পবিত্র কোরআনের আলোকে ওছিলা অন্বেষণ করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অপরিহার্য

আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

পবিত্র কোরআনে (সূরা: নেসা, রুকু-৫) মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়া লাউ আন্নাহুম ইজ জালামু আন ফুছাহুম জায়ুওকা ফাসতাগফারু ওয়াল্লাহা ওয়াসতাগফারা ওয়ালাহুমুর রাসূলু লাওয়াজাদু ওয়াল্লাহা তাওয়াবার রাহিমা’।
অর্থ- যদি এ সকল লোকেরা নিজেদের আত্মাসমূহের উপর অত্যাচার করে, হে হাবিব (সঃ) আপনার দরবারে এসে হাজির হয়ে যায় এবং আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ইয়া রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাদের পক্ষে আপনি সুপারিশ করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে এরা আমি আল্লাহতায়ালাকে তওবা কবুলকারী মেহেরবান ও ক্ষমাকারী হিসেবে পাবে।
এই আয়াত কারীমা দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেল রাসুল (সঃ) প্রত্যেক গুনাহ্গারের জন্য সব সময় মাগফেরাতের ওছিল।
(সূরা মায়েদা রুকু-৬) ‘ইয়া আইয়ূ হাল লাযিনা আমানু তাকুল্লাহা ওয়াবতাগু ইলাহিল অসিলাতা ওয়া জাহিদু ফি সাবিলিহি লায়াল্লাকুম তুফলিহোন’। অর্থ: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহতায়ালাকে ভয় করার মত ভয় কর, আমি আল্লাহকে পাইবার রাস্তায় ওছিলা অন্বেষণ কর বা তালাশ কর এবং আমার পথে কঠোর রিয়াজত সাধনা কর ও তোমার নফসের সাথে জিহাদে আকবর কর, আমি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করব। এই আয়াত থেকে প্রমাণ হয়, আমলের সঙ্গে সঙ্গে বান্দাদের ওছিলা ধরা অপরিহার্য। হে রাসুল (সঃ) এ সব মুসলমানদের সম্পদের সদকা গ্রহণ করুন এবং তা দ্বারা আপনি তাদেরকে পাকপবিত্র ও পরিছন্ন করবেন আর তাদের জন্য মঙ্গল কামনা করুন। আপনার দোয়া হচ্ছে তাদের অন্তরের প্রশান্তি (সূরা-তওবা রুকু-১১)। এ আয়াত দ্বারা প্রমান হল সদকা, মান্নত, নজরানা ও গুরুদক্ষিণা সৎকর্মসূমহ পবিত্রতার যথেষ্ট ওছিলা বা মাধ্যম। আর সে পবিত্রতা হুজুর (সঃ) এর অনুগ্রহের মাধ্যম অর্জিত হয়। মহান প্রতিপালক নিরক্ষরদের মধ্যে রাসুল প্রেরণ করেছেন। রাসুল (সঃ) তাদের উপর পরওয়ারদিগারের আয়াতসূমহ তেলাওয়াত করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন। আর তাদেরকে কিতাব কোরআন ও হিকমত শিক্ষা দেন । (সূরা জুমা, ২৮-পারা) এই আয়াত থেকে প্রমাণ হল হুজুর (সঃ) পাপীদের পাক পবিত্র করেন । তিনি হচ্ছেন আল্লাহতায়ালার নিয়ামতসমূহের মাধ্যম বা ওছিলা । ‘ফাতালাক্কা আদামু মির রাব্বিহি কালিমাতিন ফাতাবা আলাইহি’।

