শরিফুল আলম
আমার দয়াল দরদি মুর্শিদ বর্তমান জমানার হাদি, গাউসুল আজম শাহসূফী আলহাজ মাওলানা সৈয়দ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের নির্দেশে, দয়াল নবীজির সত্য তরিকা প্রচারের জন্য, ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর রাত আটটায় ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে, বুড়িমারি স্থল বন্দর হয়ে আমার স্ত্রীসহ ভারতে যাই। সম্মানীত পাঠক, প্রথমেই একটু ভিন্ন্ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। লেখার শুরুতেই আমার মুর্শিদ বা পীরকেবলাজানকে দয়াল বলে সম্বোধন করেছি। অনেকেই আমাকে বলেন, তোমরা পীরকে দয়াল বলো কেন? আসলেই, এ বিষয়টি আমাদের পরিস্কার হওয়া উচিৎ, তাহলে পূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য তরিকতের আমল সহজ হয়ে যাবে। সমাজে অনেকে আছেন, যারা দান-খয়রাত করেন। সেবামূলক কাজ করেন। আমরা তাদের বলে থাকি, লোকটি অন্যকে সাহায্য করে, সে খুব দয়ালু। ওই রকম একজন সাধারণ মানুষকে যদি এত বড় উক্তি-উপাধি দেয়া হয়, সে ক্ষেত্রে কুতুববাগী কেবলাজানের মতো একজন কামেল মোকাম্মেল পী-মাশায়েখ আল্লাহতায়া’লার প্রতিনিধি। যার দয়ার বরকতে মানুষের আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা, নামাজে হুজুরি হয় এবং বিভিন্ন ধরনের বালা-মসিবত থেকে মুক্তি পায়, যাঁর উছিলায় পাপীতাপী মানুষের আত্মার উন্নতি এবং আখেরাতে মুক্তির ফয়সালা হয়, বেনামাজি নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, অলসতা ছেড়ে সৎ উপার্জন করে, মানবসেবায় উদার হয়, মা-বাবার সেবা করে, সর্বপরি আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর সত্য ইসলামের তরিকায় আত্মনিয়োগ করে, তাকে দয়াল সম্বোধন করতে কোন প্রকার দোষ নেই।
এবার সফরের আলোচনায় আসি। ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ বর্ডার ইমিগ্রেশনের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে যখন, স্ত্রীকে নিয়ে ভারতের চেংরাবান্দা বর্ডারের ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছি ঠিক তখনই হলো ঝামেলা। আমাদের ব্যাগে কুতুববাগ দরবার শরীফের মুখপত্র মাসিক ‘আত্মার আলো’ পত্রিকা এবং ডলারের পরিবর্তে ভারতীয় রুপি ছিলো। ইমিগ্রেশন অফিসার ব্যাগ তল্লাশি করে বললেন, পত্রিকাগুলো ভারতে ঢুকতে দেয়া হবে না। এরপর আমার কাছে থাকা কয়েক হাজার রুপি সে নিয়ে নিলো এবং এগুলো বেআইনি বলে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। এমন সময় দূর থেকে একজন বিএসএফ (সনাতন ধর্মাবলম্বি) সদস্য এসে মাসিক ‘আত্মার আলো’ পত্রিকায় কুতুববাগী পীরকেবলাজানের ছবি মোবারক দেখে বললো, আজ সকালবেলা এই ঠাকুরকে স্মরণ করলাম আর দেখ ভগবানের কী দয়া, অফিসে এসেই ঠাকুরের পত্রিকা আর তাঁর লোকজনকে দেখতে পেলাম! একথা বলেই ইমিগ্রেশন অফিসারকে বিনয়ের সঙ্গে বললো, এরা দুজন ঠাকুরের লোক, ঠাকুরের পত্রিকাসহ তাদের ভারতে প্রবেশ করতে দেয়া হোক। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, আমার থেকে কেড়ে নেয়া রুপি ফেরৎ দিলো এবং কিছু পরামর্শ দিয়ে ভারতে প্রবেশের সুযোগ করে দিলেন।
