সেহাঙ্গল বিপ্লব আল মোজাদ্দেদি
একটা ছোট্ট গল্প বলে তারপর প্রসঙ্গ আলোচনা! এক বদ্ধ কুয়ায় ব্যাঙ, জন্মের পর থেকে সেখানেই সে বাস করে আসছিল। হঠাৎ সে একদিন ভাবছে, এর চেয়ে বড় কুয়া বা জলাশয় আর নাই! এটাই পুরো পৃথিবী। এরপর হঠাৎ একদিন বানের পানি এসে কুয়াটি ভরে গেল। এত পানি দেখে ব্যাঙটি গাছে উঠে বসে থাকলো। ভাটায় পানি নামতে থাকলে ব্যাঙ গাছ থেকে নেমে গা ভাসিয়ে দিল এবং এক সময় সে খালের নাগাল পেল। ব্যাঙ এবার মনে-মনে বলছে, এতদিন কোথায় ছিলাম? এটা আরো বড় পৃথিবী! সেখানেও তার বেশ কিছু দিন কেটে যাবার পর ভাসতে ভাসতে একদিন নদীতে এসে পড়ে। এবারও তার নতুন করে বোধোদয় ঘটে যে, এতদিন যেখানে ছিলাম এটা তার চেয়েও বড় পৃথিবী। তাই মহা আনন্দে এখানেও তার কিছু দিন কাটলো। এরপর নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে একদিন সেই ব্যাঙ সাগরে এসে পড়ে। এবার মনে-মনে বলছে, হায়রে! এতদিন যা ভেবেছি তা সবই ছিল ভুল। ব্যাঙ এবার অবারিত অথৈ জলরাশি পেয়ে মুক্তির স্বাদ পেতে থাকলো। তার মানে অজ্ঞতাই চিন্তার বিশালত্বকে স্পর্শ করতে দেয় না। পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে। এ গল্পের মতো চিন্তা-ধারা কিছু মানুষের মধ্যেও কম বেশি দেখা যায়। এ বিষয়ে নিচের প্যারায় সংক্ষেপ কিছু বলছি।
পরম শ্রদ্ধেয় জাকের ভাই বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি নাসির আহমেদ আল মোজাদ্দেদি, খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ-মহব্বত করেন। তাঁর সঙ্গেই অনেক দিন আগে মহান আল্লাহ মেহেরবানিতে কেবলাজানের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। সেদিন দরবার শরীফে এসে কেবলাজানের নূরাণী চেহারা মোবারক দেখে চমকে উঠেছিলাম। সেই সময় তাঁর হুজরা শরীফে অল্প আলো জ্বলছিলো, কিন্তু সে আলোকে ম্লান করে যেন কেবলাজানের চেহারা মোবারকের নূরেই হুজরার ভিতর বেশি আলোকিত, যেন ঝলমল করছিল পুরোটা কামরা। আজও চোখের সামনে ভাসে সেই দৃশ্য। এরপর তাঁর পবিত্র হাতে হাত রেখে তওবা-এ নসুহা পাঠের মাধ্যমে তরিকতের দীক্ষা গ্রহণ করে নতুন এক জীবন ও জগতের খোঁজ পেলাম। যা আমার কাছে ছিল এ নিবন্ধ শুরুর গল্পের মতো। কেবলাজানের পবিত্র মুখে শুনেছি- ‘রাসুল (সঃ) বলেন, শরিয়ত আমার বাক্য, তরিকত আমার কাজ, হাকিকত আমার অবস্থান এবং এলমে মারেফত আমার নিগুঢ় ভেদ-রহস্য।’ আরো জেনেছি, শরিয়তের আমলের দ্বারা তরিকতের-পথ সহজ হয় এবং হাকিকতের আমলের মাধ্যমে এলমে মারেফতের সাক্ষাৎ বা স্বাদ পাওয়া যায়।’ দেশের অনেক হাফেজ-ক্বারী, মুফতি, মাওলানা সাহেবদের ওয়াজ-বয়ানসহ বড় বড় রাজনীতিকদের ভাষণ-বক্তৃতাও শুনেছি। এছাড়া গত বিশ বছরে দেশের অনেক নামদামী কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-ছাত্র ভাই-বন্ধুদের সঙ্গেও আল্লাহর রহমতে কম বেশি আলাপ পরিচয়সহ চেনা-জানার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কুতুববাগী কেবলাজান ছাড়া অন্য কারো কাছেই এমন অমিয় বাণী আর শুনি নাই। এত নির্মল কোমল স্নেহ-ভালোবাসা আর কোথাও পাইনি। প্রতিনিয়ত আশেক-জাকের ও ভক্ত-মুরিদদের মেহমানদরী করা কেবলাজানের অন্যতম এক বিশেষ গুণ, অন্তত এক লোকমা তাবারক না খেয়ে খালিমুখে তাঁর দরবার থেকে কখনো কাউকে যেতে দেখিনি। বার মাসের প্রতিদিনই চব্বিশ ঘণ্টা দরবারের লঙ্গরখানা চালু, কে দেয়, কোত্থেকে আসে এত খাবার? বোঝা মুশকিল। এসবই আল্লাহর অলৌকিক কেরামতি, এ ছাড়া আর কী হতে পারে?
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে জোর আদেশ করেছেন যে ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামে দাখিল হও।’ এ আয়াতে ঈমানদার অর্থাৎ বিশ্বাসী, যারা পবিত্র কোরআন ও আল্লাহর প্রিয়হাবীব (সঃ)-কে বিশ্বাস করে তাদের উদ্দেশ্যেই আহ্বান করেছেন। অবিশ্বাসীদের জন্যও উন্মুক্ত যদি তারা বিশ্বাস করে। একবার কালিমা পাঠ করলেই মুসলমান হওয়া যায়, আবার নতুন করে বিশ্বাস কেন করা লাগবে? আমরা জন্মসূত্রে সবাই মানুষ, বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে বা গোত্রে জন্মেছি! এতে আমাদের কোন হাত নাই। আল্লাহর কাজ সুনির্দিষ্ট এবং সার্বজনিন, তাই তো উল্লেখিত আয়াতের যে শান্তির পথে মরমী আহ্বান, তা সকল মানুষের জন্য সমান, কেউ তা মানি আর না মানি। কালিমা পড়ে মুসলমান হলেই কেবল ইসলামে পরিপূর্ণ দাখিল হওয়া বোঝায় না। দাখিল হতে হলে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত সমন্বিত আমল-চর্চা, শারীরিক, মানসিকসহ সার্বিকভাবে মহাসাধক এক আল্লাহর নৈকট্যলাভকারী হওয়া লাগবে। যে কামেলের ভিতরে এসব গুণ ও জ্ঞান মাধুর্য দিবালোকের মতো স্বচ্ছ, যাঁর বাণী, আদর্শ ও ব্যবহারে মানুষ শুধু উপকৃত হবেন না, শান্তি ও মুক্তির পথ পাবেন। তিনি হলেন হক্কানী পীর বা মুর্শিদ। আমার পরম পাওয়া মুর্শিদ কেবলাজান খাজাবাবা কুতুববাগীর মধ্যে এসকল বৈশিষ্ট মহান আল্লাহ পরিপূর্ণভাবে দিয়েছেন। কেননা দো’জাহানের মালিক আগেই জানতেন যে, সৃষ্টিজগতের জন্য কোরআনে সঠিক নির্দেশনা থাকার পরেও তাঁর প্রিয় আদমজাতি ভুল পথে, ভুল মতে চলবে, বিভেদ সৃষ্টি করবে। নবী-রাসুলদের পরে কামেল অলি-আউলিয়ারা দেখাবেন, ‘ইহ্ দিনাস ছিরওয়াত্বাল্লাজ্বীনা’র মতো সহজ-সরল ক্ষমাশীল পথ। পবিত্র কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এতে আল্লাহর বাণীমোবারক আছে, ভাষা আছে, শুধু মুখ নাই, তবে তাঁর মুখপাত্র আছেন, যাঁদের সিনা মোবারকে গচ্ছিত সৃষ্টি ও স্রষ্টা ভেদের মহা নূর নিয়ামত আর বাতেনি জ্ঞান। সেই নূর মোবারকের তাজ্বাল্লিতে নূরান্বিত হয় মহাসাধকের সর্বাঙ্গ। যিনি নিজেই পবিত্র কোরআনকে ধারণ করে থাকেন, দেখলেই মনে হয় যেন এক নূরের পুতুল! অগণিত আশেক জাকের ভাই-বোনদের আত্মার বাবা, খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান সত্য জীবন-পথের সন্ধানদাতা। তাঁকে এক নজর দেখলে যেন মুহূর্তে একরকম স্বর্গীয় শান্তিতে মন ভরে ওঠে। যতবার দেখি ততবারই।
মুর্শিদ কেবলাজানের নূরাণী হাতে বাইয়াত না নিলে হয় তো কখনো জানতে পারতাম না ইসলাম ধর্মেও শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত আর মারেফত কী বস্তু? আমি অতি নগণ্য সেই থেকে দরবার শরীফে সরল মনে কেবলাজানের মহব্বতে আসা-যাওয়া করতে থাকি। ধীরে ধীরে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করছি ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত অপরিহার্য এ বিষয় সম্পর্কে, যা প্রত্যেক মানুষেরই সাধ্যমত জানা ও নামা দরকার। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, এক মাবুদ আল্লাহর সৃষ্টি হলেও আমাদের জানা-শোনা, দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন। কোন কোন ক্ষেত্রে মতের মিল দেখা গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অমিল দেখা যায়। যেমন একই বিষয় নিয়ে আপনি যা ভাবছেন, আমি তা ভাবছি না, আবার আমি যা ভাবছি, আপনি তা ভাবছেন না। তবে এ কথা ঠিক যে, মানবজীবন কোন তর্ক নয়, জীবনকে সঠিক যুক্তি দিয়েই বুঝতে হয়। যেখানে তর্ক ব্যর্থ, সেখানে যুক্তিই সফল। কেউ যদি মনে করি, উচ্চতর লেখাপড়া করেছি, ব্যবসা-বাণিজ্য করি, বড় পদে বিশাল দায়িত্ব পালন করছি, আয়-রোজগারও কম নয়। বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স সবকিছু মিলে সুখেই তো আছি। তাহলে পীরের কাছে কেন যাবো? কী হবে তাঁর কাছে গিয়ে? তিনি কী শিখাবেন?’ তাকে বলি, আসলেই কামেল পীর শুধু জাত-পাত দুটিই গড়ে দিতে পারেন। তবু অনেকেই বুঝে অথবা না বুঝে এমন রগচটা দাম্ভিক কথাবার্তা বলে ফেলি। এই দাম্ভিকতার তাপে আশেপাশের সাধারণ মানুষের অন্তর-আত্মাও পুড়ে যায়, কারো আত্মায় হাল্কা তাপ লাগতেই সরে আসে। তখন তাদের অন্তরে আল্লাহ-রাসুলের প্রেম-মহব্বত থাকে না, জামানার অলি-আউলিয়াদের প্রতিও ভক্তি-শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। আদব-ভক্তি নিয়ে কামেল পীরের দরবারে আসলে, হারানো প্রেম-বিশ্বাস আবার ফিরে পায়। হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি তোমার প্রিয়অলি-বন্ধুর দেখানো সত্য-শান্তির পথে রেখো, যে পথ একান্ত তোমারই দিকে বহমান…
লেখক :