কোরআন ও হাদিসের আলোকে সূফীবাদের শিক্ষা

বাদল চৌধুরী

সূফীবাদের শিক্ষা নতুন কোন বিষয় নয়, এ শিক্ষা সৃষ্টিলগ্ন থেকেই চলমান। যে শিক্ষার মাধ্যমে আত্মাকে চেনা ও জানা যায় তা-ই সূফীবাদ। আর দেহের ভিতর এবং বাহিরকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে, এ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। বিশ্ববিখ্যাত তাপস জুন্নুন মিসরি বলেছেন, ‘জাগতিক লোভ-লালসার উর্ধ্বে থেকে যিনি আল্লাহর আরাধনা-উপাসনাকে জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন তিনিই সূফী’। এ প্রসঙ্গে আরো এক প্রখ্যাত তাপস বশর হাফি বলেন, ‘আল্লাহর জিকির দ্বারা যিনি আত্মাকে পূত-পবিত্র রাখতে পেরেছেন তিনিই সূফী’। আমার প্রাণপ্রিয় দরদী পীর-মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান বলেন, ‘আল্লাহ ও রসুল (সঃ)-এর প্রেমে মজে জাগতিক সকল মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে, মহান আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা এবং দয়াল নবীজির আদর্শে জীবন পরিচালিত করার একমাত্র অভিষ্ঠ লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছেন তিনিই সূফী-সাধক’। এঁরা কঠোর রিয়াজত-সাধনা ও প্রেম-ভক্তির মাধ্যমেই আল্লাহ প্রাপ্তির পথ সহজ করেছেন। সূফীবাদ বিকাশের পথ পরিক্রমায় রসুল (সঃ) ছিলেন অগ্রপথিক। সূফীদের শাজরানামায় রসুল (সঃ)-এর নামটি প্রথম সূফী-সাধক বা তাসাউফ শিক্ষা গুরু হিসাবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। সমাজ ও মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলামের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সূফীবাদের উন্মেষ ঘটেছে ওৎপ্রোতভাবে। ইসলাম ও সূফীবাদ হচ্ছে দেহের সঙ্গে আত্মার সম্পৃক্তার মতোই। সূফীবাদ ইসলামের নিজস্ব সম্পদ এবং ইসলামী শরিয়তের আওতায় উদ্ভাসিত, যা যুগে যুগে উন্নতির শিখরে আহরণ করে ইসলাম ধর্মকে সারাবিশ্বের কাছে অনুকরণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে রহস্যাবৃতভাবে সূফীবাদের বীজ নিহিত রয়েছে। তাসাউফ তথা দার্শনিক চিন্তাধারার ইঙ্গিতও রয়েছে। আর পবিত্র কোরআনের তাত্বিক দিক নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করার নির্দেশ কোরআন মজিদেই রয়েছে। এছাড়াও দয়াল নবীজির পবিত্র জবান নিসৃত অনেক মূল্যবান বাণী বিভিন্ন হাদিসে রয়েছে, যেখানে সূফীবাদের মূল কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। সূফীবাদের ক্রমবিকাশ সাধিত হয়েছে পর্যাক্রমে, মদিনার মসজিদে নববীতে একদিন হযরত আলী (রাঃ) সূফীবাদ বা তাসাউফ বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় কতিপয় সাহাবি বিরুপ মন্তব্য করলে হযরত আলী (রাঃ) রাগত স্বরে বললেন, ‘তোমরা চুপ থাকো, আমি ও খাদিজা ব্যতীত আর কোন সাহাবি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রসুল (সঃ)-কে দেখেনি’। হযরত আলী (রাঃ)-এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম প্রকাশের পূর্বেও রসুল (সঃ) সূফীবাদ বা তাসাউফ সাধনা করতেন এবং সাধনারত অবস্থায়-ই পবিত্র কোরআন মজিদ নাজিল হয়।