আমাদের গন্তব্য ছিল আসাম রাজ্যের দরঙ্গ (চার আলি) জেলার বিশ্বনাথ থানার বিশ্বনাথ ঘাট। সেখানে আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশের বসবাস। রাজধানী গোহাটি থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে অরুণাচল প্রদেশের কাছে এই বিশ্বনাথ, ওখান থেকে চীনের বর্ডার নিকটেই। পুরোপুরি অজানা পথ আমাদের। কুচবিহার শহরে এসে পৌঁছালাম বেলা দুইটার দিকে। দুপুরের খাবার সেরে, পূজা হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে, পথের তথ্য সহযোগিতা নিয়ে চলে গেলাম নিউ কুচবিহার রেল স্টেশনে। গো হাটির টিকিট কাটতে গিয়ে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়, সে যাবে গোহাটি। আমার স্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মুক্তি আমিনের সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেল ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তাকে তরিকতের দীক্ষা দিলেন আমার স্ত্রী। বাবাজান কেবলা অনেক আগেই দয়া করে, মহিলাদের তরিকতের ছবক দেওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীকে। রিজার্ভেশনের টিকিট না পেয়ে সাধারণ ক্লাসের টিকিট সংগ্রহ করে সন্ধ্যা সাতটার ট্রেণের অপেক্ষায় রইলাম। মহান মুর্শিদের শিক্ষানুযায়ি তাসাব্বুরে শায়েখ ও অজিফা আমল করতে থাকলাম দুজনেই। চারশো কিলোমিটার দূরের পথ গোহাটি ভাবছিলাম রিজার্ভেশনের টিকিট পেলে একটু রিলাক্সে যাওয়া যেত। কিন্তু তা আর টিকিটে হলো না, মনে মনে ঠিক করলাম রিজার্ভেশনেই যাবো, মুর্শিদের নাম নিয়ে উঠে পড়বো তার পর যা হয় হবে। এক ঘন্টা বিলম্বে রাত আটটায় ট্রেণ আসলো, সাধারণ ক্লাসের টিকিট নিয়ে উঠলাম রিজার্ভেশন ক্লাসে। সঙ্গে থাকা ভদ্র মহিলা ভয় পেয়ে বললো, দাদা, এই বগিতে উঠলে অনেক টাকা জরিমানা করবে রেলের অফিসাররা। বললাম, মুর্শিদ-গুরুর দয়া আছে, আসুন কিছু হবে না। উঠে পড়লাম। দেখি তিনটি সিটই খালি আছে, মহান মুর্শিদের উছিলা নিয়ে আমরা বসে পড়লাম। আশেপাশে যাত্রীদের টিকিট চেক হলো, কিন্তু ভদ্র মহিলাসহ আমাদের টিকিট চেক না করে চেকাররা চলে গেলেন। রাত দুইটার দিকে পৌঁছে গেলাম গোহাটি, ভদ্র মহিলা আমাদের মোবাইল নাম্বার নিয়ে বিদায় মুহূর্তে বললেন, আপনারা অসাধারণ গুরুর শিষ্য!
৩০ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোহাটিতে আগমন করবেন এবং জনসভায় ভাষণ দেবেন। সেই জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছিল গোহাটিসহ গোলযোগপূর্ণ সারা আসাম রাজ্যে। যা হোক, রাতটুকু দুজনে মিলে স্টেশনে প্লাটফর্মে বসে এবাদতের মাধ্যমে কাটিয়ে দিলাম। ভোর ছটার বাসে বিশ্বনাথের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে, পথে যেতে যেতে দেখলাম সেনাবাহিনী প্রায় সকল বাসযাত্রী ও পথচারীর ব্যাগসহ অনেকের শরীর তল্লাশি করছে। কিন্তু আমাদের কেউ কিছু বললো না। বরং আমরাই তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে ওই দূর অচেনা পথের সন্ধান জেনেছি। তারা আমাদের ভদ্রতার সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছেন গন্তব্যের পথ। আমি আর আমার স্ত্রী অবাক হয়ে বলাবলি করছিলাম ব্যাপার কি! প্রায় সবাইকেই তো তল্লাশি করছে কিন্তু আমাদেরকে তো কিছুই বলছে না বরং সহযোগিতাই করছে। আমার স্ত্রী বললো, বাবাজানের দোয়ার বরকতেই হচ্ছে এসব। এভাবে চলতে চলতে দুই রাত, দুই দিন কেটে গেল ট্রেণ আর বাসে, বেলা দুইটার দিকে পৌঁছে গেলাম, আমার পিতার আপন চাচা আসাম রাজ্য সরকারের সাবেক স্বাস্থ্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রী নুরজামাল সরকার। তিনি ওখানে বহুদিন থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, সেই সুত্রে বিশ্বনাথ আমার দাদাবাড়ি। বাড়িতে পৌঁছালে দীর্ঘ বছর পর আমাদের পেয়ে একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
