অতি ফয়েজপূর্ণ, রহমত ও বরকতের সাথে সফলভাবে সম্পন্ন হল ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমা

সেহাঙ্গল বিপ্লব

ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে রাজধানীর ফার্মগেটে আনোয়ারা উদ্যানে উদযাপিত হয়ে গেল কুতুববাগ দরবার শরীফের ঐতিহাসিক মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমা ২০১৬, গত ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি, রোজ বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। দু’দিনের এ মাহফিল অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত আলেম ওলামায়ে কেরামগণ কোরআন-হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে সহজ-সরল ভাষায় নিখুঁতভাবে আলোচনা করেন, পরিপূর্ণ ইসলামের মধ্যে নিহিত যে, শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত রয়েছে তার ওপর। রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্য তরিকতের এ মহা-সমাবেশে তামাম দুনিয়ার সকল অলি-আউলিয়া কেরামগণের রুহানী আত্মার মহা সম্মিলন ঘটে থাকে। এছাড়াও ভক্ত-মুরিদ, আশেকান ও জাকেরানরা তো আছেনই। ওরছের প্রথম দিন ২৮ তারিখ বৃহস্পতিবার ফজর নামাজের পর পাক-কালাম ফাতেহা শরীফ ও সাত শত মরতবা খতম শরীফসহ মোজাদ্দেদের শানে গজল পাঠের মধ্য দিয়ে, মোজাদ্দেদিয়া তরিকার পবিত্র নিশান উত্তলোন করে, দু’দিনব্যাপি মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার শুভ উদ্বোধন করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকেই দূর দূরান্ত থেকে ভক্ত-আশেকান ও জাকেরানদের ওরছ শরীফের সুসজ্জিত বিশাল প্যান্ডেলে সমবেত হতে দেখা যায়। এর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত যত বাড়ছে, মানুষের সংখ্যাও ততই বাড়ছে। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে অধির অপেক্ষায় বসে আছে, মঞ্চে কখন আগমন করবেন চোখেরমণি, মাথার মুকুট, প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ কেবলাজান! তাঁকে একনজর দেখে শুকনো চোখের তৃষ্ণা আর অশান্ত মনের পিপাসা মিটাবে।

মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমার বিভিন্ন শাখায় পাঁচ হাজার (৫০০০) এর অধিক জাকেরকর্মী ভলান্টিয়ার-সেচ্ছাসেবক মাসব্যাপি দিন-রাত নিবেদিত দেখমতে ছিলেন। এদিকে বিশাল পাক ভান্ডারে শতাধিক চুলা বা উনুনে নিরলসভাবে তাবারক রান্নার কাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মী। অন্যদিকে রাত-দিন চলছে নিরিবিলি পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে বিনামূল্যে তাবারক বিতরণ ও খাওনোর কাজ। এ সময়ে কর্মী ভাইদের মধ্যে দেখেছি ফয়েজের তাজাল্লি। দুই দিনব্যাপি কুতুববাগের ওরছ শরীফে মানব সেবার অন্যতম এক অনন্য দৃষ্টান্ত ‘সেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি’। কোমায়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিবারের মত এবারও অনেক আশেক-জাকেরসহ আগ্রহী মানুষেরা সেচ্ছায় রক্ত দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে সহযোগীতা করেছেন। আরো ছিল একটি সুদক্ষ মেডিকেল টিম, দেশের নামকরা হাসপাতালের বড় বড় দশজন চিকিৎসক দু’দিনব্যাপি হাজার হাজার মানুষকে বিনামূল্যে ঔষধ ও চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। জরুরী বিভাগে রোগীদের জন্য মজুত রাখা ছিল দু’টি অ্যাম্বুলেন্স। এছাড়াও প্রতি বছরের মত শীতের শুরু থেকেই শীতবস্ত্র দেওয়া হয় অসংখ্য গরিব জাকের-মুরিদসহ অন্য মানুষদের মাঝে। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয় নাই। ওরছ শরীফে আগতদের মধ্যে দেখেছি আনন্দ, উৎসাহ, উদ্দীপনা। দেখেছি ওরছ শরীফের সুস্বাদু তাবারক খাবার পর তাদের চোখে মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ। কেবলাজানের হুকুম ছিল এবং আছে, কোন একজন মানুষও যেন তাবারক না খেয়ে যায়, সবাই যেন এক লোকমা তাবারক খেয়ে যেতে পারে, কোনরকম যেন তাদের অসুবিধা না হয় সে ব্যাপারে। বাবাজানের হুকুম মত হয়েছে সবকিছু আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকতে কোথাও একটু টান বা গরমিল দেখা যায় নাই। দুই দিন এভাবেই খানাপিনা চলেছে বিরামহীন। খেয়েছেন অসংখ্য অলি-আল্লাহ ও জাকের-মুরিদসহ সাধারণ মানুষ। এই মহা নিয়ামত ও বরকতপূর্ণ তাবারক খেয়ে যে, কত মানুষের জটিল ও কঠিন অসুখ-বিসুখ, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি বালা-মসিবত, বদজীন-ভূতের তাছির থেকে মুক্তি পেয়েছে তার হিসেব নেই। আল্লাহর অলৌকিক দানের এ তাবারকের এতই ফজিলত বা গুণাগুণ যা লিখে শেষ করা যাবে না।

খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের মহামূল্যবান নসিহতবাণী প্রচার খেদমতে অতি নগন্য কাঙ্গাল এই নিবন্ধকারের অজানা কোন জনমের ভাগ্য গুণে ক্ষুদ্র গোলামী করার সুযোগ পেয়েছি এবং বাবাজানের আদেশ পালনের চেষ্টা করছি। কেবলাজানের হুকুমে এবারও মিডিয়া কর্মী হিসেবে খেদমতে শামিল ছিলাম। যে কারণে কেল্লার মধ্যে সব দিকেই ঘুরে ঘুরে দেখার এবং ওরছে আগত আশেক-জাকের ও মুসল্লি ভাইদের অনেকের সাথে যোগাযোগ, কথাবার্তা বলার সুযোগ হয়েছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে এবারই প্রথম এসেছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। তারা কেউ একা বা দুই তিন-পাঁচ জন করে এসেছে। আবার অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে বাস, লঞ্চ বা ট্রেনে কাফেলা করে এসেছে। দু’দিনের এ ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমায় সার্বক্ষণিক উপস্থিত থেকে অনেকের মুখে বলতে শুনেছি, তারা বলেছে, এত দিন কত সব পীর বা মসজিদের ইমামের বেলায় দেখেছি, তারা নানা রকম ফন্দি-ফিকির, ঝাড়-ফুঁ, তাবিজ-কবজ, কুফুরিসহ কত কী দিতে। কিন্তু কুতুববাগী বাবাকে এসবের কিছুই দিতে শুনি নাই বা এখানে এসেও তা দেখলাম না। অথচ তাঁর এত এত ভক্ত-মুরিদ।’ ওরছ শরীফের মহা ধুমধাম ও সাজসজ্জা দেখার জন্যও এসেছে অনেকে এবং সেই সুযোগে বাবাজানের পবিত্র হাতে বাইয়াত নিয়ে মুরিদ হয়ে গেছেন এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়।

