মেয়েলোকের বাইয়াত-তরিকা গ্রহণের অকাট্য প্রমাণ

 আলহাজ মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

রাসুলেপাক (সঃ) যে মেয়েলোকদিগকে বায়েত করিয়াছেন ছহীহ্ হাদিস শরীফে তাহার বহু প্রমাণ রহিয়াছে। সহিহ্ বোখারী (মিছরী ছাপা) ৪র্থ খন্ড, ১৫২ পৃষ্ঠা। আম্মাজান হযরত আয়শা ছিদ্দিকা (রা.) বলিয়াছেন, হুজুর (সঃ) সূরা ‘মোমতা হানাত’-এর আয়াত মৌখিক উচ্চারণের দ্বারা মেয়েলোকদিগকে বায়েত করিতেন। আম্মাজান হযরত আয়শা ছিদ্দিকা (রা.)আরো বলিয়াছেন, তিনি কখনও কোন মেয়েলোকের হস্ত স্পর্শ করেন নাই। ছহীহ্ নেছায়ী শরীফ (২য় খন্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা) ছহীহ্ বোখারী (৩য় খন্ড, ১২৪-২৫ পৃষ্ঠা) ও ছহীহ্ মোছলেম শরীফের ২য় খন্ড, ১৩১ পৃষ্ঠায় যে হাদিস বর্ণিত আছে, তাহার মর্ম এইরূপ। কওলুল জামিল কিতাবে ৫/২৯-৩০ পৃষ্ঠায় মেয়েলোকদিগকে বায়াতের বিষয় উল্লেখ করিয়াছেন, শাহ্ আবদুল আজিজ (রা.) বলিয়াছেন, হযরত নবী করিম (সঃ) মেয়েলোকদিগকে মৌখিক বায়াত করিতেন।

রাসুলেপাক (সঃ) মেয়েলোকদিগকে তাসাউফ শিক্ষা দিতেন। বোখারী শরীফ কিতাবুল এয়তেছামে লিখিয়াছেন এবং আবু ছইদ লিখিয়াছেন, নির্দিষ্ট দিনে খোদাপ্রাপ্তি এলেম শিক্ষা দেওয়াতে বেশি ভিড় হওয়ার কারণে, মেয়েলোকগণের জন্য ভিন্ন একটি তারিখ দিয়া, শিক্ষার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করিয়াছিলেন, তাই উক্ত ছাহাবা হইতে বর্ণিত আছে যে, এক নির্দিষ্ট দিন মেয়েলোকদের জন্য ঠিক করিয়া দিয়াছিলেন। যাহা বোখারী শরীফের কিতাবুল এলেম’ খন্ডে বর্ণিত আছে এবং উক্ত ব্যাখ্যায় মেশকাতে বর্ণিত আছে যে, সপ্তাহে একদিন ঠিক করিয়া দিয়াছিলেন।

মেয়েলোকদের তরিকা গ্রহণ করার নিয়ম রাসুলেপাক (সঃ)-এর উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাইতেছে। কামেল পীরের নিকট পর্দার আড়ালে থাকিয়া মৌখিক উচ্চারণ দ্বারা, কোন মেয়েলোকের সাহায্যে, পাগড়ির অথবা রুমালের সাহায্যে মেয়েলোকগণ মুরিদ হইতে পারেন। এ প্রসঙ্গে ‘জিয়াউল কুলুব ও কৌলুল জামিলে’ তাসাউফপন্থি কামেল পীরদের নিকট হইতে শিক্ষা করার হুকুম আছে। (মাকতুবাত শরীফ ১ম খন্ড) মেয়েলোকদের মধ্যে কিছু মেয়েলোক কামেল ছিলেন।

