সূফীবাদ কী? এর উদ্দেশ্য এবং তরিকত

মাওলানা মতিউর রহমান এছলাহী আল মোজাদ্দেদী

এ সময়ে সূফীবাদ সম্পর্কে আধুনিক প্রজন্মের অনেক মানুষ ভাসা ভাসা ধারণা রাখলেও, বেশির ভাগ মানুষই জানেন না প্রকৃত পক্ষে সূফীবাদ কী? অথবা এ ভাবধারার কর্ম-পদ্ধতি, উদ্দেশ্য এবং মূল উদ্ভাবক ও প্রবর্তক কে বা কারা? এ নিবন্ধে খুব সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করছি। পৃথিবীতে আদম (আঃ)কে সৃষ্টির শুরু থেকেই পরম সত্ত্বা মহান আল্লাহতায়ালাকে জানার আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহকে জানার প্রচেষ্টাকে সূফী দর্শন বা সূফীবাদ বলা হয়। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর মতে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন হওয়ার নামই সূফীবাদ।’ আমাদের জানা দরকার আরবী ‘সূফ’ শব্দের অর্থ পশম এবং ‘তাসাউফ’ শব্দের অর্থ পশমী’ অর্থ্যাৎ, পশমী বস্ত্র পরিধানের অভ্যাস (লাবসু’স-সূফ)- মরমীবাদের সাধনায় জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে তাসাউফ বলা হয়। যিনি নিজেকে এই সাধনায় সমর্পিত করেন, ইসলামের পরিভাষায় তিনিই সূফী নামে অভিহিত হন। ইসলামের পরিভাষায় সূফীবাদকেই ইলমে তাসাউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। ইলমে তাসাউফ বা সূফীবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকেই বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ‘ফানাফিল্লাহ’ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা), এবং ফানাফিল্লাহ অর্জন করা যায়। যেহেতু, মহান আল্লাহতায়ালা নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। ইলমে তাসাউফের সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয় এবং আল্লাহকে পাওয়ার সহজ ও সাবলীল পথই হলো ফানা-ফিশ-শায়েখ বা ফানা-ফির-রাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহর স্তর পার হওয়ার পর বাকা-বিল্লাহ লাভ করতে হয়। বাকা-বিল্লাহ অর্জিত হলেই কেবল সূফী দর্শন অনুযায়ী সূফীগণ মহান আল্লাহ প্রদত্ত (ইলমে লাদুন্নাহ) বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সূফীর অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। আর তা হবেই না বা কেন? কারণ, স্বয়ং রাসুলে আকরাম (সঃ) সূফীদর্শনের প্রবর্তক। রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘মানব দেহের মধ্যে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা পবিত্র থাকলে সমগ্র শরীর পরিশুদ্ধ থাকে এবং অপবিত্র থাকলে সমগ্র শরীর অপবিত্র থাকে, জেনে রাখো এটি হলো ‘কলব’ বা ‘হৃদয়’ যা শুধু আল্লাহর জিকির বা স্মরণে কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই কলবকে কলুষমুক্ত করে, মহান আল্লাহর করুণা অর্জন করাই মূল উদ্দেশ্য। যাঁরা আল্লাহর প্রেম অর্জন করেছেন, তাঁদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সূফীদর্শন। রাসুলুল্লাহ (সঃ)এর সত্য তরিকার মূল আদর্শিক শিক্ষা-দীক্ষার প্রধান অধ্যায় সূফীবাদ এর প্রসার লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সূফী-দরবেশ এবং দার্শনিকগণ নানান শাস্ত্র ব্যাখ্যা-গ্রন্থ রচনা করে সূফী দর্শনকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত এবং জনপ্রিয় করে তোলেন। সময়ের পরিক্রমায় বিখ্যাত অলি-আউলিয়া-কেরামদেরকে অবলম্বন করেই বিভিন্ন তরিকা গড়ে ওঠে। সে সব তরিকার মধ্যে প্রধান চারটি তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সে চারটি তরিকা যথাক্রমে: এক, পীরানে পীর গাউসুল আজম বড়পীর হযরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানী বাগদাদী (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত কাদরিয়া তরিকা। দুই, সুলতানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী আজমিরী (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত চিশতীয়া তরিকা। তিন, খাজায়ে খাজেগান হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ বোখারী (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা। চার, কাইউমে জামানী, মাহবুবে সুবহানী, রাফিয়েল মাকানী, হাইকিলে নূরানী, মুশকিলে আসানী হযরত শেখ আহমদ শেরহিন্দী মুজাদ্দিদ আলফে সানী আল ফারুকী (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত মোজাদ্দেদিয়া তরিকা। মহান সেই মোজাদ্দেদিয়া তরিকারই খেলাফতপ্রাপ্ত কামেল- মোকাম্মেল পীর এ শতকের মোজাদ্দেদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান। তাই দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় কুতুববাগ দরবার শরীফ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দরবার।

(Visited 1,413 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *