, সিদ্দিকিন তারা, যাঁদের নিকট শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের জ্ঞান রহিয়াছে এবং যাঁদের নিকট সত্য প্রকাশ হইয়াছে তাদের সঙ্গী হওয়া ফরজ।
মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা তাদের অনুসরণ করিও না যাহারা আমাকে স্মরণ করে না এবং নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী চলে।’ (আল কোরআন)
‘তোমরা জানিয়া নাও তাদের নিকট থেকে যাহারা আমাকে স্মরণ করে।’ (আল কোরআন)
হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) বলেন- ‘‘তালাবু আহলিল কালবি লি হায়াতিন ফারজুন।’’
অর্থ ঃ অন্তর সঞ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে মোর্শেদে কামেলের অনুসরণ করা ফরজ।
মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (রহ.) ‘তালিমুদ্দিন’ কিতাবে লিখেছেন, ওস্তাদ ছাড়া কোন জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। সুতরাং আল্লাহ তায়ালাকে খুশির জন্য রুহ জীবিত করা ফরজ এবং রুহানি ওস্তাদ তালাশ করা ফরজ।
মাওলানা কাজি ছানাউল্লাহ পানিপথি (রহ.) বলেন, পীরকে মহব্বত করা ওয়াজিব কেননা নায়েবে রাসুলই আল্লাহ ও রাসুলের দিকে ধাবিত করে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) ‘কাওলুল জামিলে’ লিখেছেন, আল্লাহর নৈকট্য এভাবে অর্জন হইবে (১) জিকির (২) মোরাকাবা (৩) পীরের সাথে একান্ত হওয়া।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) বলেন, তর্কাতর্কি ত্যাগ কর, খোদাপ্রেমিক হও। আল্লাহর প্রেম লাভের উদ্দেশ্যে কামেল পীরের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দাও। (মসনবি শরিফ)
মাওলানা রুমি নিজে নিজে কামেল হতে পারেনি যতক্ষণ না শামসুত তাবরিজির গোলামি না করেছে।
খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) বলেন,
‘জানে মান নেসারাম ব নামে হুসাইন
মোনামে বনামে গোলামানে হুসাইন।’
অর্থাৎ আমার জীবন শুধু হুসাইনের ইশকে উৎসর্গ নয়, বরং হুসাইন (রাঃ)-এর যারা গোলাম তাদের জন্যও আমার জীবন উৎসর্গ।

শেখ ফরিদ (রহ.) বলেন,
‘হয়ে যদি থাক তুমি কঙ্কর পাথর
পীরের সোহবতে হবে রতেœর আকর।’