(ইবনে মাজা) ২য় খন্ড কিতাবুল হজ্জ। আন ফাছে রহিমা নামক কিতাবের ১৮ পৃষ্ঠায় আছে, উম্মে ওবায়দুল্লাহকে হযরত শাহ আবদুর রহিম মোহাদ্দিস দেহলবী (রহ.) তাওয়াজ্জোহ্দানে ফানা ও বাকা পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। রাসুলেপাক (সঃ) পুরুষলোক, মেয়েলোক উভয়ের জন্যই এলেম তলব করা ফরজ বলিয়াছে, যথা : ‘তালাবুল ইলমি ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমিন ওয়া মুসলিমাতিন’। অর্থাৎ- প্রত্যেক নর-নারীর জন্য এলেম তলব করা ফরজ। এই হাদিসে যে, প্রত্যেক নর-নারীর জন্য এলেম শিক্ষা করা ফরজ বলা হইয়াছে, এখানে কোন এলেম-এর কথা বলা হইয়াছে? এমএ, বি এ পাশ করা না, শুধু ফেকার মছলা মছায়েল শিক্ষা করা না, যে এলেম দ্বারা আল্লাহ্ ও রাসুল (সঃ)-কে লাভ করা যায় ঐ এলেম শিক্ষা করা ফরজ বলা হইয়াছে। এখানে জ্ঞানী মাত্রই স্বীকার করিবেন, যে এলেম দ্বারা আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-কে লাভ করা জায়েজ, ঐ এলেমকেই (১) বকাদের জরুরাৎ শিক্ষা করা ফরজ বলিয়াছেন। আরও দেখা যাইতেছে, যে এলেম দ্বারা আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-কে লাভ করা যায়, ঐ এলেম  পুরুষের জন্য যেরূপ ফরজ, মেয়েলোকের জন্যও ঐরূপ ফরজ। আল্লাহ্কে লাভ করিবার জন্য এল্‌মে শরিয়ত ও তাসাউফ উভয়ই আবশ্যক হয়। কাজেই এল্মে শরিয়ত ও তাসাউফ উভয়ই শিক্ষা করা ফরজ।

এখন যদি কেহ একথা প্রশ্ন করে যে, মেয়েলোকদের পীরের বাড়ি যাওয়া জায়েজ আছে কিনা? উহার উত্তর এই যে, যদি কোন মেয়েলোক বিশেষ কোন দরকার বশত: নেক নিয়তে নিজ স্বামী, পিতা বা ভাইকে সাথে নিয়া পর্দার সহিত পীরের বাড়ি যায় ও শরিয়ত মত থাকে এবং চলা-ফেরা, আসা-যাওয়া শরিয়ত মত করে, তবে জায়েজ আছে। কেন না, নেক নিয়তে পর্দার সহিত ওয়াজ নছিহত ও হজ্জ ইত্যাদি নেক কাজে যাওয়া জায়েজ আছে। যেরূপ আলেমদের ওয়াজ নছিহত শুনিলে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের মনের ভাবের অনেকটা পরিবর্তন হইয়া থাকে। তদ্রুপ স্ত্রী ও পুরুষ যখন কোন কামেল পীরের উপদেশ শুনে ও তাওয়াজ্জোহ্ পায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের মনের ভাবের পরিবর্তান হইয়া যায়। অনেক সময় ‘বেদাতী বেশরায়ী’ লোক, কামেলদের উপদেশে বা তাওয়াজ্জোতে অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ মোমেন হইয়া যায়। কামেল অলির এক তাওয়াজ্জোহ্তে মানুষের অন্তরের মন্দ গুণগুলি বা কু-রিপুগুলি যেরূপ দূরীভূত হয়। শত ওয়াজ নছিহত ও শত কিতাব পাঠেও উহার সমান হয় না। শুধু এল্মে জাহের দ্বারা নিজেকে সংশোধন করিতে পারে না। সুতরাং কি করিয়া অন্যকে সংশোধন করিতে পারে? জামেউল অছুলে আছে, যথা : ‘ফাল ইলমু বিল-ইল মিযজ্বোয়াহিরি ফাক্বাদ লা-ইয়াক্বদিরু আলা ইলাজি ক্বালবিহি কাইফা লি-গাইরিহি’। অর্থাৎ, যাহারা কেবলমাত্র (১) জাহেরা এলেম শিক্ষা করিয়াছে, তাহারা নিজেদের কু-রিপুগুলি দূর করিতেই অক্ষম, সুতরাং তাহারা কি করিয়া অন্যের অন্তরকে শুদ্ধ করিবে?

হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যিনি চার মাযহাবের প্রধান ইমাম এবং যাহার লিখিত ফেকার মতানুযায়ী প্রায় মোসলমানই ধর্মের পথে চলিতেছেন। টীকা : (১) বর্তমানে দেখা যাইতেছে, একদল লোক আছে তাহারা মাওলানা, মৌলবী, হাফেজ ও কারী হইয়াছে। কিন্তু তাহাদের নফসের এছলাহ্ হয় নাই, চরিত্রও আমলদোরস্ত হয় নাই। তাহারা মিথ্যা বলিয়া থাকে, মিথ্যা ফতুয়া দিয়া থাকে, বহু রকম ধোকাবাজি করিয়া থাকে, নাহক বিচারসহ আরও বহু রকম কঠিন পাপের কাজ করিয়া থাকে। ইহার দ্বারা প্রমাণ হইতেছে যে, কিতাবী বিদ্যার দ্বারা মানুষের আত্মা শুদ্ধ হয় না। সুতরাং, যে বিদ্যার দ্বারা মানুষের আত্মা শুদ্ধা করা যায়, তাহা শিক্ষা করা ফরজ। কেন না আত্মা শুদ্ধ না হইলে কোন রকম এবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হইবে না। কাজেই যে বিদ্যায় আত্মা শুদ্ধ হয়, তাহা শিক্ষা করা অবশ্যই ফরজ। দেখা যাইতেছে এল্মে তাসাউফ দ্বারা মানুষের আত্মা শুদ্ধ করা যায়। কাজেই মাওলানা, মৌলবী প্রমুখ সকলের জন্যই এল্মে তাসাউফ শিক্ষা করা ফরজ হইবে। তিনি বলিয়াছেন, আমি যদি দুই বছর ইমাম হযরত বাকের (রহ.)-এর খেদমতে থাকিয়া এল্মে মারেফত হাসিল না করিতাম, তবে অবশ্যই আমি নুমান ধবংস হইয়া যাইতাম। তাই তিনি বলিয়াছেন, ‘লাওলা সিন্তানি হালাকা নুমান’ (লজ্জাতুল ঈমান)। অর্থাৎ- নুমান যদি দুই বছর ইমাম বাকের (রহ.)-এর খেদমতে থাকিয়া মারেফত শিক্ষা না করতো, তবে নুমান ধ্বংস হইয়া যাইতো। হাদিস শরীফে আছে, মানবের দিল তাজা, আলেমের দ্বারায় এবং তাবাও (ধ্বংস) ঐ আলেমের দ্বারায়, সর্বাগ্রে বেহেশতে যাইবে আলেমগণ এবং সর্বাগ্রে দোযখেও যাইবে আলেমগণ। ইমাম হযরত আবু হানিফা (রহ.) এর মতো মানুষই যদি এ কথা বলতে পারেন যে, হযরত ইমাম বাকের (রহ.)-এর খেদমতে থাকিয়া দুই বছর এল্মে মারেফত হাসিল না করিলে, আমি নুমান ধ্বংস হইয়া যাইতাম, তবে আর অন্য লোকের জন্য কী হুকুম হইতে পারে? তাহা পাঠকগণ চিন্তা করে দেখুন। হযরত মাওলানা রুমী বলিয়াছেন, বছরব্যাপী রোজা করা, সমস্ত রাত্রি জাগ্রত থাকিয়া এবাদত করা, স্ত্রী হইতে বিছিন্ন হওয়া, সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ না করা, ইত্যাদি কঠোর পরিশ্রম করিলেও তরিকতের বুঝ পাইবে না।

হযরত নবম বছরে শেষ বিদায় হজ্জের (হজ্জাতুল বিদা) পর মক্কা হইতে মদিনার পথের মধ্যে খামেগাদিরে যখন হযরত রাসুলে আকরাম (সঃ) সকল সাহাবাগণের সম্মুখে খোৎবা পাঠ করিয়া প্রকাশ করিলেন যে, তিনি তাহাদের মধ্যে চিরদিন থাকিবেন না এবং তাঁহার পরলোকগমন নিকটবর্তী, তখন সাহাবিগণ ব্রিবত ও হতভম্ব হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন যে, হযরত আপনার পরলোকগমনের পর আমাদের হেদায়েতের অবস্থা কী হইবে? ইহার উত্তরে হযরত রাসুলেপাক (সঃ) বলিলেন যে, আমি তোমাদের জন্য দুইটি বৃহৎ বস্তুু রাখিয়া যাইতেছি। যাহারা উক্ত বস্তুদ্বয়কে শক্ত করিয়া ধরিয়া থাকিবে, তাহারা হেদায়েত পাইবে এবং যাহারা উহা পরিত্যাগ করিবে, তাহারা অন্ধকারে পতিত ও পথভ্রষ্ট হইয়া যাইবে। উক্ত দুইটি বস্তুর প্রথমটি কোরআন এবং দ্বিতীয়টি আমার আহ্লে বায়েত। এই হাদিসটি সহিহ্ মুসলিমে জায়েদ বিন আকরাম (রা.) হইতে এই প্রকার বর্ণিত আছে, ‘আম্মা বাদু আলা আইয়্যুহান নাছু ফাইন্নামা আনা বাসারুই ইউসেকু আই ইয়াতি ইয়ানি রাসুলুরাব্বি ফা-উ-জিবু ওয়া আনা তারিকুন ফি-কুমুস সাকালাইন আউয়ালু হুমা কিতাবুল্লাহি ফিহিম নূরু, ওয়াল হুদা ফাখুজু বি-কিতাবিল্লাহি ওয়াস তামছিকুবিহি ওয়াআহ্লু বাইতি, উযাককিরু কুমুল্লাহা ফি-আহলি বাইতি, উযাককিরু মুকুল্লাহা ফি-আহলি বাইতি মানিত, তাবাহুমা কানা আনাল হুদা ওমান তারাকাহুমা কানা আলা দলালাতিন’। অর্থাৎ, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, অত:পর (হামদ ও সালাতপর) হে মানবগণ, তোমরা সাবধান হও এবং জানিয়া রাখ যে, আমি একজন মানুষ, সম্ভবত শ্রীঘ্রই আমার প্রতিপালকের দুত আমার নিকট আসিয়া পৌঁছিতে পারে এবং আামি তাহার সমন (মালেকুল মৌত) স্বীকার করিয়া লইতে পারি (পরলোকগমন করতে পারি)। অতএব, তোমাদের মধ্যে দুইটি উত্তম ও বৃহৎ বস্তু রাখিয়া যাইতেছি। তাহার প্রথমটি আল্লাহ্র কিতাব, যাহার ভিতর আল্লাহ্র নূর ও হেদায়েত আছে। আল্লাহ্র কিতাবকে শক্ত করিয়া ধরো, অনুসরণ করো এবং দ্বিতীয়টি আমার ‘আহলে বায়েত’ (পরিবারবর্গ) আমার আহলে বায়েত সম্বন্ধে তোমাদিগকে খোদ সরণ করাইয়া দিতেছি। (এই কথা তিনি তিনবার বলিয়াছেন) অর্থাৎ, আমি খোদাতায়া’লাকে সাক্ষি করিয়া তোমাদিগকে আহলে বায়েত সম্বন্ধে বলিতেছি। এই উভয় বস্তুকে যাহারা অনুসরণ করিয়া চলিবে, তাহারা হেদায়েতের পথ পাইবে এবং যাহারা উহা পরিত্যাগ করিবে তাহারা পথভ্রষ্ট হইবে। আহলে বায়েত দ্বারা এখানে তাসাউফপন্থীদের দিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। তবে আহলে বায়েতের কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, আহলে বায়েতের লোক সকলেই এল্মে তাসাউফ বিদ্যায় পরিপূর্ণ ছিল। সুতারং আহলে বায়েত তাসাউফপন্থী লোকই হইবে।

কোরআন ও হাদিস দ্বারা আলেমদের জন্যও কামেল অলি ধরা ওয়াজের প্রমাণ হইতেছে। এখন চিন্তা করিয়া দেখুন, আলেমদের জন্যই যদি মারফেত এখতিয়ার করা ওয়াজের হইতে পারে, তবে সর্বসাধারণের জন্য কী হইবে! আবার বহু লোক এই ধারণায় আছে যে, নিজেদের দোষ সংশোধন করিয়া ও নিজেকে নিজে ভালো করিয়া এবং দুনিয়ার ঝামেলাকে কমাইয়া, কোন একজন পীরের নিকট যাইবে। শামছুল আরেফিন কিতাবে লিখিয়াছে যে, এইসব শয়তানের ধোকা ভিন্ন আর কিছুই নহে। কেন না কামেল অলির দোয়া ও তাওয়াজ্জোহ্তে যে সব দোষ দূর হয়, নিজে শত সহস্র বছর চেষ্টা করিয়াও উহার কিছু করিতে পারে না।

(Visited 1,328 times, 1 visits today)
Share