তাসাউফ ও মারেফতের জ্ঞান ছাড়া অন্তরের রোগ দূর হয় না

আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ জাকির শাহ্‌ নকশ্‌বন্দি মোজাদ্দেদি

মানুষের স্থুল দেহের রোগমুক্তি ও পুষ্টিসাধনের জন্য যেমন নানা প্রকার ওষুধ ও পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন, সে রকম পরমাত্মারও (রুহে ইনসানীরও) ওষুধ ও পুষ্টিকর খাদ্যের আবশ্যক। পরমাত্মা আজ উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, পুনরায় চেতনা ফিরে না পাওয়া বা আত্মাকে রোগমুক্ত না করার কারণে দুর্বলতায় আত্মার ক্ষুধামন্দা হয়েছে। এর ফলে ওই আত্মার কাছে ধর্মের সুমধুর বাণী শুনতে অরুচি। ধর্মের বাণী তিক্ত জ্বালাময় বোধ হয়। তাই সে ধর্মীয় কাজের বিপরীত অবস্থানে রুগ্ন ব্যক্তির মতো কুপথ্য স্বরুপ ধর্মবিরোধী গর্হিত কাজ বা বাক্য শ্রবণ করে। এখন সে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন দিন কুপথে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই এলমে তাসাউফ ছাড়া এমন আত্মাকে সুপথে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।

আত্মার এই রোগমুক্তির জন্য আল্লাহতায়া’লা সুব্যবস্থাও করেছেন। আল্লাহ বলছেন, আমি বান্দাদের মধ্যে এমন একদল লোক সৃষ্টি করেছি, যারা লোকদিগকে সৎ রাস্তা বা সরল পথ দেখিয়ে থাকে। যেমন : ‘অমিম-মান খালক্‌না উম্মাতাই ইহাহ্-দূনা বিল হাক্কি’ অর্থাৎ : আমার সৃষ্টির মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় আছে, যারা মানুষকে সৎ পথ দেখিয়ে থাকে, রাসুল করিম (স:) এ রুপ হেদায়েতকারী হাদিদের আগমনের শুভ সংবাদ দিয়েছেন। যথা : ‘ইন্নাল-লাহা আজ্বাযা ওয়া জাল্লা ইয়াব আসূ লিহা-যিহিল উম্মাতি আলা রা-আছি কুল্লি মিয়াতি মিন ছানাতি ইয়াজদাদু লা-হুমা দিনূহা’(রাওয়াহু-আবু দাউদ) অর্থাৎ : নিশ্চয় মহান আল্লাহতা’য়ালা একশ বছর পর পর তাঁর বান্দাদের জন্য, এমন এক ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেন, যিনি দ্বীনকে (ধর্মকে) তাজা (সজীব ও সতেজ) করেন। আবু দাউদ রাওয়ায়েত করেছেন রাসুলুল্লাহ (স:)-এর ভিতরে এমন এক স্বর্গীয় শক্তি নিহিত ছিল যে, তাঁকে দেখলে মানব হৃদয় সহজেই প্রেমরসে বিগলিত হয়ে যেত এবং পাপের বাসনা দূর হয়ে মুহূর্তেই মানুষ পূর্ণ ঈমানদার তথা আল্লাহর পিয়ারা বা আশেক হয়ে যেত। মোজাদ্দেদগণ রাসুলুল্লাহর সেই নিয়ামত নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। সুতরাং তিনিও মোজাদ্দেদ, তিনি যখন মানবকে আল্লাহ ও রাসুল (স:) এর বাণী শুনান তখন মানব হৃদয় প্রেমরসে গলে যায় এবং পাপের বাসনা দূর হয়ে মুর্দাদিল জিন্দা হয়; মুহূর্তেই সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার ও আল্লাহ-রাসুলের আশেক-প্রেমিক হয়ে যায়।