আমির খসরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার শানে বলেন, ‘ওমরু কি বয়াত আহদাস গুজাস্তে।’
অর্থাৎ, হে আমার পীর, আমাকে সারাজীবন তোমার গোলামি থেকে নিরাশ করো না।
ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ.) বলেন,
‘মান তাফাক্কাহা ওয়ালাম ইয়াতাসাওওয়াফা ফাকাদ তাফাসসাকা, ওয়া মান তাসাওওয়াফা ওয়ালাম ইয়াতাফাক্কাহ ফাকাদ তাযানদাকা ওয়ামান জামাআ বাইনাহুমা ফাকাদ তাহাক্কাকা।’
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শুধু ফিকাহ-এর জ্ঞান অর্জন করেছে অথচ তাসাউফের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়নি, সে ফাসেক। আর যে ব্যক্তি তাসাউফ অর্জন করেছে ঠিক কিন্তু ফিকাহের প্রতি উদাসীন, সে জিন্দিক বা ধর্মহীন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি উভয়টিকে একত্র করল সে প্রকৃত সত্য পেল। তবে তাহাক্কাকাই হল ধ্যান-সাধনা। তবে ওস্তাদ না হলে বুঝব কি করে?
আমি শরিয়ত ও মারেফতের মধ্যেই ডুবে আছি। এটাই আমার গুরু আমাকে শেখাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- ক্বালা রাসূলুল্লাহি (সাঃ) আল কোরআনু নাযালা আলা ছাবআতি আহরুফিন। লিকুল্লি আয়াতিন মিনহা যাহারা ওয়া বাতান ওয়ালিকুল্লি হাদ্দিন মাতলা।
রাসূল (সঃ) বলেছেনÑ কোরআনকে সাত প্রকার ভাবার্থ দিয়ে অবতীর্ণ করা হয়েছে। প্রত্যেক আয়াতে একটি জাহের আছে আর আছে একটি বাতেন। আবার প্রত্যেক সীমার শুরুও আছে।
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা তীবি (রহ.) বলেন- কোন সীমা বা শুরুর শেষ নেই। কারণ সে শেষ হলো খাঁটি আল্লাহওয়ালাদের রাস্তা যা আল্লাহর নবী ও অলিদের মাঝে একটি রহস্য।
হাসান বসরি (রহ.) বলেন- ইলম দুই প্রকার। যথা,
১। ইলমুল কালব (অন্তরের বিদ্যা)
২। ইলমুল লিসান (মুখের বিদ্যা)
ইলমুল কালব (এটাই গোপন বিদ্যা বা মনোবিদ্যা) অথবা ধ্যান সাধনার বিদ্যা। এটা খুবই প্রয়োজন এবং উপকার। ইলমুল লিসান হলো বৈষয়িক বিদ্যা বা শরিয়তের বিদ্যা, এটাই আদম সন্তানের ওপর দলিল।
এই ব্যাখ্যায় মোল্লা আলি কারি (রহ.) বলেছেন- যেই বিদ্যা যত প্রয়োজন সেই বিদ্যায় গুরু (ওস্তাদ) তালাশ করা ততো আবশ্যক।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সঃ) এরশাদ করেন- ‘ওয়া ইন্না আলিয়্যু ইবনে আবি তালেব ইনদাহু মিনাজ জাহের ওয়াল বাতেন।’
অর্থ ঃ নিশ্চয়ই হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট জাহেরি এবং বাতেনি বিদ্যা রহিয়াছে।
সুফি আজম বু-আলি কলন্দর (রহ.) দেওয়ানে বুআলিতে ফরমান-
‘হর আনে আর এশকে রব চশমে নেগা কর
হোওয়ায়ে খানেহ খামার দরদ।’
অর্থাৎ, কোন আরেফ বা সুফি সাধক কারও ওপর যদি দয়ার দৃষ্টি বা নজরে করম করে, তখন সে ব্যক্তি ঘর ছেড়ে আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন হয়ে যায়। উপরোল্লেখিত কোরআন ও হাদিস ফকিহগণের এবং সুফিগণের দলিল প্রমাণের পরও, যদি কাহারো আরও প্রমাণের বা দলিলের প্রয়োজন হয়, তবে সেটা যদি হয় হেদায়েত অথবা জানার উদ্দেশ্যে তবে আরও দলিল প্রমাণ রয়েছে গুরুর প্রয়োজনের স্বপক্ষে। আর যদি হয় তর্কের জন্যে তবে মনে করব, আপনি কপাল পোড়া বদনছিব ও বেয়াদব। বেয়াদব, আল্লাহর রহমত থেকে সদা বঞ্চিত থাকে।
তবে কঠিন ধ্যান সাধনায় যারা আত্মত্যাগ করেছেন এবং আল্লাহর করুণা অর্জনের জন্য যাহারা পীর মোর্শেদ ও অলিগণের অনুসরণ করেছেন এবং নিজেকে ও প্রভুকে চেনার জন্য যারা সুফিবাদের পথে নিজেকে একান্ত করেছেন, তাদেরকে যারা কাফির বা মোশরেক বা বেদায়াতি মনে করেন, আল্লাহ তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।
সুফিবাদের যদি প্রয়োজন না হতো তাহলে ফখরউদ্দিন রাজি (রহ.) এত বড় থাকা সত্ত্বেও গুরু নাজিমুদ্দীন কোবরার নিকট যেতেন না। ইমাম গাজ্জালিও আবু আলি ফারমুদির (একজন নিরক্ষর সাধক ছিলেন) নিকট যেতেন না। মাওলানা রুমিও (নিরক্ষর) শামসুদ্দিন তাবরিজির নিকট যেতেন না।
আপনার বিদ্যা ও বুদ্ধি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের সন্তুষ্টি ও মানুষের কল্যাণে হওয়া উচিত। আপনাকে হঠাৎ করে কাউকে তিরস্কার ও নিন্দা করার অধিকার কে দিয়েছে? আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে ফরমান- হে রাসুল, আপনি তো মানুষকে স্মরণ করাবেন এবং উপদেশ দিবেন। আপনি তো উপদেশদাতা। দয়াল নবীজির শানেও আল্লাহ তায়ালার এই হুকুম, আপনি কোথা থেকে কে আসলেন? কথায় কথায় অযাচিত ফতোয়া, কথায় কথায় বেদয়াত, আপনি তো ভুল করলেন। যেখানে হযরত মুসা নবীর ন্যায় জাদরেল নবী, খিজির (আঃ)-এর সাথে ধৈর্য্য ধরতে পারলেন না তাই বলে খিজির (আঃ)-কে কাফের উপাধি দেন নাই।
আপনার বিদ্যার অহংকার উদ্দেশ্যমূলক, জ্বালাময়ী বক্তৃতার শব্দ চয়ন হতে পারে লাখো লাখো মানুষের ধ্বংসের কারণ, আপনার জবাব প্রভুর সম্মুখে কী হবে?
ফতোয়ার কিতাব ‘দুররুল মোখতার’ এর মুরতাদ অধ্যায় ৩৯৯/৩ ফতোয়ায় স্পষ্ট বলা আছে, যদি কাউকে কাফের বা মোশরেক ফতোয়া দেওয়ার স্বপক্ষে অনেক কারণ থাকে, আর যদি একটি দলিল থাকে না হবার পক্ষে তবে আপনি কোন মতেই কাফের ফতোয়া দিতে পারবেন না। যত বড় মুফতি হন না কেন?
মহানবী (সঃ)-এর প্রিয় সাহাবা এবং আপন চাচাতো ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) সুন্দর একটি উপদেশ দিয়ে গেছেন যে, যেখানেই কোন জ্ঞান পাবে অর্জন কর। কিন্তু কোন ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ো না। অপরের ওপর চড়াও হয়ো না। এটা নির্বোধ ও দাম্ভিক লোকের কর্ম। জ্ঞানীদের নহে।
যেখানে আল্লাহ নিজেই বলেছেনÑ ‘সাবধান! আমার বন্ধুগণ মরেও অমর। (আল কোরআন)
আাল্লাহ আরো বলেন, আমার বন্ধুর সাথে যাহারা দুশমনি করে, তাদের সাথে আমি জিহাদের ঘোষণা দিলাম। (সুরা ইউনুস, আয়াত ৬২)
উপরে উল্লেখিত দলিলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য অবশ্যই দয়াল নবীজিকে জান-প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসতে হবে এবং রাসুল (সঃ)-কে ভালোবাসতে গেলে, অবশ্যই নায়েবে রাসুলদেরকে ভালোবাসতে হবে এবং তাদের সোহবত বা সান্নিধ্য অর্জন করলেই নাজাত মিলবে।

(Visited 2,386 times, 1 visits today)
Share