অর্থ: হযরত আদম (আঃ) স্বীয় পরওয়ারদিগারের পক্ষ থেকে কলেমা প্রার্থনা বাক্য পেয়েছেন, যেগুলো ওছিলা নিয়ে দোয়া করেছেন এবং আল্লাহতায়ালা তাঁর তওবা কবুল করেছেন। (সুরা বাকারা রুকু-৬)
অনেক নির্ভযোগ্য মশহুর তাফসিরে উল্লেখ আছে, হযরত আদম (আঃ) হুজুর (আঃ)-এর নামের ওছিলা দিয়ে দোয়া করেছেন যা কবুল হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, হুজুর (সঃ) সম্মানিত নবী রাসুলগণের ওছিলা। যেমন তাফসিরে রুহুলবায়ানে আছে, যখন আদম (আঃ) ভুল করে বসলেন। তখন তিনি বললেন, ‘ওহে আমার আল্লাহ! মুহাম্মদ (সঃ)-এর খাতিরে আমাকে ক্ষমা করুন’। আল্লাহ বললেন আমি মুহাম্মদ (সঃ)-কে এখনও প্রকাশ করি নাই। তুমি কীভাবে তাঁকে চিনিলে? আদম (আঃ) বললেন, ওহে আমার রব (আল্লাহ), আপনি আমাকে সৃষ্টি করলেন এবং আপনার আত্মা আমার মধ্যে দান করেছেন, তখন আরশের প্রান্তে লিখিত এই বাক্য আমি দেখেছিলাম ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। আপনার প্রিয় হাবিবের নাম আপনার নামের পাশে লিখেছেন। এ বিবেচনাপূর্বক আমি বুঝেছি যে, আপনি তাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। এরপর আল্লাহ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওহে আদম, তুমি সত্য বলেছো, আমার সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র তাঁকেই আমি অত্যন্ত ভালোবাসি সুতরাং তাঁর খাতিরে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম’। ইমাম আল বাই হাকি দালায়ে ও আলসীর জালিয়্যায়, এ হাদিসখানা উদ্ধৃত আছে। সুন্নি দর্শন ১০৮-১০৯ পৃষ্ঠা, প্রণেতা হুসাইন হিলমি ইসিফ। ‘ইজহাব বিকামিছি হাজা ফায়াল কুহু আলা ওয়াজহি আবি ইয়াতি বাসিরা’। অর্থ: হযরত ইউসুফ (আঃ) আপন ভাইদেরকে বললেন, আমার জামা নিয়ে যাও এবং আমার সম্মানিত পিতার চেহারার (মুখম-লে) উপর রেখে দাও, তাহলে চক্ষুদ্বয় দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়া পাইবেন। (সূরা, ইউসুফ)। ‘আন্নি আখলুক লাকুম মিনাত তিনা কাহাইয়াতিত তাইরে ফায়ানফাকু ফিহি ফায়ানকুন তাইরান বিইযনি আল্লাহ’। অর্থ: হযরত ঈসা (আঃ) এরশাদ করেনÑ ‘আমি মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি তৈরি করি, তারপর তন্মধ্যে ফুৎকার করি, যা দ্বারা সেটা পরওয়ারদিগারের হুকুমে পাখি হয়ে যায়’ (সূরা আল-ইমরান)। এই আয়াত দুটি দ্বারা প্রমাণ হয়, বুজুর্গর ফুঁকের ওছিলায় মাটির মধ্যে প্রাণ এসে যায়। রোগাক্রান্ত আরোগ্য লাভ করে। হে নবী, নিশ্চয় যারা আপনার নিকট বাইয়াত পড়েছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হাতেই বাইয়াত পড়েছেন, আল্লাহপাকের মহান ও শক্তিশালী হাত সকল হাতের উপর রহিয়াছে। যে ব্যক্তি বাইয়াত বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, সে স্বীয় ক্ষতির জন্যেই তা করে । যে ব্যক্তি আল্লাহর সহিত কৃত বাইয়াত পালন করে, সে অতি সত্ত্বরই তার অফুরন্ত পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে’ (সূরা ফাতাহ)। নবীজি (সঃ)-এর পরে নায়েবে নবী পীর-মোজাদ্দেদগণের স্বীয় মুরিদগণের বাইয়াত করানোর প্রমাণ হচ্ছে, উক্ত আয়াতে কারীমা।

