এ কে এম শফিকুল আলম
আমার দরদী মুর্শিদ ইহকাল ও পরকালের বান্ধব আরেফে কামেল, মুর্শিদে মোকাম্মেল, মোজাদ্দেদে জামান, শাহসূফী আলহাজ মাওলানা খাজাবাবা সৈয়দ জাকির শাহ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী (মাঃ জিঃ আঃ) কেবলাজানের সাথে আমার কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়, ২০১৪ সালের মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার আখেরী মোনাজাতে। আমি তখন দৈনিক বর্তমান পত্রিকায় চাকুরিরত। এ পত্রিকারই যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট কবি নাসির আহমেদ ভাইয়ের সাথে আমার দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক। আমরা দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকাতে অনেক বছর একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। বর্তমান পত্রিকাতে থাকা অবস্থায় আরেক সহকর্মী রিয়াজ শাহী ভাই ও আমি সার্কুলেশন বিভাগে কাজ করতাম। শাহী ভাইয়ের তখন লিভারের সমস্য খুব বেশি। একদিন নাসির ভাই, আমি ও শাহী ভাইসহ দুপুরে খাওয়ার সময় নাসির ভাই হঠাৎ বললেন, আগামী শুক্রবার বাদজুমা কুতুববাগ দরবার শরীফের ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার আখেরী মোনাজাত। কেবলাজান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে মোনাজাত করবেন। আপনারা আসেন বাবাকে দেখলে ভালো লাগবে। আমরা নাসির ভাইয়ের দাওয়াত পেয়ে ঠিক সময় মত সকাল ১১ টায় মূল মঞ্চে বসে বয়ান শুনতে থাকি। বেলা ১২:২০ মিনিটে কেবলাজান লাল গালিচার উপর দিয়ে হেঁটে এক দল খাদেম ভাইদের নিয়ে মঞ্চে উঠে আসন গ্রহণ করলেন। আমি অধিক আগ্রহ নিয়ে কেবলাজানকে দেখতে থাকি। কেবলাজানকে দেখার পর আমার দৃষ্টি শুধু তাঁর নূরানী চেহারা মোবারকের দিকেই যেন আর কোথাও দৃষ্টি সরাতেই মন চাইল না। আর তখন মনে মনে ভাবতে থাকলাম আমি আমার জীবনের ঠিকানা খুঁজে পেয়ে গেছি। মোনাজাতের পর কেবলাজানের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় নাই। নাসির ভাইয়ের সাথে দরবার শরীফের ৫ম তলায় গিয়ে তাবারক খেয়ে বাসায় চলে গেলাম। এর দুই দিন পর ওরছের কর্মী ভাইদের ছুটির অনুষ্ঠান হবে বাদ এশা। আবারও সেদিন দরবার শরীফে আসলাম। অনুষ্ঠান শেষে তাবারক খেয়ে চলে গেলাম। তখনও কেবলাজানের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় নাই। দুইদিন পর আমি শাহী ভাইকে নিয়ে কেবলাজানের খাদেম ইসমাইল হোসেন বাবু ভাইয়ের মাধ্যমে দরবার শরীফের ১০ম তলায় ‘দায়রায়ে জান্নাতুল মাওয়া’ বাবাজান কেবলার হুজরা শরীফে গিয়ে তরিকা গ্রহণ করি। শাহী ভাই বাবাজানের কাছে যাওয়ার পর বাবা নিজ থেকেই বললেন, বাবা, আপনার লিভারে সমস্যা? শাহী ভাই বললেন, হ্যাঁ। এরপর বাবাজান শাহী ভাইয়ের পেটে হাত দিয়ে বললেন, যান বাবা, উপরওয়ালা ভালো করে দিবেন। সে দিনের বাবাজানের কথা আমার আজও মনে পরে। বাবাজান শাহী ভাইকে বলে দিয়েছিলেন, রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাকে দেখাবেন। তখন শাহী ভাই ল্যাবএইডে ডা. সেলিমুজ্জামানের (লিভার বিশেষজ্ঞ) কাছে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ল্যাবএইডে পরীক্ষার একুশ দিন পর রিপোর্ট দিলেন। রিপোর্ট দেখার পর ডা. সেলিমুজ্জামান অবাক হয়ে বললেন, এটা কী করে সম্ভব?! এটা আল্লাহতায়ালার হুকুম ছাড়া কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। পর দিন বর্তমান পত্রিকা অফিসে দুপুরে শাহী ভাই ও আমি নাসির ভাইকে বললাম, বাবাকে রিপোর্ট সম্পর্কে জানানোর ব্যাপারে। নাসির ভাই বাবাকে ফোনে বলার পর বাবা বললেন, আমি জানি, উপরওয়ালা আমাকে জানাইছেন রিপোর্ট ভালো। এ কথা শোনার পর আমরা অবাক হলাম কেবলাজানের একি কেরামতি! আর এভাবেই কুতুববাগ দরবার শরীফে খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের সান্নিধ্যে আমাদের আসা শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত বাবাজানের কত রকম কেরামতি দেখছি আমার চোখে এবং গভীরভাবে অনুভব করছি বাবাজানের আধ্যাত্মিক গুণের কথা। গত ৩০ আগস্ট ২০১৪ সাল, শনিবার। নারায়ণগঞ্জ, বন্দর থানাধীন পুরনো রেলস্টেশন, স্বল্পেরচকে কুতুববাগ দরবার শরীফের জামে মসজিদ এর ভিত্তি স্থাপনের দিন। আশেক-জাকের ভাইদের কাফেলা ছাড়াও হাজার হাজার মানুষ এসেছিল ওই দিন, এত মানুষের মধ্যেই কী অলোকিক ঘটনা! যেন ঘোষণা দিয়েই প্রমাণ করলেন তিনি বর্তমান সময়ের মোজাদ্দেদ। অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে কেবলাজান, সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেব, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ‘এলজিআরডি’ প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপিসহ আরও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য-সহ ওলামায়ে-কেরামগণ উপস্থিত ছিলেন। রৌদ্রোজ্জল দিন বাবাজান কেবলা যখন তাঁর মহামূল্যবান নসিহত বয়ান করছিলেন। এমন সময় দেখা গেল এক খন্ড মেঘের উদয়, বাবাজান তাঁর বয়ানে তখন বলছিলেন, কোন শুভ কাজের আগে বৃষ্টি হওয়া ভালো। আপনারা চিন্তা করবেন না। অনুষ্ঠান সংক্ষেপ করা হল, বাবাজান অথিতিদের নিয়ে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করলেন। কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য আশেক-ভক্ত নিয়ে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর শেষে দোয়া পড়ে মোনাজাত করে বাবাজান তাঁর হুজরা শরীফে ডান কদম মোবারক রাখলেন আর অমনই প্রবল ভারী বৃষ্টি শুরু হল। মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে তাকিয়ে বৃষ্টিপানির স্রোত দেখে মনে হল অনেকক্ষণ ধরেই এমন প্রবলধারা ঝরছে!
