জ্ঞান অর্জনের জন্য কামেল মুর্শিদই যথেষ্ট

আবুল খায়ের অনিক

কেউ যদি বাশের বাঁশি বাজায়, তবে তোমরা মন দিয়ে শোন, সে কী বলে। সে তার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হয়ে কান্না করছে। এই কান্না দেখার কোন চোখ নেই, শুনবার কান নেই। এটা শুধু অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায়। যার অনুভূতি শক্তি যত প্রখর, সে তত বেশি এই ব্যথা অনুভব করতে পারবে। কেননা ভুক্তভোগীর জানা আছে, জগতে জ্ঞানের চেয়ে পবিত্র কিছু নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘এক রাতে ৮-১০ জন জেলে নদীতে যায় মাছ ধরতে। রাতভর বিপুল পরিমাণ মাছ পায়, যা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই অধিক পরিমান মাছ পেয়ে তারা অহংকার করে বললো, এ সবই আমরা করেছি এখানে আল্লাহর কোন প্রকারের অনুগ্রহ খুঁজে পাইনি। অত:পর তারা সকালে ঘাটে গিয়ে নৌকার পাটাতনের ঝাপ খুলে দেখে, যেখানে মাছ রাখা ছিল সে জায়গা কাদায় বোঝাই হয়ে আছে’। এ ঘটনার দ্বারা বোঝা গেল যে, নিশ্চয়ই অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। যারা দাম্ভিকতার পথ অনুসরণ করেছে, তাদের সৎ পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আত্মার চিকিৎসা প্রয়োজন। এই ধরণের গোমরাহ্ লোকের চিকিৎসা কামেল আউলিয়াগণ ছাড়া কেউ করতে পারেন না। যার অন্তর জ্ঞানের জন্য জ্বলে ওঠে না, যে ব্যক্তি সত্য জ্ঞানকে বোঝার চেষ্টা করে না, তার আত্মা চতুষ্পদ প্রাণির আত্মা ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহতায়া’লা তাঁর বন্ধু কামেল অলিগণের কাছে এমন বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা দান করেছেন, যা অন্য কাউকেই দান করেননি। যদি কেউ একজন প্রকৃত খোদাপ্রেমিকের সাহচর্যে থাকে, তবে তার অন্তরও খোদার প্রেমে সদা জাগ্রত হয়। যারা আল্লাহকে দেখার চেষ্টা করে, তারাই প্রকৃত খোদাপ্রেমিক। কামেল পীর-মুর্শিদের সাহচর্যে থাকলে মানুষের পাথরের মত মন মাটি হয়ে যায়। কেননা তাঁর কাছে রয়েছে মৃত ৩-এর পাতায় দেখুন

আত্মাকে জাগ্রত করার ঔষধ, তার অন্তর আল্লাহর মহব্বতে পূর্ণ হয়েছে। তিনিই বুঝতে পারেন খোদাপ্রেমের স্বাদ। যে শুধু ঔষধের পর ঔষধ (না বুঝে বই-কিতাব মুখস্থ করা) খেয়ে নিজের অবস্থা দুর্বল করেছে, তার চিকিৎসা করা সহজ নয়। যার মধ্যে খোদাপ্রেম উদয় হয়নি, সে কখনো আত্মশুদ্ধির পথ পাবে না। শয়তান তাকে সান্ত¡না দিবে, এমন সান্ত¡না চলতেই থাকবে। কেননা সে শয়তানের অনুসারিদের পথে চলছে, যতদিন তার মধ্যে বোধ (হেকমত) উদয় না হয়, ততদিন এমনই চলতে থাকবে। এমন লোকের পরিণতি কেবল কামেল গুরু বা পীর-মুর্শিদগণ বলতে পারেন যে, ডানাবিহীন পাখির মত নি:স্ব হয়ে থাকবে, এদের অন্তরাত্মা শুদ্ধতার পথে আসবে না। কেননা তারা ‘গুরু’ শিক্ষার অভাবে অন্তরাত্মা বা কাল্ব আল্লাহর জিকিরে জাগ্রত করার চেষ্টাও করেনি। আল্লাহতায়া’লা পবিত্র কোরআনে বলেন, তিনি আপনার (রাসুল) প্রতি কিতাব নাজিল করেছেন, তাতে কিছু আয়াত সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ আর অন্যগুলো রূপক। সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না, যাঁরা জ্ঞানে সুগভীর, তাঁরা বলেনÑ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এ সবই আমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, আর বোধসম্পন্ন ছাড়া অপর কেউ এই শিক্ষা গ্রহণ করে না। (আল ইমরান, আয়াত-৭)। এখন প্রশ্ন হলো, এই রূপক অংশের ব্যাখ্যা কারো জানা আছে? নাকি আল্লাহতায়া’লা গোপন রেখেছেন? অপর এক আয়াতে আল্লাহতায়া’লা এই গোপন জ্ঞান অর্জনকারীর পরিচয় বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয়ই যারা জ্ঞানী, তাদের জন্য আমি নির্দেশনাবলি বিস্তারিত বর্ণনা করেছি’। (সুরা আন-আম, আয়াত-৯৭), অতএব, প্রকৃত এই জ্ঞান আল্লাহর মনোনীত আউলিয়াগণই প্রাপ্ত হন। তাই তাঁরা আল্লাহর নির্দেশেই মানুষকে দয়াল নবী (সঃ)-এর সত্য তরিকায় আহ্বান করেন। কামেল গুরুগণ ধর্মের রহস্য এবং ভেদ জানেন এবং তা ধীরে ধীরে ভক্ত-আশেকান-জাকেরানদের কাছে প্রকাশ করেন।

আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ যেন এ জগতের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে, আল্লাহর মহব্বত ভুলে না যায়, সে জন্য নবী-রাসুল ও আউলিয়াদের প্রেরণ করা হয়। তাঁদের কাজ আল্লাহভোলা মানুষদের আল্লাহর প্রেমের সত্য আলো এবং আল্লাহর প্রতি আসক্ত হওয়ার শিক্ষা দান করা। মানুষ যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ বলে না ডাকে। বর্তমানে পূর্ণ শরিয়ত ও পূর্ণ মারেফতের অমূল্য জ্ঞানের ভা-ার কারা? অবশ্যই কামেল পীর-আউলিয়াগণ। তাঁরা নি:স্বার্থে মানুষকে সুপথে সত্যের জ্ঞান বিলিয়ে থাকেন। সেই জ্ঞান অর্জন করতে হলে, সত্য তরিকার বাইয়াত গ্রহণ করা প্রয়োজন। যখন আপনি মুরিদ বা শিষ্য হবেন, তখন আপনার কাজ হলো ভক্তির সঙ্গে মুর্শিদকে অনুসরণ করা। এর পরপরই শুরু হয় গুরুশিক্ষার পর্ব। আল্লাহতায়া’লা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেন, ‘আল্লাহ-নূরছ ছামাওয়াতে ওয়াল আ’রদে’। অর্থাৎ, আল্লাহতায়া’লা আসমান ও জমিনে আলো স্বরূপ’। এই আলো সূর্যের আলোর চেয়ে পৃথক, সূর্যের আলোতে দাঁড়ালে জমিনে ছায়া দেখা যায়। কিন্তু আল্লাহর হাকীকি আলোতে কোন ছায়া দেখা যায় না। আল্লাহতায়া’লা এ আলো মোমিন বান্দার অন্তরে আপন মহিমায় দান করে থাকেন। যদিও দিনের আলো অস্ত যায়, কিন্তু এ আলো কোনদিনও ম্লান হয় না। এ আলোপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণই মানুষকে ভালো এবং সৎ পথে ডাকেন। কামেল গুরুর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করলে, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহ থেকে নফ্সকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব। কামেল গুরু পারেন মানুষকে যার যার অন্তর অনুযায়ি শিক্ষা দিতে, যাতে আত্মার পবিত্রতা অর্জন হয়। মানুষের আত্মা আল্লাহর নূরে আলোকিত হলে, তার কাছে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণ হতে থাকে। সে তখন আল্লাহর মহব্বতে পূর্ণ হয়। এখন প্রশ্ন, কীভাবে গুরুকে চিনবো? চেনা খুবই সহজ, কেননা কামেল পীর-মুর্শিদগণ যা শিক্ষা দেন, সে শিক্ষা অনুযায়ি মুরিদ চলে। তাদের সাথে চলাফেরা ও কথা-বার্তার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তার দীক্ষাগুরুর জ্ঞানের গভীরতা ও জ্ঞানদানের স্বচ্ছতা সম্পর্কে। মুরিদ যদি জ্ঞানী হন, তবে তাঁর মুর্শিদও জ্ঞানী। কেননা পীর ও মুরিদ একে অপরের আয়না স্বরূপ। যাঁরা জামানার হাদি ও সংস্কারক শ্রেণির বুজুর্গ-অলি, তাঁদের কাছে গেলে আত্মিক শান্তি মিলে এবং মনের শত জ্বালা-যন্ত্রণা, বাজে চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া যায়।

বাবাজানের প্রকৃত বিনয়ী আর মানুষের মত মানুষ হওয়ার যে শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের মুগ্ধ করে। তাঁর চিন্তা-ভাবনা মানবিক এবং অতি সূক্ষ, যা আমাদের মতো আশেক-জাকের মুরিদের এবং সাধারণ মানুষের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর। বাবাজান, রাসুল (সঃ)-এর সত্য তরিকার হুকুম আহ্কাম পালনের ভিতর দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের পথ প্রদর্শন করেন। ফলে তরিকতের একজন নতুন মুরিদও তরিকার জ্ঞান অর্জন ও প্রচারে পিছিয়ে পড়ছে না। বহুকাল থেকেই মানুষ আল্লাহর অলি-বন্ধুদের দরবারে যাওয়া-আসা করছে। তরিকতের শিক্ষা গ্রহণ করে, আল্লাহর জিকির অন্তরে নিয়ে জীবনের শেষ নি:শ্বাস ঈমানের সাথে ত্যাগ করছে। রাসুল (সঃ)-এর দরবারে সাহাবিগণ যেতেন মারেফতের জ্ঞান লাভের জন্য। রাসুলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবিদের অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সাথে, বছরের পর বছর মারেফতের শিক্ষা দিয়েছেন। এলমে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত, এ চার বিষয়ের উপর আমাদের মুর্শিদকেবলা প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ‘গুরুরাত্রি’তে অসংখ্য আশেকান, জাকেরান ও মুরিদান ভাই-বোনদের তরিকতের তালকিন বা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। যারা নিয়মিত গুরু-রাত্রিতে দরবার শরীফে উপস্থিত হতে পারছেন, তারা অবশ্যই কম-বেশি উপলদ্ধি করছেন নিজেদের আত্মার পরিবর্তন সম্পর্কে। তাই শুধু স্কুল, কলেজে পড়ে নয়, বই-কিতাবের পাতায় নয়, একজন মানুষ সুশিক্ষিত হয় কামেলপীর-বুজুর্গদের মাত্র একটি নেক নজরে। আল্লাহতায়া’লা যেন আমাদের সরল পথে চলার তাওফিক দান করেন। আমিন।

(Visited 573 times, 1 visits today)
Share