রসুল (সঃ) যে এলেম শিক্ষা দিয়েছিলন তা ছিলো মূলত দুই ধরণের, এলমে শরিয়ত ও এলমে মারেফত। আর এই দু’টি এলেমের সর্বোত্তম সমন্বয়ে ইসলাম সুপ্রষ্ঠিত হয়েছিলো। শরিয়ত ও মারেফতের সমন্বয়ে নিজের জীবন পরিচলিত করে রসুল (সঃ) তা উম্মতের জন্য মহান আদর্শ নির্ধারণ করে গেছেন। পবিত্র কোরআন নাজিলের শুরু থেকেই সূফীবাদ বা তাসাউফ তত্ব মহান আল্লাহর নিকট হতে রসুল (সঃ)-এর নিকট আসতে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রসুল (সঃ) এসবের ব্যাখ্যা করেছেন। মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘তোমাদের জন্য শরিয়ত এবং মিনহাজ দিয়েছি’। সুতরাং আল্লাহতায়ালা দু’টি বিধান রসুল (সঃ)-এর মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে দান করেছিলেন। প্রথমত: শরিয়ত হলো জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের নিয়ম-নীতি। যা রসুল (সঃ) সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাঁদের মাধ্যমে আমাদের কাছে পর্যায়ক্রমে এসেছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। যেমন-বাহ্যিক চালচলন, আচার-আচরণ, কাজ-কর্ম, এবাদত-বন্দেগী, পরিবার-সংসার, সমাজ-সংস্কৃতি, রাষ্ট-অর্থনীতি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: মিনহাজ, এর আভিধানিক অর্থ হলো, খাস পথ, সরল পথ, সহজ পথ, আসল পথ, গোপন পথ। আর মহাত্মাগণ মিনহাজকেই তাসাওফ বা সূফীবাদ বলে নির্দেশ করেছেন। মহান আল্লাহ কোরআনে আরো বলেন, ‘আজ তোমাদের দ্বীনকে আরো পরিপূর্ণ করে দিলাম’।

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, ‘এমন একটা গোপন বিদ্যা রয়েছে যা ঝিনুকের অভ্যন্তরস্থ গুপ্ত মনির ন্যায় সুপ্ত অবস্থায় আছে। এ জ্ঞান সম্পর্কে আল্লাহর অলিগণই অবগত’ (হাদিস)। ‘নিশ্চই বাতেন এলেম আমার একটা গোপন রহস্য যা আমি আমার বিশেষ বান্দাদের অন্তকরণে উদয় করি। আমি ছাড়া আর কেউ এ গোপন তত্ত্বজ্ঞান অবগত নয়’ (হাদিসে কুদসি)। অপর দিকে রসুল (সঃ) আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজ্জের ভাষণে এক লক্ষ বিশ হাজার মানুষকে সাক্ষ্য রেখে তিনবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কি আল্লাহর বাণী যথাযথভাবে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি? উপস্থিত সকলে একবাক্যে তিনবার জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। তাহলে এ থেকেও প্রমাণিত হয়, রসুল (সঃ) শরিয়তের পাশাপাশি মিনহাজ তথা তাসাওফ বা সূফীবাদ সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে রসুল (সঃ) সাধারণ সাহাবিদের কাছে তাসাওফের দর্শনতত্ব প্রকাশ করেন নাই। দয়াল নবীজি দিব্য দৃষ্টিতে যার ধারণ ক্ষমতা আছে বলে মনে করেছেন বা দেখেছেন, এমন কিছু সংখ্যক সাহাবিকে মিনহাজের জ্ঞান দান করেছিলেন। শরিয়ত ও মিনহাজ উভয় প্রকার জ্ঞান শুধু দানই নয়, নির্দেশও দিয়ছেন যেন তাঁরা রসুল (সঃ)-এর অনুপস্থিতে এ শিক্ষাদ্বয় অনুপস্থিতগণের কাছে পৌঁছায়। আর অনুপস্থিতগণের কাছে শিক্ষাদ্বয় পৌঁছানো একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।