একটানা প্রায় পনেরশো কিলোমিটার রাস্তা ভ্রমণে আমরা ভিষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু দয়াল নবীজির সত্য তরিকায় কেবলাজানের বাণী ও মহান মুর্শিদের ছবি মোবারক দেখে, মুর্শিদ কেবলাজানের আরও গুণাবলির কথা শোনার জন্য, অধিক আগ্রহ প্রকাশ করলেন বাড়ির সবাই। কেবলাজানের শিক্ষা ও আদর্শের বাণী দিয়ে খুব অল্প কথায় তাদের বলার চেষ্টা করেছি যে, এই জীবনে যদি একজন কামেল পীর-মুর্শিদ থাকে উছিলা, তবে পরকালে জন্য মুক্তি বা বেহেশত-স্বর্গের ভাবনা থাকে না। কামেল গুরুর শিক্ষাই জগতে প্রকৃত শিক্ষা। অনুভব করলাম, মুহূর্তের মধ্যে অস্বাভাবিক ক্লান্তির রেশ আর রইলো না। বাড়ির সবাই বললো, এ দেশে মুসলমানদের পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই খারাপ, এর মধ্যে কীভাবে আসলেন? তার ওপর আপনাদের সাথে রয়েছে ইসলামী পত্রিকা। পথে আপনাদের তল্লাশি করেনি? আমি বললাম দয়াল নবীজির সত্য তরিকার বাণী আর মহান মুর্শিদের উছিলা নিয়ে যাত্রা করেছি, আমাদের ভয় কিসের? বাবাজানের দোয়ায় নিরাপদেই তো আসতে পেরেছি। মুর্শিদের দয়ার কথা বললে শেষ হবে না।
আমাদের ভিসার মেয়াদ আছে আর চার দিন। তাই পরদিনই বিশ্বনাথ থেকে চলে আসতে হলো জলপাইগুড়িতে। বাবাজান কেবলা দয়া করে আমি গুনাহ্গারকে তরিকার ছবক দেয়ার হুকুম দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। বাবাজানের নামে কিছু সংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু ভাইদের তরিকতের ছবক দিয়েছি। তারা বাবাজানের ছবি মোবারক দেখে অনেক ভক্তি ও বিশ্বাস করেছেন যে, কুতুববাগী কেবলাজান সত্যিকারের মোজাদ্দেদ কামেল গুরু। আমরা তাঁর পবিত্র ছবি দেখে এবং তাঁর তরিকতের নসিহতবাণী পেয়ে ধন্য হয়েছি, ভগবানের কাছে আশা করি তাঁকে সরাসরি দেখার। আমাদের মুর্শিদ কেবলা কুতুববাগীর নামে ধুপগুড়িতে আমার স্ত্রীও অনেক মহিলাকে তরিকার ছবক দিয়েছেন। মুসলমান মহিলাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর, তরিকতের আমল ও মুর্শিদকে স্মরণ করতে বলেছেন এবং স্মরণের মাধ্যমেই একদিন না একদিন বাস্তবে দেখা পেয়ে যাবেন আপন মুর্শিদের। ধ্যান-মোরাকাবা করবেন।
প্রিয় পাঠক, এই সফরের সব চেয়ে স্মরণীয় এবং অলৌকিক বিষয় হল, আট দিনের সফরে থাকা অবস্থায় বাসে, ট্রেণে, পায়ে হেঁটে যখন যেখানে গিয়েছি, সেখানেই কেবলাজানের শরীর মোবারকের বেহেশতি সুঘ্রাণ পেয়েছি। আমরা বাবাজানের সামনে বসে তালকিন নেয়া বা অন্যান্য যে কোন সময় একটা বেহেশতি আতরের মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ পাই। বার বার মনে হচ্ছিল, বাবাজান আমাদের সঙ্গেই আছেন। কল্বে রুহানিভাবে তো আছেনই, বাস্তবেও আছেন। আমরা সরাসরি দেখতে না পেলেও বাবাজান ছায়ার মত সঙ্গে থেকে, বিদেশের অচেনা পথ নিজের চোখে দেখিয়ে এনেছেন। পাঠক ভাই-বোনদের এ কথা বিশ্বাস হলো কি না জানি না, তবে আমরা যেটা সত্য উপলব্ধি করেছি, তা-ই লিখে খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের বাণী প্রচারের মুখপত্র মাসিক ‘আত্মার আলো’ এর কল্যাণে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি মাত্র।