আলহাজ জয়নাল আবেদীন
যুগের ঘটে যাওয়া কাহিনী থেকে একটি ঘটনার কথা বলছি, এক এলাকায় এক চোর ছিল, সে বয়সে যুবক প্রতিবেশিদের লোটা-ঘটি, বাটি, হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি চুরি করতো। এ জন্য সে চোর হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করলো। একদিন সে চিন্তা করলো, এলাকায় যখন দাগীচোরের খেতাব পেলাম, তাই এখন থেকে আমাকে বড় চোর হতে হবে। এবং তা হতে হলে কি করতে হবে? ভেবেচিন্তে ঠিক করলো প্রথমেই রাজার বাড়িতে চুরি করতে হবে। রাজবাড়িতে ঢুকে আড়াল থেকে দেখতে পেলো, রাজা ও রাজকন্যা বসে আলাপ করছেন। শুনতে পেলো রাজা তার মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘মা, তোমার কাছে এত সুন্দর ভালো নামী-দামী পাত্রের প্রস্তাব আসে, তুমি তা একটাও পছন্দ করছো না এর কারণ কী মা, বলো? মেয়েটি পিতার কথা শুনে উত্তর দিলো, ‘আব্বা এইসব পাত্র আমার পছন্দ নয়। রাজা বললেন, কেন মা, তোমার কেমন পাত্র পছন্দ আমার নিকট মন খুলে বলো, তুমি আমার একমাত্র কন্যা। মেয়েটি পিতাকে জিজ্ঞেস করলো, আব্বা আমি আমার পছন্দের কথা বলবো কি? পিতা বললেন, হ্যাঁ মা তুমি বলো। মেয়েটি বললো, আব্বা আপনার রাজ্যে এমন কোন নওজোয়ান পাবেন কি? যে একাধারে চল্লিশটি জুমার নামাজ আদায় করেছে, তাহলে আমি তার সাথে চির বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি আছি। পিতা বললেন, মা, আমি তোমার জন্য এমন পাত্রই খুঁজে বের করবো। মেয়েটি বললো, পাবেন সত্যি, তবে এটা কোন রাজা-বাদশাহর ছেলে হয়তো হবে না, যদিও পান সে সাধারণ ছেলেই হবে। তবে তাকে যদি আপনার জামাতা বানাতে হয়, তাহলে আপনার সম্পদ থেকে কিছু সম্পদ দিয়ে তাকে সম্পদশালী করে নিতে হবে। পিতা বললো, মা, তুমি আমার একমাত্র কন্যা, যে আমার জামাতা হবে সে-ই তো আমার সকল সম্পদের মালিক হবে। এই কথা শুনে চোর বেটা ভাবতে লাগলো, এই তো আরেক সুবর্ণ সুযোগ। রাজার জামাতা হবে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগবে না, টাকা-পয়সা লাগবে না। শুধু চল্লিশটি জুমা নামাজ পড়লেই রাজকন্যাকে বিয়ে করা যাবে। তাহলে আর এই সুযোগ ছাড়া যাবে না। চোর বেটা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে, সোজা এসে মসজিদের বারান্দায় বসে বসে চিন্তা করতে লাগলো, ‘হায়! জীবনে তো কোনদিন নামাজই পড়ি নাই। আজ কেমন করে নামাজ পড়বো? এই চিন্তা করে করে ব্যাকুল হয়ে পড়লো। ইতিমধ্যে ফজরের আজানের সময় হলো। মুয়াজ্জিন আজান দিল, আজানের পর সে বললো, হে আল্লাহ আমি কীভাবে নামাজ পড়বো? আমাকে রাস্তা দেখাও। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল এক মুসল্লি এসে সুন্নত নামাজ পড়ছে। এরপর আরেক মুসল্লি এসে নামাজে দাঁড়ায়, তার পাশে দাঁড়িয়ে ওই মুসল্লির মতো করে চোরবেটাও নামাজ আদায় করলো। এরপর ইমাম সাহেব নামাজে দাঁড়ালো। চোর বেটাও ফজর থেকে এশা পর্যন্ত এভাবেই জামাতের সাথে নামাজ আদায় করলো। এই থেকে তার নামাজ পড়া শুরু হলো। এভাবে কয়েক দিন যাওয়ার পর, চোরবেটা ইমাম সাহেবকে বললো, হুজুর আমাকে কিছু সুরা কিরাত শিখাবেন? ইমাম সাহেব উত্তর করলেন, আরে ভাই তোমার মত একজনকে নামাজ শিখাতে পারলে তো আমার জীবন ধন্য হবে। ইমাম সাহেব তাকে ছাত্র হিসেবে তালিম দিতে শুরু করলেন। এভাবে সুরা কিরাত শিখতে শিখতে সে একজন পূর্ণ মুসল্লিতে পরিণত হলো। এখন সে আর এক ওয়াক্ত নামাজও ক্বাযা করে না, এভাবে দিন মাস বছর কেটে যাচ্ছে। এদিকে রাজা হঠাৎ তার রাজ্যে লোক-লস্কর দিয়ে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দিলেন, এ রাজ্যে এমন কোন নওজোয়ান ছেলে আছে কি, যে একাধারে চল্লিশ জুমা নামাজ আদায় করেছে? যার একটি জুমাও ক্বাযা হয় নাই? তাহলে ওই ছেলের সাথে রাজকন্যাকে বিবাহ দেওয়া হবে। রাজ্যে এমন কেউ থাকলে তিনি রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে রাজকন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দিতে পারেন। এভাবে সমস্ত রাজ্য ঘুরে তারা কোন পাত্রের সন্ধান পাচ্ছিল না, সবশেষ তারা চোর বেটার এলাকায় আসলো তখন এলাকার সর্ব সাধারণ শাহী অ্যালান শুনে বলতে লাগলো, এলাকায় এমন কোন ছেলে নাই তবে, একটি ছেলের সন্ধান আমরা দিতে পারি, সে আমাদের মসজিদেই পড়ে থাকে। আর নামাজ জিকির-আজগার নিয়ে ব্যস্ত থাকে, হয়তো ছেলেটি চল্লিশ জুমা আদায়কারী হতে পারে। তখনই মসজিদে গিয়ে তারা দেখে ছেলেটি আল্লাহর ধ্যানে মশগুল। তারা অপেক্ষা করলো যুবকের ধ্যান ভাঙার জন্য। ধ্যান ভাঙার পর, রাজার ঘোষণাপত্র পড়ে শুনালো। যুবক বললো, আপনারা চলে যান এবং আপনাদের মালিকের গোলামী করেন গিয়ে। আর আমাকে আমার মালিকের গোলামী করতে দেন। আমার কোন রাজকন্যা দরকার নেই। এ কথা বলে যুবক তাদেরকে বিদায় করে দিলো। রাজ দরবারে গিয়ে তারা সব কথা রাজাকে বললো। রাজা শুনে আরো খুশি হয়ে বললেন, এমন ছেলেই তো আমার দরকার। তোমরা যে কোন মূল্যে ছেলেটিকে হাজির করো। নইলে তোমাদের কারো চাকরি থাকবে না। পুনরায় তারা যুবকের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে বললো, আপনি যদি রাজ দরবারে না যান তাহলে আমাদের চাকরি থাকবে না। দয়া করে আপনি রাজার সাথে দেখা করেই চলে আসুন। যুবক তাদের অনুরোধে যেতে বাধ্য হলো। রাজ দরবারে গিয়ে প্রথমেই অত্যন্ত আদবের সাথে রাজাকে সালাম দিলেন, তার আদব-ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে মুগ্ধ হলেন। এবার রাজা বলতে শুরু করলেন, ‘বাবা, আমার একমাত্র কন্যা, সে কোন রাজা-বাদশাহর ছেলেকে চায় না। সে আমাকে অনুরোধ করেছে, যে একাধারে চল্লিশ জুমা নামাজ আদায় করেছে একটি জুমাও ক্বাযা হয় নাই এমন পাত্রকেই সে বিয়ে করবে। আমি শুনেছি তোমার চল্লিশ জুমার অধিক নামাজ আদায় হয়েছে, তাই তোমার সাথে আমার একমাত্র কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করলাম। রাজার কথা শুনে যুবক বললো, হুজুর আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। রাজা বললেন, বলো বাবা। যুবক, হুজুর আপনি যদি আমার আসল পরিচয় জানেন তাহলে আপনার মেে তো দূরের কথা চাকরানীকেও আমার সাথে বিয়ে দিবেন না। আমি এক রাতে আপনার বাড়িতে চুরি করতে এসে গোপনে শুনলাম, আপনি মেয়ের সাথে এ বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছেন। এবং ওই দিন থেকেই আমি নামাজ পড়া শুরু করি। হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন চল্লিশটি জুমার বিনিময়ে যদি রাজার মেয়েকে বিয়ে করা যায়, তাহলে আরও চল্লিশটি জুমার নামাজ আদায় করলে জান্নাতের হুর পাওয়া যাবে। দয়া করে আমাকে মাফ করবেন। আপনি অন্য কোথাও আপনার মেয়েকে বিবাহ দেন। আল্লাহর কি মেহেরবানি ছেলেটি নামাজ-জিকির ও ধ্যান করে করে খাঁটি ঈমানদার হয়ে আল্লাহর অলিত্ব লাভ করলো। অথচ একদিন যে ব্যক্তি রাজকন্যাকে পাওয়ার লোভে নামাজ ধরেছিল, আজ নামাজ-ই তাকে সেই রাজকন্যা ও রাজ্যের লোভ থেকে ফিরিয়ে আনলো আল্লাহর প্রেমিক করে। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করলে কি না পারেন। এ দুনিয়ায় ভোগ-বিলাসীতার ব্যাপক বিস্তার তবুও তা ক্ষণিকের, এই সামান্য সময়ের মধ্যে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকার কারণে, যদি মৃত্যুর পরে অনন্তকাল সাজা খাটতে হয় তবে, ভোগের চেয়ে সংযোম ধারণ করাই ভালো। আমার প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানও মানুষদের এমনই সহ্-িশুদ্ধভাবে হুজুরি দিলে নামাজ আদায় করার নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে থাকেন। যে নামাজে প্রকৃত শান্তি আসে। মহান আল্লাহ যেন আমাদের ঐ যুবকের মতো সহ্-িশুদ্ধ নামাজি হিসেবে কবুল করেন, আমিন।
লেখক : সম্পাদক মন্ডলির সদস্য, মাসিক আত্মার আলো ॥ চেয়ারম্যান, আল জয়নাল গ্রুপ, নারায়ণগঞ্জ ॥ বিশিষ্ট খাদেম, কুতুববাগ দরাবার শরীফ