তাসাউফ-তরিকত-পীর ও মুরিদ

মৌলানা শামশুল আলম আজমী

ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিকতার সূচনা অর্থাৎ ইলমে তাসাউফের ধারাবাহিকতা কখন কীভাবে শুরু হলো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর উত্তরও অতি স্পষ্ট যে, ইসলাম ধর্মে রূহানিয়াত অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার সূচনা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে সাহাবা কেরামদের মধ্যেই প্রথমে বিস্তার হয়েছে। মহানবী (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীগণ পার্থিব বিষয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। আত্মপ্রচার ও লোক দেখানো তাঁদের জীবনে কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি। তাঁদের মূল ব্রত ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহান স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করা।

তাসাউফের সূচনা : মহানবী (সঃ)-এর প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, তিনি প্রাথমিক জীবনের একটি বিরাট অংশ লোকাচার-লোকনিন্দা উপেক্ষা করে পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। কিন্তু তখনো তাঁর উপর অহী নাজিল শুরু হয়নি। মহানবী (সঃ)-এর উপর অহী অবতরণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মিশন অর্থাৎ ইলমে তাসাউফের শিক্ষার ব্যাপকতা শুরু হয়। তাঁর সঙ্গে এ মিশনে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক, হযরত ওমর বিন খাত্তাব, হযরত ওসমান জিন্নূরাইন, হযরত মওলা আলী এবং তাঁদের সমসাময়িক অন্য সাহাবা কেরামের জীবন কর্ম মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রত্যেকেই আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হিসেবে নিজেদের জীবন যৌবন, ধন-দৌলত, পরিবার-পরিজন, ধ্যান-ধারণা সবকিছু মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। মহানবী (সঃ) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের যুগ ‘খাইরুল কুরুন’, অর্থাৎ : তাসাউফ ও রূহানিয়াত-এর স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত।

তাসাউফের বিস্তার : আল্লাহতায়া’লার মনোনীত ধর্ম পবিত্র ইসলাম এবং শুধু এ ধর্মেই রয়েছে মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। একথা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে এবং জাগতিক গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমেও এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামের ধারাবাহিকতা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বহমান থাকবে। এ ধর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকারের ষড়যন্ত্র হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিকতার কারণেই এ ধর্মের অস্তিত্ব¡ অটল ও অবিচল আছে এবং থাকবে। তবে তাবেঈনদের পর থেকে হক্কানী রব্বানী পীর মাশায়েখগণের মাধ্যমে এখনো সমগ্র বিশ্বে প্রকৃত ইসলামের চর্চা অবিকৃত অবস্থায় বিরাজমান। হযরত ওমর বিন আবদুল আজিজ ১০১ হিজরীতে ইন্তেকাল করার পর মুসলিম রাজা বাদশাগণ ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিকতাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠ-পোষকতা প্রদানে সক্ষম হননি। কারাবালার ইয়াজিদ অনুসারীদের হাতে মহানবীর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (রাঃ) আনহুমার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে ইসলাম দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। একটি সুন্নত বিরোধী ও তরিকত বিরোধী এজিদি ইসলাম, অন্যটি হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর অনুসারী আওলাদে রাসুলদের পথের ইসলাম। এই বৈরিতা সত্ত্বেও কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় ও মনোনীত অলিবান্দা, পীর, ফকির, গাউছ-কুতুব, হক্কানী আলেম ওলামা ও মাশায়েখের মাধ্যমেই এ রূহানী কার্যক্রম এখনো পর্যন্ত বিরাজমান রেখেছেন। পরবর্তীতে এ কর্মকা- ‘তরিকত’ নামে পরিচয় লাভ করে। তরিকতের অর্থ হলো, রাস্তা-পথ, পন্থা, পদ্ধতি, রীতি-নীতি বা মাধ্যম। যেমন কাদরীয়া তরিকা, চিশতিয়া তরিকা, নকশবন্দিয়া তরিকা এবং সর্বশেষ মোজাদ্দেদিয়া তরিকা। এই চারটি তরিকা যা ভিন ভিন্ন সময়ের বা যুগের শ্রেষ্ঠ একেকজন মহা মানবের মাধ্যমে আর্বিভূত হয়েছে। যে তরিকাগুলো মুসলিম বিশ্বে বিরাজমান।

আধ্যাত্মিক সিলসিলা তাসাউফের বিস্তৃত রূপের পরিচায়ক। মুকাদ্দামা- এ ইবনে খুলুদুন, আত-তরীফাত, তাফহীমুল ইসলাম, আবজাদুল উলুম, কশফুজ জুনুন, আররিসালাতুল মুছতাতরাফা, ইহয়াউ উলুমিদ দীন,
আইয়ুহাল ওয়ালাদ, কাশফুল মাহজুব, নুরুল ইরফান, মিরকাতুল মাফাতীহ, আল হাদিকাতুল নদীয়াহ, ফাতোয়া এ রেজভীয়া, শুয়াবুল ঈমান, মলফুজাতে আ’লা হযরত, আনওয়ারে আউলিয়া ও আদাবে মুর্শিদে কামিল ইত্যাদি গ্রন্থের আলোকে তাসাউফের কর্মপদ্ধতি, পীর-মুরিদী, পীরের মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা, যোগ্যতা, শর্তাবলী, ও মুরিদের করণীয় বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ।

কর্ম পদ্ধতি : মাশায়েখগণ যুগে যুগে শান্তির পথহারা মানুষকে প্রকৃত মুরিদে মুমিন হিসেবে পরিচালনা করা ও পরিচালিত হওয়ার জন্য সুবিন্যস্ত কর্ম পদ্ধতি আল্লাহ-রাসুলের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করেছেন। এ কর্ম পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণের মধ্য দিয়ে বান্দা তার মন্জিলে মকছুদ, অর্থাৎ অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। তাই মানুষের মৌলিক জীবনঘনিষ্ঠ এ কার্যক্রম পৃথিবীর নানা দেশে তরিকত ও সিলসিলা নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে মুসলমানগণ মহানবী (সঃ)-এর মহব্বতে তাঁর দর্শন লাভ করতে পারেন। এ কথা পবিত্র কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এবং স্বীকৃত যে, শতবর্ষ পর পর বেলায়েতে মাশায়েখগণ নবীর প্রতিনিধি হয়ে আসবেন। তাঁদের কর্ম থাকবে আল্লাহ-রাসুলের আলোকিত সত্য পথের নেশা ও অপরিসীম জ্ঞানের ভান্ডার এবং থাকবে আধ্যাত্মিক শক্তি, যে শক্তি মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত।

পীর-মুরিদী : তরিকতের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি সিলসিলাতে আল্লাহর মনোনীত একের পর এক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ তাঁর অনুসারীদের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের দ্বারা প্রচারিত ইসলামের সত্য বাণী গ্রহণ করে দিকভ্রান্ত অসহায় মানুষ সুপথে আসার সুযোগ পেয়ে খাঁটি ঈমানদার হয়ে, সুবিন্যস্ত জীবন-যাপনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর স্বাদ গ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। এই পথের প্রদর্শককে শাইখ বা পীর-মুর্শিদ এবং তাঁদের অনুসারীকে মুরিদ বা শাগরেদ বলা হয়। পীরের ইন্তেকালের পর তরিকতের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখার জন্য, পীরের আদেশে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনকারীকে খলিফা বলা হয়। মাশায়েখ কেরামগণ যাঁকে মনোনীত করেন, তিনিই পরবর্তীতে শাইখ হিসেবে বিবেচিত হন। এ দায়িত্ব অর্পণ ও মনোনয়ন আধ্যাত্মিক যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। আধ্যাত্মিকতা উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া যায় না, এ গুণ আল্লাহতায়া’লার দান এবং যা নির্মল সাধনার বলে অর্জন করতে হয়। এখন পর্যন্ত এ নীতিই অনুসৃত হয়েছে, ফলে প্রকৃত তাসাউফ ও রূহানিয়াতের বিদ্যাচর্চা যাঁদের মধ্যে অক্ষুণ ও পরিপূর্ণ। তাঁদের সান্নিধ্য শিক্ষায় এসে মুসলমানরা প্রকৃত ঈমানদার ও আধ্যাত্মিক সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করছেন।

পীর যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে : পীর-মুর্শিদ হলেন তরিকতের পরিচালক। এখানে বলে রাখি, পীর পরিপূর্ণ যোগ্যতা সম্পন্ন না হলে, সঠিকভাবে তরিকত পরিচালনা করে মুরিদদের সত্যের পথ প্রদর্শন করতে পারেন না। অযোগ্য পীরের মুরিদ হলে নিজের বিশ্বাস, ভক্তি কোনটাই রক্ষা করা মুরিদের পক্ষে সম্ভব না। তাই ঈমানহারা হয়ে মরে যাওয়ার আশংকা থাকে। কারণ মৃত্যুমুহূর্তে আজরাঈলের বিকটময় চেহারা দেখলে দুর্বল ঈমানের মানুষ আল্লাহ-রাসুলের স্মরণ সবই ভুলে যাবে। সেই সুযোগে মানুষের ঈমান শয়তান দখল করে নিবে।

তাফসিরে কবীর এর রচয়িতা বিশ্বখ্যাত মোফাসসিরে কোরআন আল্লামা হযরত ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর মৃত্যু শয্যায় শয়তানের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। ফখরুদ্দীন রাজী মৃত্যু শয্যায় শয়তানের বেড়াজালে পড়লেন! তখন নিজের যোগ্যতায় তিন’শ ষাটটি দলিল উপস্থাপন করলো যে, লা-শারিক, আল্লাহ এক’। তবুও শয়তানের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না, তখনই তাঁর যোগ্যতা-সম্পন্ন পীর-মুর্শিদ হযরত শাইখ নাজিমুদ্দীন কোবরা (রহ.) প্রায় তিন’শ মাইল দূর থেকে রুহানিভাবে দেখতে পেলেন, তাঁর ভক্ত-মুরিদ ফখরুদ্দীন রাজী মৃত্যু শয্যায় শয়তানের ধোকায় পড়তে যাচ্ছে। তখন তিনি অজুর পানির ঘটি নিক্ষেপ করলেন, পানিসহ ঘটি এসে ফখরুদ্দীন রাজীর গায়ে পড়লো। ঘটির ভিতর থেকে আওয়াজ আসল, হে ফখরুদ্দীন রাজী, তুমি শয়তানকে বলো, বিনা দলিলে আমার প্রভু এক’ এবং বিশ্বাস করি তিনি অবিনশ্বর।’ ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (রহ.)-এ কথা শয়তানকে বললে, শয়তান পরাজিত হয়ে বললোÑ হে ফখরুদ্দীন রাজী, যদি আজ তোমার কোন কামেল পীর-মুর্শিদ না থাকতো তাহলে তুমি কিছুতেই ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারতে না। এভাবেই শয়তানের কবল থেকে ফখরুদ্দীন রাজীর ঈমান রক্ষা পেল। এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, মুরিদ যতই যোগ্যতা-সম্পন্ন, কেতাবি আলেম হোক না কেনো। যোগ্য পীরের সান্নিধ্য না পেলে তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা অনেক সময়ই বেকার প্রমাণিত হয়। (চলবে)

লেখক : মৌলানা শামশুল আলম আজমী, কক্সবাজার থেকে।

(Visited 1,751 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *