নাসির আহমেদ আল মোজাদ্দেদি
মানুষের অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। আরোগ্য করার মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন; কিন্তু উছিলা হচ্ছেন ডাক্তার। ডাক্তারের কাছে না গেলে রোগ সারানো সম্ভব না। ঠিক তদ্রুপ দেহের রোগের মতো মানুষের অন্তরেও রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। সে রোগ বাইরে থেকে দেখা যায় না। রোগের মধ্যে রয়েছে কাম-ক্রোধ, লোভ, হিংসা, কুখেয়াল-কুধ্যানের মতো ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তি। যাকে বলে নফসের রোগ। এসব রোগের চিকিৎসা ডাক্তার কবিরাজেরা করতে পারে না। চিকিৎসা নিতে হয় কামেল মুর্শিদ বা পীরের কাছ থেকে। সেই চিকিৎসা না নিলে রিপুর তাড়নায় মানুষ তার মনুষ্যত্বগুণ হারিয়ে পশু প্রবৃত্তিতে চলতে থাকে। যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের জন্য কাম্য হতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, প্রকৃত কামেল মুর্শেদ বা আধ্যাত্মিক কামেল পীর বা মুর্শিদ, তারা নফস্ বা আত্মাকে সাধনার দ্বারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন যে, তাদের অন্তরাত্মা সর্বদাই পাকসাফ। নফস তাদের কথায় চলে, তারা নফসের হুকুমে চলেন না। জেকের-আসকার করতে করতে তাদের আত্মা পুরিশুদ্ধ হয়ে যায়। তারা লোভ-হিংসা কাম-ক্রোধের মতো কুরিপু-সমূহকে এতটাই নিয়ন্ত্রিত করার শক্তি অর্জন করেছেন যে, তারা ইচ্ছে করলেই যে কোনো কুরিপুকে দমন করতে পারেন। নফস্কে তারা অধীনস্থ করে নিয়েছেন।
অন্যদিকে যারা সাধারণ মানুষ তারা কোনো কুরিপুই দমন করতে পারেন না। ফলে তাদের আত্মা অন্ধকারে নিমজ্জিত। প্রতিনিয়ত তারা পাপকর্মে লিপ্ত হয়।কেননা নফস্ এর ইচ্ছায় তারা চলেন। নফস্কে তারা নিজেদের ইচ্ছার অধীন করতে পারেননি। ফলে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী তারা হতে পারেননি। আর আত্মা যদি পরিশুদ্ধ না হয় তা হলে কোন ইবাদত-বন্দেগি কিছুই শুদ্ধ হবে না। নামাজে হুজুরি আসবে না। আল্লাহর সঙ্গে নামাজের ভেতর যে মোমিন লোকের মেরাজ বা সাক্ষাৎ ঘটে, সেটাও পরিশুদ্ধ আত্মা না হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। আত্মা শুদ্ধ হয় আল্লাহর ধ্যানে, জেকের-আসকারে।
তাই আমাদের মহান মুর্শেদ যুগশ্রেষ্ঠ হাদী আধ্যাত্মিক মহাসাধক খাজাবাবা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ নকশবন্দি কুতুববাগী কেবলাজান প্রথমেই আত্মশুদ্ধি আর দিল জিন্দা ও নামাজে হুজুরির ওপর গুরুত্ব দেন। আত্মশুদ্ধি না হলে পাক দিলের অধিকারী হওয়া যায় না। আর পাক দিল না হলে কোনো এবাদতও আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। তাই খাজাবাবা সব সময় বলেন মানবিক গুণাবলী অর্জনের কথা। তাঁর শিক্ষা হলো তরিকতের পথে চলতে প্রথমেই চাই অটল বিশ্বাস আর ভক্তি। বিশ্বাসী না হলে কী করে আল্লাহকে না দেখেই আল্লাহর অস্তিত্বে আমরা ঈমান এনেছি?
ইসলামের প্রথম শর্ত ঈমান। ঈমান বা বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে চাই ভক্তি। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের প্রতি ভক্তি, আখেরী নবীর খলিফা যারা কামেল পীর বা মুর্শেদ তাদের প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস ও ভক্তি। কথায় বলে ভক্তিতেই মুক্তি। সেই বিশ্বাস ও ভক্তির পরেই খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান আত্মশুদ্ধির কথা বলেন। বিশ্বাস আর ভক্তি থাকলে শরীয়ত এর সকল হুকুম আহকাম পালনের পথ সহজ হয়ে যায়। একই সঙ্গে ভক্তির দ্বারা মানব স্বভাবে আসে বিনয় ও ভদ্রতা। দূর হয়ে যায় অহংকার – যা মানুষের সকল সদগুণ নষ্ট করে দেয়। অহমিকা থেকে বেয়াদবি থেকে মানুষ সহজে মুক্তিলাভ করতে পারে আদব আর বিনয়ের মাধ্যমে। সুফিবাদের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে, পরিশুদ্ধ দিল বা আত্মা নিয়ে জেকের-আসকারের মধ্য দিয়ে খাঁটি মানুষ হওয়া, মানবপ্রেমী হওয়া। সে কারণেখাজাবাবা কুতুববাগী সব সময় বলেন মানব সেবাই পরম ধর্ম। মানুষকে সেবা করলে, ভালোবাসলেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খুশি হন। আল্লাহকে রাজি-খুশি করতে হলে মানুষের সেবা করতে হবে।অহংকার ছাড়তে হবে। অন্যের দোষ তালাশ না করে নিজের দোষত্রুটি তালাশ করতে হবে।বিনয়-ভদ্রতা-ন¤্রতা অর্জন এবং সকল কুরিপু থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হলে কামেল পীরের দীক্ষা অনিবার্য। সেজন্য শুদ্ধ মানুষ বা প্রকৃত কামেল মুর্শেদের কাছে যেতেই হবে।অনেকে বলেন, ‘পীর তো কোরানে নেই’। পীর কোরানে থাকবে কেন, পীর তো ফার্সি শব্দ। আরবিতে যা মুর্শেদ। কোরানের বহু সূরায় মুর্শেদ শব্দটি রয়েছে। উছিলা অন্বেষণের কথা রয়েছে।পবিত্র কোরানে সুরা মায়েদার রুকু ৬, আয়াত ৩৫ এ দেখুন, সেখানে যা বলা হয়েছে তার অর্থ ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, এবং আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তায় উছিলা অন্বেষণ বা তালাশ করো, নফসের সাথে জেহাদ করো…আমার পথে মেহনত কর, আমি তোমাকে সফলকাম করবো।’
অন্যদিকে সুরা নিসার ৬৯ নং আয়াতেও এর স্বাক্ষ্য রয়েছে। অথচ এ কালে আমরা দেখি নফস বা খায়েশের বিরুদ্ধে জেহাদ না করে একদল মুসলমান ফেৎনা-ফ্যাসাদ করছে, খুনাখুনি হানাহানি আর রক্তপাতকেই জেহাদ বলে মনে করছে। কী ভ্রান্ত ধারণা।ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানবতার ধর্ম। ইসলামের যেই মানবিকতা আর শান্তির পথ সুফিবাদেই নিহিত। তাই খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলা মানুষের দ্বারে দ্বারে সুফিবাদের শান্তির বাণী পৌঁছে দেবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। সমগ্র বাংলাদেশ ছাড়িয়ে তিনি আজ বিশ্বের দেশে দেশে মানবসেবা আর মানবতার বাণী রাসুলপাকের সত্য তরিকার বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে চলেছেন।যারা উছিলা বা নায়েবে রাসুলদের অস্বীকার করেন তারা আসলে কোরান-হাসিসের সত্যকেই অস্বীকার করছেন। তারা সুরা ফাতেহার মর্মবাণীও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। রাসুলে পাক সাল্লালাহুআলাইহেওয়াসসালাম এর ওফাতের পর কারবালা থেকে যে এজিদি ইসলাম আর হোসাইনি ইসলামের বিভক্তি মূলত সেই ধারাই আজো চলমান। যে কারণে অনেকেই ইসলামি লেবাস পরেও ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত। তারা হযরত মোহাম্মদ (দঃ)কে কুলকায়নাতের নবী বা মহামানব বলে স্বীকার করেন না। আল্লাহর প্রিয়বন্ধু রাসুলকে দাঁড়িয়ে কেয়াম করে শ্রদ্ধা জানাতে নারাজ। এলমে তাসাঊফ বা সুফিবাদে তারা বিশ্বাস করতে চায় না। মোরাকাবা মোশায়েদা মানেন না। অথচ ইসলাম, রোজা-নামাজ-সবই এসেছে মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে, এমনকি পবিত্র কোরানও। আল্লাহ আমাদের সত্য তরিকা বোঝার তৌফিক দিন। আমিন।
(জনাব নাসির আহমেদ বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং বিটিভির প্রাক্তন ডিরেক্টর নিউজ)