মহাপবিত্র ওরছের তাৎপর্য

আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

‘ওরছ বুযুর্গ ইয়া মুদির্শীকী ছালানা ফাতেহাকী মজলিশ জু-তারিখী ওফাত কো হুয়া কারতিহে’। অর্থ: ওরছ বুযুর্গাণে দ্বীন’। অর্থাৎ, পীর-মুর্শিদগণের ‘সালানা’ ফাতেহার অনুষ্ঠানের তারিখে তাঁরা ইন্তেকালপ্রাপ্ত হন। উর্দু ও ফার্সি অভিধানে ‘ফিরোজুল্লুগাতে’ ওরছ শব্দের হাকিকী ও মাজাজী অর্থের বর্ণনায় লেখা হয়েছে, ‘ওরছ বুযুর্গ ইয়া মুর্শিদীকি ছালানা ফাতেহাকী মজলিশ, জুতারিখী ওফাতকো ছাদিকী দাওয়াত ত্বয়ামে ওলীমা জামে আরসু’ (ফিরোজুল্লুগাত) অর্থাৎ ওরছ। (১) কোন বুযুর্গ অথবা পীর-মুর্শিদের ইন্তেকালের ‘সালানা’ তারিখ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ফাতেহাখানির অনুষ্ঠান। (২) বিবাহের দাওয়াত, ওলিমার খানা, বহুবচন আরুসু। Anniversary in memory of a Saint. অর্থাৎ, সূফীসাধকের ইন্তেকাল বার্ষিকীর স্মরণে আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ওরছ বলে। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ওরছ শব্দের নিম্নোক্ত অর্থ লেখা আছে, অলি দরবেশদের বেছালাত বা ওফাত তাদের সমাধিস্থলে পবিত্র অনুষ্ঠান বিশেষ।

