আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশ্বন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী
আমার অনেক আশেক, জাকের, মুরিদ প্রায়শ এই প্রশ্নের মুখোমুখি হন যে, আপনারা বার্ষিক ওরছ-এর সঙ্গে ‘বিশ্বজাকের ইজতেমা’ নাম কেন যুক্ত করেছেন? মোজাদ্দেদিয়া তরিকায় দীক্ষিত আমার জাকের-মুরিদরা অনেকে এ নামকরণের প্রেক্ষাপট জানলেও জনসাধারণ বা আমজনতার অনেকেই তা জানেন না। সেজন্যই হয়তো তাদের এমন প্রশ্ন। আল্লাহতায়া’লা নবী-রাসুলের পর পৃথিবীতে পীর-মাশায়েখ বা জামানার মোজাদ্দেদদের মাধ্যমে তাঁর সত্যবাণী প্রচার করাচ্ছেন। তাঁরা যা কিছু করেন, আল্লাহতায়া’লার ইচ্ছা বা ইলহামপ্রাপ্ত হয়েই করেন। এ কথা মহান আল্লাহ, রাসুল ও রাসুলের (সঃ) অনুসারী বেলায়েতে মাশায়েখদের সম্পর্কে যাদের বিশ্বাস আছে, তারাই কেবল ইলহামের গুরুত্ব বা তাৎপর্য বুঝবেন। নবী-রাসুলদের কাছে আল্লাহর ওহী নাজিল হত ফেরেশতাদের মাধ্যমে আর বেলায়েতে মাশায়েখ বা জামানার হাদীদের কাছে তা আল্লাহ পাঠিয়ে থাকেন ইলহাম। রাসুল (সঃ) কে যারা বিশ্বাস করেন তারা এ সত্য অস্বীকার করতে পারেন না। অস্বীকার করলে ঈমানহারা হতে হয়। মোজাদ্দেদিয়া তরিকার একজন খেদমতগার হিসেবে আমি আমার মহান মুর্শিদ বিশ্বঅলি জগৎবিখ্যাত মোফাসিসরে কোরআন শাহসূফী আলহাজ্ব মাওলানা হযরত কুতুবুদ্দিন আহমদ খান মাতুয়াইলী (রহ.)-এর বেছালত বা ওফাত দিবস উপলক্ষে বহু বছর ধরে প্রতি বছর বার্ষিক মহাপবিত্র ওরছ-এর আয়োজন করে আসছি।
২০১২ সালের ওরছ শরীফ আয়োজনের কিছুদিন আগে, অর্থাৎ ২০১১ সালের শেষ দিকে আমি মোজাদ্দেদিয়া তরিকার মহামূল্যবান বাণী প্রচারের আমন্ত্রণ পেয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম আকাশপথে। আমার সফরসঙ্গী ছিলেন কুতুববাগ দরবার শরীফের খাদেম ও নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব জয়নাল আবেদিন, মাওলানা তাজুল ইসলাম চাঁদপুরী, মাওলানা জোবায়ের হাসান। মালয়েশিয়ার বিমান বন্দরে অবতরণের কিছুক্ষণ আগেই হঠাৎ ওরছের নতুন নামকরণের ভাবনা আল্লাহতায়া’লা আমার মনে উদয় করিয়ে দিলেন। তখন মাওলানা জোবায়ের হাসানকে বললাম, নতুন এ নামকরণটি কাগজে লিখে রাখতে যাতে ভুলে না যাই। তারপর থেকেই কুতুববাগ দরবার শরীফের মহাপবিত্র ওরছ শরীফ-এর সঙ্গে যুক্ত হলো বিশ্বজাকের ইজতেমা। অর্থাৎ ‘মহাপবিত্র ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমা’। জাকের শব্দটির সরল অর্থ জিকিরকারী আর ইজতেমা শব্দের অর্থ একত্রিত, সমবেত বা জমায়েত হওয়া। সুতরাং এখানে শুধু জিকিরকারী নয়, ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদেরও মহামিলন। এ প্রসঙ্গেই তরিকার সংক্ষিপ্ত পরিচয় আবশ্যক।
মহানবী রাসুল (সঃ)-এর ওফাতের পর তাঁর চারজন খলিফা কতৃক প্রবর্তিত হয়েছে চারটি তরিকা। এগুলো হচ্ছে, কাদরীয়া, চিশতীয়া, নকশ্বন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া এই তরিকতের যারা ভক্ত-অনুসারী, তাদের বাইয়াত পড়িয়ে নিজ নিজ পীর বা মুর্শিদ ভক্ত-মুরিদদের প্রথমেই যে শিক্ষা, সবক বা আমল দেন, তা হলো কাল্বের জিকির। এই জিকিরকারীদের তরিকতের ভাষায় বলা হয় জাকের। সুতরাং ইসলামের যে অনুষ্ঠানে জিকির থাকে না, রাসুলের (সঃ) শানে দরূদ-কিয়াম থাকে না, তা আর যা-ই হোক ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কারণ, ইসলাম শুধু শরিয়তে নয়, তরিকতে নয়, হাকিকতে নয়, মারেফতেও নয়। এই চারটি বিষয়ের সমন্বয়েই পরিপূর্ণ ইসলাম। তাই নবীকরীম (সঃ)-এর শানে দরূদ-মিলাদ-কিয়াম যারা করে না, ‘বেদাত-বেদাত’ বলে রাসুল-বন্দনা উপেক্ষা করেন এবং রাসুল (সঃ)কে সাধারণ মানুষের মতো মনে করেন, তাদের ইজতেমার চেয়ে মহান আল্লাহর নামের জিকিরকারীদের ইজতেমা যে কোটি কোটি গুণে উত্তম এবং ইসলামের পরিপূর্র্র্র্ণ আমল, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। হয়তো সেজন্যই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, আমি অধমের মাধ্যমে আল্লাহর জিকিরকারীদের মহাপবিত্র ওরছ শরীফের সাথে এই বিশ্বজাকের ইজতেমা চালু করিয়েছেন। যে রাসুল (সঃ)কে সৃষ্টি না করলে মহান আল্লাহতায়া’লা মাখলুকাতের কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। যার উম্মত হতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন তাঁর পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসুলগণ, সেই দয়াল নবীজির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকারীদের জন্য এই জাকের ইজতেমার ব্যবস্থা করতে পেরে পরম করুণাময় আল্লাহতায়া’লার দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করি। আর একটা কথা না বললেই নয়, তা হলো বিভিন্ন সময়ে অনেকেই অবাক হন যে, এই ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমায় সরকারী কোন অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা নেই, কোন কোম্পানীর স্পন্সরশীপ নেই, শুধু জাকের-মুরিদদের আন্তরিক ভালোবাসা ও খেদমতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই লাখ লাখ মানুষের মহামিলনমেলায় এত সুন্দরভাবে সবার থাকা-খাওয়ার সু-ব্যবস্থা করিয়ে দেন!
কয়েক বছর আগে সরকারের একটি সংস্থার কতিপয় সদস্য আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, এই যে তিনদিন ধরে দিন-রাত্রি অসংখ্য মানুষ তবারক খেলো, শত-শত উট, মহিষ, গরু, খাশি জবেহ করা হলো, ওরছ শরীফ শেষে পরদিন আমরা লক্ষ্য করে দেখলাম সবকিছু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কোথাও এক টুকরো হাড়-হাড্ডিও দেখা গেল না! এগুলো আপনি কীভাবে ম্যানেজ করেন হুজুর? আর এতসব খাবারের ব্যবস্থাই বা কোত্থেকে হয়? আমি তাদের বলেছিলাম, মহান আল্লাহতায়া’লাই চালান। তবে এখানে কিছু জাকের আমাকে দেয় আর আমি তা সকল জাকের-মুরিদ মানব সেবায় বণ্টন করে দেই। এর মধ্যে কিছু জাকের খাবার পরিবেশন করে আর কিছু জাকের তাৎক্ষণিক ঝুটা-কাটা পরিস্কার করে ফেলে। আমার এই দরবারের ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমায় দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ আশেক, জাকের, জাকেরিন আসেন, তারা একে অন্যের খেদমত করেন। জাকের-মুরিদের এই যে, স্ব স্ব আত্মশুদ্ধি শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানবসেবা করে আল্লাহকে রাজি, খুশি করার সাধনা আর এটাই সঠিক পথ। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়া’লা অতি খুশি হয়ে এর মধ্যেই এত রহমত, বরকত ও নেয়ামত দান করে থাকেন! নেয়ামতের কথা যখন উঠলই, তখন ঐতিহাসিক মহাপবিত্র ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার তবারকের কথাও বলতে হয়। আমার অনেক আশেক-জাকের-মুরিদ বলেন, বাবা দেশে-বিদেশে অনেক খাবার খেয়েছি কিন্তু ওরছ শরীফের তবারকের মতো এমন সুস্বাদু খাবার কোথাও খাইনি। কীকরে এমন স্বাদ হয়! আমি তাদের এ প্রশ্নের উত্তর বহুবার দিয়েছি, এখনও দিতে হয়। কারণ আমার ৩৫ লাখ জাকের-মুরিদ এখন। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এর সংখ্যা। সুতরাং এই প্রশ্ন শুনতেই হবে। মহান আল্লাহর অশেষ নেয়ামত হিসেবে তৈরি হয় এই তবারক। বিশেষ করে কোন বিমারী তার রোগ শেফার নিয়ত করে এক লোকমা তবারক খেলে আল্লাহতায়া’লা রোগমুক্ত করে দেন। আমার বহু জাকের-মুরিদের কাছ থেকে এই তবারকের অলৌকিক শক্তির কথা শুনেছি। সুতরাং রাসুল (সঃ)-এর সত্য তরিকার এই মহাপবিত্র ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার এক লোকমা তবারক অতি নেয়ামত ও বরকতপূর্ণ।
প্রতি বছর আখেরী মোনাজাতে বিপুলসংখ্যক আশেক, জাকের, মুরিদ ও বেজাকের অংশগ্রহণ করে থাকে। অসীম দয়ালু আল্লাহ এই আখেরী মোনাজাতের উছিলায় বহু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন। তাই আখেরী মোনাজাত ও তবারকের গুরুত্ব যে কত গভীর তা লিখে বোঝানো যাবে না। আখেরী মোনাজাতে শুধু দৃশ্যমান কয়েক লাখ মানুষই উপস্থিত থাকেন না, অদৃশ্যভাবে থাকেন অসংখ্য নবী-রাসুল, অলি-আল্লাহ ও ফেরেশতার পাক আত্মা। যাদের কাশ্ফ খোলা কেবল তারাই দিলের চোখে দেখতে পান তাঁদের। আর সেজন্যই কুতুববাগ দরবার শরীফের বার্ষিক মহাপবিত্র ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার আখেরী মোনাজাতে শামিল হয়ে অনেক জটিল-কঠিন রোগের রোগীরা সুস্থ হয়েছেন। তারা দাখিল হয়েছেন মোজাদ্দেদিয়া তরিকায়। বহু বিপদগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্ত মানুষ বিপদ ও ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে এই তরিকার খাদেম হয়ে গেছেন। এই মোনাজাতে হাত তুলে অনেক গরিব তার দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন, অনেক বেকার চাকরি পেয়েছেন। আরো যে কত লোক কতভাবে উপকৃত হয়েছেন, তার খবর একমাত্র আল্লাহতায়া’লাই ভালো জানেন! হে আল্লাহ! সবাইকে অলি-আউলিয়াদের মহা-আত্মার এই মহামিলনের বার্ষিক আয়োজনে শামিল হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।