আবার যখন মোজাদ্দেদ পৃথিবী থেকে চলে যান তখন তাঁর অধীনস্থ আউলিয়াদের পরম্পরায় রাসুলুল্লার (স:)-এর ওই (গুণ) চলতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওই এশ্ক ও মহব্বত কমতে থাকে। মানুষ তখন আল্লাহ ও রাসুল (স:)-এর এশ্ক-মহব্বত হারিয়ে দিন দিন কুপথে ধাবিত হতে থাকে। কোরআন-হাদিসের বাণী ও ওয়াজ-নসিহত শোনে কিন্তু তা আমলের সময় আমল করে না। শুধু নফস আম্মারার বশবর্তী হয়ে নানা প্রকার পাপকাজে লিপ্ত হয়ে যায়। মোটকথা পৃথিবী যখন অনাচার অত্যাচার ব্যভিচারে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়, আল্লাহতায়া’লা দয়া করে ওই সময় দ্বীনকে তাজা বা সজীব করার জন্য, আর একজন মোজাদ্দেদ পাঠান দুনিয়ার বুকে। এইভাবে একশ বছর পর পর মোজাদ্দেদ পাঠিয়ে দ্বীনকে তাজা বা সজীব রাখবেন। রাসুল (স:)-এর পর কিয়ামত পর্যন্ত জগতে আর কোন পয়গম্বর বা নবী আসবেন না। সুতরাং মোজাদ্দেদ ও তাঁর অধীনস্থ আউলিয়াদের দ্বারাই পয়গম্বরের কাজ চলতে থাকবে।

তাসাউফ সম্পর্কে হযরত ইমাম মালেক (রহ.) বর্ণনা করেছেন, ‘মান তাসাওউফা ওয়ালাম ইয়াতাফাকাকাহু, ফাক্বদ তাযানদাক্বা, ওয়া মান তাফাক্বাহা-ওয়ালাম ইয়া-তাসাওউফ ফাক্বদ তাফাস্-সাক্বা, ওয়া মান জামাআ বাইনাহুমা ফাক্বাদ তাহাক্বাকা’ অর্থাৎ : যে ব্যক্তি তাসাউফ অর্জন করল ফিকাহ (শরীয়ত) ছাড়া, সে জিন্দিক (কাফের)। যে ব্যক্তি শুধু ফিকাহ (শরীয়ত) অর্জন করল, তাসাউফ ছাড়া, সে ফাসেক (মিথ্যাবাদি)। আর যে এই দুটোই অর্জন করল, সে পূর্ণ মুমিন। (মেরক্বাত শরীফ)এ থেকে বুঝা যায় শরিয়ত আর তাসাউফ পাশাপাশি। তাই একজন পূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য এই দুটি বিষয়ই অর্জন করা প্রয়োজন। মোটকথা শরিয়ত ছাড়া তাসাউফ (মারেফত) পূর্ণ হয় না, মারেফত ছাড়া ফিকাহ্ (শরিয়ত) পূর্ণ হয় না। ‘আশ্শরীয়াতু আকওয়ালী, আত্তারীক্বাতু আফওয়ালী, আল হাক্বীকাতু আহ্ওয়ালী, আল মারেফাতু আছরারী’ অর্থাৎ : হযরত রাসুলে করিম (স:) বলেন, শরিয়ত আমার বাক্য, তরিকত আমার কাজ, হাক্বিকত আমার অবস্থান এবং মারেফত আমার নিগূঢ় রহস্য।

তাই আত্মাকে খোরাক দানের মধ্যেই সুখ-শান্তি নির্ভরশীল। মুর্শিদের সরণে বা মোরাকাবা থেকেই মুরিদের হৃদয়ে মহব্বত সৃষ্টি হয়। এমন সরণ বা মোরাকাবাই আত্মার প্রকৃত খোরাক। এতে আত্মা যেমন সজীব-সতেজ ও শক্তিশালী হয়, তেমনি নির্মল, নিরোগ ও পাপমুক্ত থাকে। মুর্শিদের সরণ বা মোরাকাবা থেকে বিরত থাকলেই, আত্মার উপবাস বা আত্মা দুর্বল হয়ে যায়। তখন নানান পাপ, রোগ, অশান্তি আত্মায় প্রবেশ করে আক্রমন করতে থাকে। আর তখন এভাবেই আত্মা কলুষিত হয়ে যায়।

(Visited 2,964 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *