সেহাঙ্গল বিপ্লব আল মোজাদ্দেদি
এ বিশ্বে কোরআন শরীফ একটি স্থিতিশীল সুন্দর ও সুশৃংখল জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য ভিত্তি, যা মানুষের বিশ্বাস বা পদ্ধতি উপস্থাপন করে থাকে। জান্নাতে ফিরে যাওয়া মানেই একটি বিজয়ী প্রত্যাবর্তন, আর জাহান্নামী হওয়া মানেই জীবনকে পরাজিত করে নিঃশ্ব হয়ে কবরে যাওয়া। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উৎস সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি বা বিতর্ক রয়েছে অনেক। মানুষের মৌলিক সুখ হলো রাসুল (সঃ)-এর প্রতি অসীম ভালোবাসা, অস্তিত্বের ভিতর আধ্যাত্মিক সত্যতা ও আত্মার বিজয় সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বিশ্বাস স্থাপন করা। আজ বিশ্বব্যাপী তরুণরা ‘মুসলিম ও অমুসলিম’ বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ দ্বারা প্রভাবিত পরিবেশে শিক্ষিত হচ্ছে। তাদের মনকে সংকুচিত করে জীবন ও কর্ম শিক্ষা সম্বন্ধে তথাকথিত ভুল তথ্য উপস্থাপনের মধ্যে আবদ্ধ রাখে। ইসলামী আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞান একটি স্বাগতিক উন্নয়ন হতে প্রমাণিত, আধুনিক সময়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা যুক্তিসঙ্গত এবং সন্দেহ ছাড়াই প্রদর্শিত হয়। এ কথা ঠিক যে, বিজ্ঞান মানুষের জীবনের গতি সঞ্চার করেছে, কিন্তু সংবেদনশীল
মানুষের থেকে আবেগ ও অনুভূতি কেড়ে নিয়েছে। আর তাই সারাবিশ্বে শুধুমাত্র আবেগের অভাবে মানুষ কঠিন ও যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। মায়া-মমতা, বিশ্বাস-ভক্তি ও শ্রদ্ধা হারিয়ে যেতে বসেছে। এক কথায় বিজ্ঞান রোবটের মত যন্ত্রদানবের পাশাপাশি মানুষকেও যন্ত্রমানবে রূপান্তর করে ফেলছে! আধুনিকতার নামে যে উপস্থপনা আমাদের সামনে করা হচ্ছে তা, সাময়িক অর্থে কাজের হলেও এর দ্বারা আত্মিক বা পারলৌকিক কোনো উন্নতি আশা করা যায় না। আত্মিক উন্নতির জন্য চাই আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী আধ্যাত্মিকতার মৌলিক শিক্ষাদীক্ষা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বিজ্ঞানের জৌলুসে গা ভাসিয়ে ভুলে থাকে ধর্মের মৌলিকত্ব। আধুনিক শিক্ষিত লোকের মধ্যে আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে অনেকে মনে করেন ঞযরং রং ধ ঢ়ৎবযরংঃড়ৎরপ বফঁপধঃরড়হ ংুংঃবস অহফ ংঢ়রৎরঃঁধষরঃু ষবধং ধৎব হড়ঃযরহম. আসলে তারা অন্ধের স্বর্গে বাস করেন। বিখ্যাত গ্রন্থ গ্যাব্রিয়েল উইং এর লেখক ও ভারত-মুসলিম সংস্কৃতি বিষয়ক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অ্যানিমি শিম্মেল। তিনি ‘ক্লাসিক্যাল মিস্টিসিজম’ ঐশ্বরিক প্রেমের উপাদান প্রবর্তন, যা রহস্যবাদে সন্ন্যাসীতা পরিবর্তন করে বলেনÑ ‘রাবিয়া (৮০১ খ্রিস্টাব্দে), বসরা থেকে একজন মহিলা যিনি আল্লাহর (ঈশ্বর) সূফী আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যা ছিল নিঃশর্ত। রাবিয়ার পর কয়েক দশক ধরে ইসলামিক জগতে রহস্যময় প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে যায়, আংশিকভাবে খৃস্টান উৎস সৃষ্টির সঙ্গে চিন্তাভাবনার বিনিময়ে। প্রজন্মের বেশ কয়েকজন মুশরিক তাওয়াক্কুলের ওপর তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল, ঈশ্বরের (আল্লাহ) ওপর পরম নির্ভরতা, যা সূফীবাদের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা হয়ে ওঠে। এ সময় একটি ইরাকী স্কুল তার কঠোর স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং মানসিক অর্ন্তদৃষ্টির জন্য সুপরিচিত হয়ে ওঠে। ইরাকী স্কুলটি আল-মুসাবি (৮৫৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন) দ্বারা শুরু হয়েছিলÑ যারা বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বরের