বাবাজান হুজরা শরীফে গেলেন, আমরা ২য় তলায় উঠে তাবারক খাবার প্যান্ডেলে গেলাম। সেদিন উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ তারাও আমারই মত সত্যিই অবাক হয়েছিলেন বাবাজানের এমন কেরামতি দেখে! এভাবে আরও অনেক কেরামতি দেখার সুযোগ পেলাম। আমার কাছে বাবাজানের বড় কেরামতি হল, কেবলাজানকে আমি আজ পর্যন্ত কোন দিন সুন্নতি পোশাক ছাড়া দেখি নাই। আমার সেই থেকে কুতুববাগ দরবার শরীফের দরদী মুর্শিদ কেবলাজানের কাছে যাওয়া-আসা শুরু হল। প্রত্যেক শুক্রবার জুমার নামাজ ফার্মগেট কুতুববাগ দরবার শরীফের জামে মসজিদে কেবলাজানের সাথে আদায় করে আসছি। অন্য কিছু কিছু মসজিদে ইমামদের কারণে জুমার নামাজ পড়ে মজা পাই না। কারণ, এ মসজিদ আল্লাহতায়ালার অলি-বন্ধু খাজাবাবা কুতুববাগীর গড়া মসজিদ।
বিশ্বজাকের ইজতেমার শিক্ষা হল, আত্মার শুদ্ধি লাভ করা। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষ বিশ্ব শান্তি, বিশ্ব মানবতার জন্য এলমে তাসাউফ ও বিশ্ব জাকের ইজতেমা। এখানে সকলের জন্য নিজ নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার শিক্ষা দেওয়া হয়। আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটানো হয়। এখানে মানুষের আত্মার রোগের চিকিৎসা করা হয়। মানুষের মধ্যে আত্ম অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, কৃপণতা, অলসতা, অভদ্রতা, মূর্খতা ইত্যাদি বিষয়গুলো মহান আল্লাহপাকের নামে জিকির ও সাধনার মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়। আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা করে নিষ্ঠা, বিনয়, আদব, আজিজি, সভ্য, ভদ্র, দানশীল, কর্মঠ, জ্ঞানী ও আমলওয়ালা মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা হয়। নিয়মিত অজিফা আমলের মাধ্যমে মানুষের আত্মায় একটি বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হয়ে মহান আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে সচেষ্ট হয়। ফলে সে নিজে শান্তি প্রিয় হয়ে যায় এবং অপরকে শান্তিপ্রিয় বানাতে চায়। এভাবে সে পরম শান্তি লাভ করে। সৃষ্টির শুরু থেকে সমস্ত নবী ও রাসুলগণ এ শান্তি লাভের জন্য সকল ধর্মেই আধ্যাত্বিক সাধনার কথা বলা হয়। সকল ধর্মের সাধনাই আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য লাভে সচেষ্ট হয়েছেন। মানুষ এখন খাজাবাবা কুতুববাগীর ‘সূফীবাদই শান্তির পথ’ এই পতাকা তলে আসলে মানুষ হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে যায়। তারা আল্লাহমুখী হয়, অন্যের দোষ দেখার আগে নিজের দোষ দেখে, মা ও বাবার খেদমত করে। গুরুজনকে ভক্তি-তাজিম করে। বে-নামাজি নামাজ পড়ে, বে-রোজাদার রোজা রাখে। বে-জিকিরুল্লাহ জিকির করে, মানব সেবা করে, ভুখা মানুষকে খাবার খাওয়ায়, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করে। এটাই সূফীবাদের মূল বিষয়। এই অমীয়বাণীগুলো মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার মাধ্যমে মানুষের মনে দাগ কাটে। মহামিলনের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ মুখী হয়।
লেখক: খাদেম, কুতুববাগ দরবার শরীফ ও সাংবাদিক