ঘড়িতে রাত তিন টা। আনোয়ারা উদ্যানে আলোকোজ্জল গেট ও সুবিশাল প্যান্ডেলসহ আশেপাশে অসংখ্য মানুষ, সবাই চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছে মুর্শিদ কেবলাজনের পথ চেয়ে। কখন মঞ্চে আসাবেন দরদী মাশুক। এর কয়েক মিনিট পরেই রাতের তৃতীয় প্রহরে কেবলাজানের অগণিত আশেক-জাকেরের প্রতি তাঁর প্রেম, ভালোবাসা-মহব্বত ও মায়ার টানে আর হুজরা শরীফে থাকতে পারলেন না উঠে এলেন মঞ্চে। এ সময়ে লাখো মানুষের কণ্ঠে নারায়ে তাগবির আল্লাহু আকবর ধ্বনিত হয়, ‘রাসুলুল্লাহর সত্য তরিকা, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘সূফীবাদের আলো, ঘরে ঘরে জ্বলো’ এরপর হঠাৎ পিনপতন নিরবতা। কেবলাজান তাঁর প্রেমময় সত্তা থেকে সুললিত-মধুমাখা কণ্ঠে, আশেকান-জাকেরান ভাই ও উদ্যানের অন্য প্রান্তে বিশাল প্যান্ডেলে পর্দার আড়ালে আশেক-জাকের বোনদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত অমূল্য নসিহতবাণী শেষে, রহমতের ফয়েজে বসেন এবং ধ্যান-মোরাকাবা করান। এরপর সবাইকে জিকির করান, জিকিরের ধ্বনিতে আকাশ-পাতাল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। একটু পরেই দেখা গেল চারপাশে লোকে লোকারণ্য, এই রাতে এত মানুষ কোথা থেকে এলো! এখানেও কেবলাজানের বিশেষ কেরামতি প্রকাশ পেয়েছে। সত্যই, বোধের সবটুকু বিবেচনা দিয়ে বলছি, রাতের আকাশে অলংকার দূর নক্ষত্ররাজি যেমন গুনে শেষ করা যায় না, তেমনই খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের অলৌকিক কেরামতির কথা বললে শেষ হবে না। এ কথা শুধু আমি নই, লাখো আশেক-জাকেরসহ পরিচিত ভক্ত জনতার মুখে মুখে উচ্চারিত এ সত্য।

মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে গেল মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমা। আমাদের মত প্রতিটি আশেক-জাকেরের জন্য এ এক মহা নিয়ামত ও বরকতপূর্ণ ছিল ওরছ শরীফ আয়োজনের দিনগুলো। যারা এর স্বাদ পেয়েছে কেবল তারা-ই বুঝতে পারবে এর ভিতরে কত শান্তি কত আনন্দ। দেশ ও দেশের বাহির থেকে অসংখ্য আশেক-প্রেমিক জাকের-জাকেরীন অনেক আশা ও বাসনা নিয়ে এসেছিল ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমায়। শুক্রবার আখেরী মোনাজাতে কেবলাজানের সাথে সবাই দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ফরিয়াদ করেছে বিগত জীবনের সকল গুনাহ মাফের আশায়। এত মানুষের সমাগম ছিল তবুও কোথাও কোনপ্রকার হৈ হুল্লোর চোখে পড়ে নাই। খুব শান্তিপূর্ণভাবে ওরছ শরীফের মহা নিয়ামত এ তাবারক সবাই খেয়েছে। বরাবরের মত এবারও ওরছ শরীফ ও বিশ্বজাকের ইজতেমা এবং কেবলাজানের অমূল্য বাণী প্রচারে এগিয়ে এসেছে, জাতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের প্রায় সকল গণমাধ্যম, সাথে অনেক সাংবাদিক বন্ধুরাও এগিয়ে এসেছেন ‘সূফীবাদই শান্তির পথ’ কিংবা ‘মানব সেবাই পরম ধর্ম’ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের এই বাণী প্রচার-প্রসারে। বিশেষ করে বৈশাখী টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সেচ্ছায় অত্যান্ত আন্তরিকতার সাথে, শুক্রবারের জুমার নামাজের আগে কেবলাজানের বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে মহামূল্যবান নসিহতবাণী সরাসরি সম্প্রচার করেছে ওরছ শরীফস্থল থেকে। এ মহা সত্যকে প্রচার করতে এসে তারাও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও রাসুল (সঃ)-এর মহব্বত হাসিল করেছেন এবং আখেরী মোনাজাতে শামিল হয়ে মহা নিয়ামত ও রহমতের ভাগিদার হয়ে গেলেন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে ‘ইহদিনাছ ছিরওয়াত্ল মুস্তাকিম’ এর পথ দেখান আর সত্য ও সুন্দর ঈমানকে শক্ত-মজবুত রাখার শক্তি দান করুন। আমিন।

(Visited 230 times, 1 visits today)
Share