সঙ্গে ভাব সঙ্গীতের মাধ্যমে আত্মাকে শুদ্ধ করা যায়। বাগদাদের জুনায়েদ (মৃত্যু ৯১০ খৃস্টাব্দ) মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর শাস্ত্রীয় জ্ঞানী ও প্রজ্ঞার শিক্ষাগুলো রেখে গেছেন, যা পরবর্তীতে সংশোধন ও বৈধতার সংক্রমণের চেইনগুলো ফিরে যায়। সূফীবাদের একটি মিশরীয় স্কুলে, নুবীয়ান ধূ আল-নুন (৮৫৯ মৃত্যুবরণ খৃস্টাব্দ) ঐতিহাসিকভাবে টিকটিক্যাল শব্দ মঈফাই (অভ্যন্তরীণ জ্ঞান) চালু করেছিলেন, যা প্রচলিত শিক্ষার বিপরীতে ছিল; তাঁর স্নেহপূর্ণ প্রার্থনা, তিনি পবিত্র কোরআনের ওপর ভিত্তি করে আল্লাহর প্রশংসা-প্রণয়নে সমস্ত প্রকৃৃতিতে যোগ দিয়েছিলেন। এবং পরবর্তীতে ফার্সি ও তুর্কি কবিতায় প্রসারিত করেছিলেন। ইরানী স্কুলে, আবু ইয়াসীদ আল-বিসামামি (৮৭৪ মৃত্যুবরণ খৃস্টাব্দ) সাধারণত আত্মবিস্মৃতির প্রাণনাশের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়; তার উচ্চারণের অদ্ভুত প্রতীকটি পরবর্তীতে রহস্যময় কবিদের পরিভাষায় অংশ নেয়। একই সময়ে ঐশ্বরিক প্রেমের ধারণা আরও কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ইরাকী সূফীদের মধ্যে। এর প্রধান প্রতিনিধি নূরী, যিনি তাঁর ভাইদের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন।’
প্রিয় পাঠক এসবের দ্বারা বোঝা যায়, আধ্যাত্মিকতা ছাড়া বিজ্ঞানের যাত্রা সুখকর নয়। এবং এ ক্ষেত্রে সূফীদের সাধনা ও বিজ্ঞানের গবেষণা উভয়ের উদ্দেশ্য আলাদা আলাদা, সূফীদের অধ্যাত্মবাদের সাধনা হলো আল্লাহকে পাওয়ার অর্থাৎ স্রষ্টাকে সন্ধান করে তাঁর সান্নিধ্যে অবস্থান করা। এবং বিজ্ঞানের গবেষণা হলো টেকনোলজির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। আবার অনেক বিজ্ঞানী তাদের গবেষণায় পেয়েছেন, ইসলামী আধ্যাত্মবাদ একটি মৌলিক যোগ, এ যোগের মাধ্যমে একই সঙ্গে সৃষ্টি ও ¯্রষ্টাকে উপলব্ধি করা সম্ভব। রাসুল (সঃ)-এর বিভিন্ন দিক-নির্দেশনাকে (বাণী) বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যেমন, নামাজ একটি অত্যাধুনিক ব্যায়াম, অজু শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য পরিচ্ছন্ন একটি পানিমিস্ত্রিত মালিশ, যে মালিশ মনকে পবিত্রতার সঙ্গে সঙ্গে প্রফুল্ল রাখে। পায়ের টাকনুর উপরে কাপড় পরা সুন্নত। এর কারণ কী এ বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জেনেছেন, পায়ের টাকনুর ভিতরে এমন এক ধরণের তরল পদার্থ থাকে, যে পদার্থ বাহিরের আলো ও তাপ শোষণ করে এবং তা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। যদি কেউ দীর্ঘদিন পায়ের টাকনু ঢেকে রাখে, তবে সে তার স্মরণশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি ধীরে ধীরে তার পা চিকন হতে থাকে। এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যা রাসুল (সঃ) উম্মতের জন্য রেখেছেন। তাই, এ বিষয়গুলো জানাজানি হওয়ার পরেই দেখা গেছে অনেক তরুণসহ মুরুব্বিরাও পায়ের টাকনু উন্মুক্ত রেখেই কাপড় পরে। আর এ কথা খুব নির্দিধায় বলা যায়, আধুনিক বিশ্বে যা কিছু আবিষ্কার তার সবটাই পবিত্র কোরআনের ইঙ্গিত থেকে নেওয়া। বিজ্ঞানীরা মানুষের জীবন যাত্রাকে দ্রুতগামী করে তুলতে সাহায্য করেছেন তাই তাদের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ইসলামী সূফীবাদের আধ্যাত্মিক সাধকগণ আল্লাহতায়ালা ও রাসুল (সঃ)-এর মহব্বতকে মানুষের অন্তরে অন্তরে প্রসারিত করেছেন। বিজ্ঞানের একটি আবিষ্কারের চেয়ে মানুষের অন্তরের অন্ধকার দূর করা কঠিন ও দুরহ কাজ। আর সে কাজই করে থাকেন কামেল পীর-মুর্শিদগণ। মৃত্যুর সময় বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই সঙ্গে যাবে না, সঙ্গে যাবে মহান আল্লাহতায়ালা ও রাসুল (সঃ)-এর প্রতি দৃঢ় ঈমান।