তাফসীরে রুহুল বায়ানে উল্লেখ আছে, কামেলপীর বা মুর্শিদ আল্লাহকে পাওয়ার ওছিলা। উক্ত তাফসির ১/৫৬০ পৃষ্ঠায় লেখা আছেÑ ওছিলা ছাড়া আল্লাহর নৈকট্যলাভ করা যাবে না। নায়েবে রাসুলগণ বা হক্কানী কামেল মুর্শিদগণ হচ্ছেন এই ওছিলা’ (সুরা মায়েদা রুকু-৬)।
‘ইয়া আইয়ূ হাল লাযিনা আমানু তাকুল্লাহা ওয়াবতাগু ইলাহিল ওছিলাতা ওয়া জাহিদু ফি সাবিলিহি লায়াল্লাকুম তুফলিহোন’। অর্থ: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহতায়ালাকে ভয় করার মত ভয় কর, আমি আল্লাহতায়ালাকে পাইবার রাস্তায় ওছিলা অন্বেষণ কর বা তালাশ কর এবং আমার পথে কঠোর রিয়াজত সাধনা কর ও তোমার নফসের সাথে জিহাদে আকবর কর, আমি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করব’। আরেফে কামেল শায়েখ ইসমাইল হাক্কি (রঃ) তাফসিরে বলেনÑ অর্থাৎ এ পবিত্র আয়াতে ওছিলা গ্রহণ করার জন্যে পরিস্কারভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং এটা অত্যন্ত জরুরী । যে সমস্ত লোক মুরিদ হয়নি, তাদের কামেল মুর্শিদের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। আর যদি তার কামেল মুর্শিদ না থাকে, তবে কখনো মঙ্গল লাভ করিতে পারবে না। হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (রঃ) বলেনÑ ‘মান লাইসা লহুস শাইখূন ফা শাইখুহুস শাইত্বান’। অর্থ: যার পীর নাই, তার পীর হচ্ছে শয়তান’।

আরেফে কামেল শায়েখ ইসমাইল হাক্কি (রঃ) কোরআন মজিদের আয়াতে নিম্নরূুপ মত প্রকাশ করেছেন, ‘আত্বীউল্লাহা ওয়া আত্বীউ’র-রাসুলা ওয়া উলীল আম্রি মিনকুম’। অর্থ: আল্লাহর আদেশ পালন কর, রাসুল (সঃ) আদেশ পালন কর এবং সাহেবে দাওয়াত বা কামেল মুর্শিদের আদেশ পালন কর‘ (সূরা: নিসা, আয়াত-৫৯)।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, অত:পর জেনে রাখুন যে, ‘উলিল আমর’-এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, কামেল পীরআনা পীরগণ আল্লাহতায়ালার এলহামপ্রাপ্ত। অতএব মুরিদের উচিত যে, আল্লাহর তরফ হইতে তার আমল ও অবস্থা সম্বন্ধীয় যা কিছু এলহাম, ইঙ্গিত বা ইশারা তার কলবের মধ্যে উদয় হয়, তাকে যেন পীরের দৃষ্টির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেয়। পীর যদি তাকে তার জন্য মঙ্গলদায়ক আদেশ দেন, তাহলে আজ্ঞাবর্তী হওয়া উচিৎ, আর যদি তার জন্য ক্ষতিকারক মনে করে নিষেধ করেন, তাহলে তা হতে বিরত থাকা উচিৎ। মোজাদ্দেদ বা কামেল মুর্শিদগণ ধর্ম-জগতের হেদায়েতের বাণী প্রচার করেন, তা মান্য করা অপরিহার্য কর্তব্য। ‘ওয়া মিম্মান খালক্বনা- উম্মাতাই ইয়াহ্দুনা বিল্হাক্বক্বি ওয়া বিহী ইয়া’দিলূন’। অর্থ: এবং আমার সৃষ্টির মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় আছে যারা সৎ পথ প্রর্দশন করে থাকেন’ (সূরা: আরাফ, পারা-৯, আয়াত-১৮১)।

কাজেই যুগে যুগে মোজাদ্দেদ, কামেল পীর-মুর্শিদগণ এ ধরাধামে এসে আল্লাহকে ভোলা মানুষদেরকে আল্লাহতায়ালার সরল পথ দেখাইয়া থাকেন। সুতরাং তাঁদের আদেশ মানতে হবে, তাঁদের অনুসরণ করতে হবে নইলে হেদায়েত পাবে না। সুতরাং তারাও ধর্ম প্রচারক হিসাবে ‘উলিল আমর’ । দ্বীনের মোজাদ্দেদের হেদায়েত সাফল্যম-িত করতে হলে, তাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা একান্ত অপরিহার্য কর্তব্য। কোরআনে সূরা তওবা ১১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর সদাসর্বদা সত্যবাদীদের সঙ্গি হয়ে যাও’।এই আয়াতে পীরে কামেল মুর্শিদে মোকাম্মেলদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার হুকুম রয়েছে। (আলকাওলুলজামীল: খোদা প্রাপ্তির তৃতীয় তরিকা) সিদ্দিক ব্যক্তি বলতে ‘পীরে কামেল’ সত্যবাদীকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, তাঁরা আল্লাহতায়ালার এলহামপ্রাপ্ত মহাপুরুষ।

(Visited 2,132 times, 1 visits today)
Share