‘নাম কানাউমাতিল উরুসিল্লাতি লাইউকজুহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহি এলাইহি’।
অর্থাৎ, (কবরে নেক্কার সালেহীন ব্যক্তিকে বলা হয়) তুমি এখানে বাসর ঘরের দুলহার মতো পরমানন্দে ঘুমাতে থাক, যার ঘুম তার পরিবারের সর্বাধিক প্রিয়জন ব্যতীত অন্য আর কেউ ভাঙতে পারে না। (তিরমীজি শরীফ ও মেশকাত শরীফ ১ম খন্ড, পৃ: ৯৭, দ্রষ্টব্য: ইশবাতি আযাবুল কবর অধ্যায়)। এই হাদিস শরীফের মিছদাক হিসাবে ‘ওরছ’ শব্দকে ‘মানবকুলে শরয়ী’ বলে গ্রহণ করা যায়। হাদিস শরীফে উল্লেখিত এই ওরছ শব্দে গুরুত্ব ও তাৎপর্য গ্রহণ করেই সূফীগণ আল্লাহর অলিগণের ইন্তেকাল দিবসকে ‘ইয়াউমুল ওরছ’ বা ওরছ শরীফ নামকরণ করেছেন। কারণ, ইন্তেকালের এই দিনে মিলনাকাংক্ষী আল্লাহর অলিগণ মাহবুবে হাকিকী অর্থাৎ, প্রকৃত বন্ধুর একান্ত দীদার লাভ করে আকাংক্ষিত আত্মিক মিলনের পরমানন্দে বিভোর হয়ে যান। হাদিস শরীফে আল্লাহর অলিগণের পরম সুখকর এই আত্মিক অবস্থাকে আপেক্ষিক অর্থে বাসরঘরের দুলহার সঙ্গে পরম প্রশান্তিময় সুখনিন্দ্রার তুলনা করা হয়েছে। আরোও বলা হয়েছে, যে সুখনিদ্রা হতে তাকে শুধু তার আপন মাশুকই জাগাতে পারে, অন্য কেউ নয়। এখানে সুখনিদ্রা বোঝাতে পবিত্র আত্মাসমূহের পারলৌকিক চির পরিতৃপ্ত জীবনের কথা বলা হয়েছে, যা ভঙ্গ করার অধিকার অন্য কারও নাই। সুবিখ্যাত জা’আল হক কিতাবের দ্বিতীয় খন্ড ১৪৪ পৃষ্ঠায়, ওরছ শব্দের উৎপত্তি এই মানকুলে শরয়ীর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, উরসের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে শাদী। এ জন্যই বর-কনেকে আরবী ভাষায় ওরছ বলা হয়। বুযুর্গাণে-দ্বীনের ইন্তেকাল দিবসকে এজন্যই ওরছ বলা হয় যে, মিশকাত শরীফে ইশবাতি আযাবুল কবরী শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, যখন মুনকার নাকির মাইয়্যাতের পরীক্ষা নেয় এবং যখন সে সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় তখন তাকে বলেন, ‘নাম কানাউমাতিল উরুসিল্লাতি লা ইউকিজুহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহি এলাইহি’। অর্থ: আপনি সেই দুলহার মত শুয়ে পড়ুন, যাকে তার আপনজন ছাড়া আর কেউ জাগাতে পারে না। তাই মুনকার নাকির ফিরিশতাদ্বয় যেহেতু ঐ দিনকে ‘উরুস’ বলেন, সেহেতু ওরছ বলা হয়। অথবা এজন্য যে, ঐ দিন জামালে মুস্তফা (সঃ)-কে দেখার দিন। মুনকার নাকির হুজুুর (সঃ)-কে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন, ওনার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা ? তিনিই তো সৃষ্টি জগতের দুলহা, সারাজগত তারই স্পর্শের প্রতিফলন। মহান আল্লাহতালার সেই বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন নিশ্চয়ই উরসের দিন, এজন্যই এ দিনকে ওরছ বলা হয়। (আস্তা মা আমান আহব্বাবতা) অর্থাৎ, তুমি যাহাকে ভালোবাস আখিরাতে তুমি তাহারই সঙ্গে থাকিবে। হাদিস শরীফের এই সূত্র অনুযায়ি আল্লাহর অলিগণ যখন নশ্বর ভুবন ছেড়ে, অবিনশ্বর ভুবনে গমন করেন তখন তা মাহবুবে হাকিকী অর্থাৎ, প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে চিরায়ত মিলনকক্ষে মিলিত হন। হাদিস শরীফে প্রেমাষ্পদের দিকে প্রেমিকের এই মিলনমুখী অভিযাত্রার বিষয় বলা হয়েছে। মৃত্যু সেতু তুল্য বন্ধুকে বন্ধুর সঙ্গে সম্মিলিত করিয়া দেয়, (মাকতুবাত শরীফ ১ম খন্ড ১ম পৃষ্ঠা)। উল্লেখিত হাদিসসমূহে এবং আয়াতে কারিমায় আল্লাহর অলিদের ইন্তেকালের দিনকে পরমবন্ধুর সঙ্গে মিলনের দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের জন্য ইন্তেকালের দিনটি হয় পরম সান্তনার, পরম তৃপ্তির এবং পরম সুখের। ‘মেছবাহুল লোগাতে’ ওরছ শব্দের হাকিকী অর্থে আনন্দ বা খুশিতে আল্লাহতায়লার সঙ্গে মহামিলন বলা হয়েছে। সুতরাং আউলিয়া কেরামের ইন্তেকালের দিনকে ইহ্‌য়াউমুল ওরছ বা ওরছ শরীফ নামকরণ করার সঙ্গে পবিত্র কোরআন হাদিস এবং আভিধানিক (হাকিকী ও মাজাজী) অর্থের কোথাও কোন অসামঞ্জস্য বা বিরোধ নাই।

ওরছ শরীফ নামকরণের হাদিসানুগ অন্য একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, আউলিয়া কেরামের আরওয়াহপাকের হুজুরে ছওয়াব রেছানী, ফাতেহাখানি বা ইছালে ছওয়াবের অনুষ্ঠানকে এজন্যই সূফীগণ ওরছ শরীফ নামকরণ করেছেন। বিভিন্ন হাদিস শরীফের বর্ণনায় ‘ইছালে ছওয়াব’ বা ‘ছওয়াব রেছানী’ অনুষ্ঠানকে আত্মার জন্য, পরম খুশির বা আনন্দদায়ক বলা হয়েছে। যেমন, হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে আত্মীয়ের নিকট হইতে উপহার স্বরূপ কোন দান বা দোয়া যখন কোন ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির রুহে পৌঁছে, তখন সে এরূপ আনন্দিত হয়, যেমন জীবিত ব্যক্তি উপহার পেয়ে আনন্দিত হয়ে থাকে! (এহ্‌য়া উল উলুম দ্রষ্টব্য)। বায়হাকী শরীফে বর্ণিত অনুরূপ একটি হাদিসে বলা হয়েছে- ‘নাম কানাউমাতিল উরুসীললাতি লা ইউক্বিজাহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহি ইলাইহ্’। অর্থাৎ, অতঃপর কবরবাসী ব্যক্তি তার পিতা-মাতা, সন্তান সন্ততি অথবা বন্ধু-বান্ধবদের নিকট হইতে দোয়া কামনা করে। তদাবস্থায় যদি কেউ তার জন্য দোয়া করে, তবে সে এত অধিক খুশি হয় যে, জীবিতাবস্থায় সমস্ত দুনিয়া উপহার হিসাবে পাইলেও সে এতো খুশি হইত না। যেহেতু ওরছ শব্দের আভিধানিক এক অর্থ ‘খুশি’ বা ‘আনন্দ’ (মেছবাহুল লোগাত দ্রষ্টব্য)। সেহেতু আত্মার জন্য আনন্দদায়ক ছওয়াব রেছানীর এই অনুষ্ঠানকে ওরছ নামকরণ করার মধ্যে কোন ভ্রান্তি বা অসামঞ্জস্যতা নাই। আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত যখন আল্লাহর অলি ও বুযুর্গ কামেলপীর মুর্শিদদের নামে ওরছ অনুষ্ঠান করে থাকি, তখন ঐ সমস্ত মহা আত্মাগণ জীবিত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করেন যা আল্লাহর কাছে অতি পছন্দনীয়।