রসুল (সঃ) যাঁদেরকে বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন তাঁরা ঘর-বাড়ির মায়া প্রায় ত্যাগ করে মসজিদে নববীর বারান্দায় বসে থাকতেন, কারো মতে এঁদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪৭০ (চার’শ সত্তর) জন এবং এসব বিশেষ সাহাবিকে আহলে সূফফা বলা হতো। আহলে বা আসহাবে সুফফাগণ সরাসরি রসুল (সঃ)-এর কাছ থেকে এলমে তাসাওফ বা সূফীবাদের শিক্ষা গ্রহণের মহতী সুযোগ পেয়েছিলেন। এ সূফীসাধকগণ আল্লাহ ও রসুল (সঃ)-এর প্রেমে মত্ত হয়ে বেশিরভাগ সয়য় মোরাকাবা-মোশাহেদা-ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থাকতেন। সূফী-সাধকগণ মোটামোটি দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। এক শ্রেণি ছিলেন যাঁরা তাসাওফ শিক্ষার মাধ্যমে আত্মোন্নতি সাধন করেছিলেন, এঁরা শুধু সাধক ছিলেন। অপর শ্রেণি সাধনার মাধ্যমে আত্মোন্নতি করে তাসাওফ বা সূফীবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন, এঁরা ছিলেন সাধক ও প্রচারক। শুধু আহলে সূফফাগণ নয়, রসুল (সঃ) নিজেও তাসাওফ বা সূফীবাদের চর্চা করতেন। রসুল (সঃ) চিরদিনই আড়ম্ভরহীনতা পছন্দ করতেন। অল্প খাদ্য, অল্প নিন্দ্রা, অল্প কথা বলা নবীজির অভ্যাস ছিলো। অধিক পরিমানে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকতেন। দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যান-মোরাকাবা-মোশাহেদা করতেন। মিরাজের পবিত্র রজনীতে আল্লাহতায়ালা তিরিশ হাজার একান্ত গোপন এলেম রসুল (সঃ)-এর পবিত্র কলবে আমানত রাখেন। এ গুপ্ত এলেম থেকে আহলে সূফফাগণ ও অত্যাধিক প্রিয় কয়েকজন সাহাবিকে কিছু পরিমানে দান করেছিলেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ওফাতের পর কিছু কিছু আহলে সূফফা এবং বিশেষ কিছু সাহাবি কর্তৃক তাসাওফ বা সূফীবাদের প্রচার-প্রসার শুরু হয়। আহলে সূফফার সদস্যগণের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েজন দয়াল নবীজির ওফাতের পর তাসাওফ বা সুফীবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দানে ব্রত ছিলেন। এঁদের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত সালমান ফারসি (রাঃ), হযরত আবু জর গিফারি (রাঃ), হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ), হযরত আবু আইউব আনসারী (রাঃ), হযরত মিকদাদ (রাঃ), হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ), হযরত মায়াদ (রাঃ)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে সর্ব প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি হিজরতের ঝুকিপূর্ণ যাত্রায় রসুল (সঃ)-এর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে সার্বক্ষণিক সঙ্গে ছিলেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য, তাঁর সকল ধন-সম্পদ রসুল (সঃ)-এর পদমূলে ঢেলে দিয়েছিলেন। এছাড়াও উম্মুল মোমেনিন হযরত মা আয়েশা (রাঃ)-এর পিতা হিসেবেও দয়াল নবীজির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিলো। ফলে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাসাওফ বা সূফীবাদের জ্ঞান রসুল (সঃ)-এর নিকট থেকে সরাসরি লাভ করেছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর হাত ধরেই নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচার শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টির কুল কায়েনাতের মূল উৎস দো’জাহানের নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে অসংখ্য ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া বা বেলায়েতে মাশায়েখগণ আগমন করেছেন এবং করতে থাকবেন। বর্তমান বিশ্বের পাপী-তাপী-গুনাহগার ও পথভ্রষ্ট মানুষেদের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সঠিক পথের সন্ধান দিতে সূফীবাদের শিক্ষক হিসেবে শুভাগমন করেন আমাদের প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ আরেফে কামেল, মুর্শিদে মোকাম্মেল, যুগের শ্রেষ্ঠতম সাধক, হেদায়েতের হাদী নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার বর্তমানে একমাত্র খেলাফতপ্রাপ্ত পীর-মুর্শিদ খাজাবাবা আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী কেবলাজান হুজুর। তিনি কুতুববাগ দরবার শরীফের সদর দপ্তর ৩৪ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা থেকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষ সকলকে আত্মশুদ্ধির দীক্ষা দেন। দয়াল নবীজির সত্য তরিকায় শামিল হতে সকলকে আহবান জানাচ্ছি।

লেখক : খাদেম, কুতুববাগ দরবার শরীফ
সভাপতি, পদক্ষেপ বাংলাদেশ

(Visited 1,286 times, 1 visits today)
Share