পরিশেষে ওরছ প্রসঙ্গে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, কোন কোন স্থানে ওরছ উপলক্ষে শরার বেআইনী শরিয়ত ও মারেফতের বিরোধী কর্মকান্ড হইয়া থাকে, এই অজুহাতে মহাপবিত্র নির্দোষ ওরছকে নাযায়েজ আখ্যায়িত করা নিরেট মূর্খতা। যাহারা হক্কানী আলেম নায়েবে রসুল, তাহারা আধ্যাত্মিক কার্যক্রমভিত্তিক ওরছকে জায়েয এবং মোস্তাহছান বলে থাকেন। ইহার আধ্যাত্মিক কার্যক্রম সমূহের মধ্যে পবিত্রতার মহা উপাদান আছে, কাজেই ইহা পবিত্র অনুষ্ঠান হিসাবে বিবেচ্য হইয়া থাকে। ওরছ মোবারক শরিয়ত ও মারেফত অনুসারীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ খাস অনুষ্ঠান। উক্ত অনুষ্ঠানে গুরুত্বসহকারে ওয়াজ নসিহতের তালিম, জিকির-আজগার, মোরাকাবা-মোশাহেদার মাধ্যমে তাসাউফের আদর্শ মতবাদ ও শিক্ষা প্রচার করা হয়। হযরত মহানবী (সঃ) এবং তদীয় মহান ‘আহলে বায়েত’-এর প্রতি মহব্বতের অপরিসীম আধ্যাত্মিক গুরুত্ব, আউলিয়া কেরামের প্রতি মহব্বতের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং আত্মিক উৎকর্ষ সাধন করার জন্য ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি বা ইলমে মারেফতের সম্যক তাৎপর্য এবং ইহার অপরিহার্য্যতা ব্যাখ্যা করার নিমিত্ত ওরছ মোবারকের মধ্যে, ওয়াজ নসিহতের কার্যক্রম নির্ধারণ করা হইয়া থাকে যাহাতে অজ্ঞানতার অন্ধকারে পথহারা মানুষ প্রকৃত সত্য শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের আদর্শভিত্তিক তরিকায় চলিতে পারে। এইভাবে ওরছ মোবারকের মধ্যে আউলিয়া কেরামের যেসকল জীবনাদর্শ, নসিহত বা মতবাদ প্রচার করা হয় তাহা পবিত্র কোরআন এবং হাদিস শরীফের পর পরই আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বহন করে। ওরছ মোবারক তাসাউফের আদর্শ মতবাদ প্রচার প্রসার বিস্তৃত ঘটানোর লক্ষ্যে এই বিশেষ মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমায় উপস্থিত থাকিয়া বরকতপূর্ণ দোয়ার মজলিশে আপনারা নিজেদের, পিতা-মাতা ও বংশধরদের মধ্যে যাহারা দুনিয়া হইতে বিদায় নিয়াছেন, তাহাদের আত্মার মাগফিরাত ও নাজাতের জন্য, নিজেদের আত্মশুদ্ধি ক্বলবের ছালিম ও আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য, জরাব্যাধি, বালা-মসিবত কঠিন রোগ-বিমার ও অভাব, দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য এই দোয়ার মজলিশে হাজির হইয়া মোনাজাত শেষে এক লোকমা বরকতপূর্ণ তাবারক ধৈর্র্য্যসহকারে গ্রহণ করিবেন।

(Visited 468 times, 1 visits today)
Share