মোঃ শাখাওয়াত হোসেন
২৫ শে মার্চ, ২০১৪ তারিখে ক্বেবলাজানের হুকুমে আমি ও মোঃ অরূপ ভাইজান তরিকার দাওয়াত দিতে ভারত সফর করি। ক্বেবলাজান আমাকে রুহানী তায়াজ্জুহ দিয়ে নিজ মুর্শিদের নামে (খাজাবাবা কুতুববাগীর নামে) ক্বলব (ছবক) দেখানোর হুকুম দিলেন। হঠাৎ এরকম নির্দেশ পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে বললাম, বাবা, আমি গুনাহগারের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা কি সম্ভব? আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে কাছে ডেকে আমার শাহাদত আঙুলে বাবাজানের পবিত্র শাহাদাত আঙুল ছুঁয়ে নূরানি তাওয়াজ্জুহ্ দান করলেন। ক্বেবলাজানের দয়ায় তরিকা প্রচারের প্রথম সফরে মোট ৭৭ জন বাবাজানের পবিত্র নামের উপর আস্থা রেখে বাইয়াত গ্রহণ করেন। প্রায় দেড় মাস পর বাবাজান ক্বেবলা আমাদের নিয়ে ভারত সফরের উদ্দেশে ৯ মে, শুক্রবার রওনা হলেন। ক্বেবলাজানের গাড়ি জিরো পয়েন্টে পৌঁছালে ভারতের বি.এস.এফ’সহ বাবার ভক্ত শ্রী স্বপন কুমার দত্ত এবং তাঁর বড় ভাই শ্রী যাদব চন্দ্র দত্ত স্বাগত জানালেন। স্বপন ভাইজানের বাসায় পৌঁছালে, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ক্বেবলাজানকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলেন। শিউলি ফুল ভিজানো পানি দিয়ে বাবাজানের পবিত্র পা ধুয়ে দিলেন। শিউলি ফুল দিয়ে বাবাজানের পা ঢেকে দিলেন। তখন তাঁদের চোখেমুখে আনন্দের দ্যুতি জ্বলজ্বল করছিল। মনে হলো অমূল্য সম্পদ কাছে পেয়েছেন। শিলিগুড়িতে বাবাজানের আসার কথা শুনে, আশে-পাশের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ নর-নারী সবাই একনজর দেখার জন্য স্বপন ভাইজানের বাড়িতে ভিড় জমালো। অল্প সময়ের মধ্যেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। দার্জিলিং, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা থেকেও ছুটে আসতে শুরু করলো অসংখ্য মানুষ। সুদূর নেপাল থেকেও অনেকে ছুটে আসলো। এরপর হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাবাজানের শিষত্ব্য গ্রহণ করলো। ৯ মে রাতেই ধুপগুড়ি জামে মসজিদে মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন মসজিদ কর্তৃপক্ষ। বাবাজানের নসিহতবাণী শুনে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ উপস্থিত মুসল্লিরা বাবাজানের শিষত্ব্য গ্রহণ করেন। ছয় দিন সেখানে ছিলাম। প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে ৪ টি মাহফিল-অনুষ্ঠান ছিল। একদিন এক ভদ্রলোক বাবাজানের কাছে এসে বললেন, বাবা আপনি মহামানব অতি দয়ালু, আমার একমাত্র ছেলে বহুদিন ধরে মানসিক বিকারগ্রস্ত। নামিদামি হসপিটালে চিকিৎসা করিয়েছি। ফল হয়নি। খরচ জোগাতে গিয়ে আজ প্রায় নিঃস্ব। আপনি দোয়া করলে আমার বিশ্বাস ছেলেটি সুস্থ হয়ে যাবে। বাবাজান ছেলেটিকে নিয়ে আসতে বললে স্ত্রী, কন্যা-ছেলেসহ পুরো পরিবার উপস্থিত হলো। বাবাজান আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। আমরা দেখলাম ছেলেটি গভীর ধ্যানে-মগ্ন হয়ে কোথায় যেন ডুবল কিছুক্ষণ। এক পর্যায় ধ্যানরত অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে বাবাজানকে কদমবুঁচি করল! এই দৃশ্য দেখে ছেলের বাবা-মাসহ উপস্থিত সবার মধ্যেই আনন্দের আভা ফুটে উঠল। পরের দিন ছেলেটি এসে বলল, ভাই আমি অনেক সুস্থ হয়ে গেছি।১৪ মে (২০১৪) মঙ্গলবার ধুপগুড়ি থানার কাঠুলিয়াতে ছিল বাবাজানের আগমন উপলক্ষে বিশাল ওয়াজ ও দোয়া মাহফিল। হাজার হাজার নর-নারী হিন্দু-মুসলমান ধর্ম-বর্ণ জাতিভেদ নির্বিশেষ অংশগ্রহণ করে বাবাজানের নসিহতবাণী আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা, নামাজে হুজুরির কথা শুনে তাঁরা সহজেই বুঝতে পারলো যে, নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং সেই চেষ্টায় লেগে থাকা দরকার প্রতিটি মানুষের। স্বভাবিকভাবে চলার জন্যও নিজেকে জানতে হয়। নিজেকে চিনতে হয়, নইলে ক্বল্বে আল্লাহ নামের জিকির জারি হয় না। তাইতো উদার চিত্তে কুতুববাগী ক্বেবলাজানের শুভাগমনের পথ চেয়ে দিন গুনছিল তঁাঁরা। নিজ দায়িত্বে লাইনে দাঁড়িয়ে আদবের সঙ্গে বাবাজানের কাছ থেকে তরিকা গ্রহণ করেন অসংখ্য মানুষ। মোনাজাত শেষে আমি নতুন জাকের ভাইদের নাম লিখছিলাম, মোহাম্মদ অরুপ এবং মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বাবু ভাইজান, মূল্যবান নসিহতবাণী, অজিফার বই নতুন জাকেরভাইসহ সবার কাছে এই অমূল্য বাণী বিলি করছিলেন। এমন সময় দুই জন মানুষ, এক জন আরেক জনের কাঁধে চড়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছেন। চারদিক লোকারণ্য। এর মধ্যেও আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওনাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? ভিড়ের মধ্যে একজন উত্তর দিলেন, তাঁর দুই পা প্যারালাইজ্ড। বুকে ভর দিয়ে আল্লাহর অলির দোয়ার বরকত পাওয়ার আশায় এসেছি। বাবাজানের কাছে তাঁদের নেওয়া হলো, রোগীর অবস্থা দেখে বাবাজান প্যারালাইজড্ মাওলানা সাহেবকে দাঁড়াতে বললেন। চারপাশে হাজার হাজার মানুষের ঢল। সবাই দৃশ্যটি দেখছেন, তাঁকে ধরে দাঁড় করানো হলো। এবার বাবাজান রোগীকে বললেন হাঁটতে। সমস্ত মানুষ অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছেন রোগীর দিকে। বহু দিনের প্যারালাইজ্ড রোগী মুর্শিদ ক্বেবলার দোয়া তাঁকে মুহূর্তের মধ্যে সুস্থ করে তুলল! এই অভাবনীয় ঘটনা দেখে উপস্থিত নারী-পুরুষ পর্দার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন লাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং সবাই উচুস্বরে আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যে খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজানের এই কেরামতির কথা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেলে পঙ্গপালের মত ছুটে আসতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। সবার লক্ষ তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে সত্য তরিকার সুশীতল পরশে রহমত পাওয়া। মানুষের ভিড় দেখে স্বপন দার বড় ভাই যাদব কুমার দত্ত বললেন, বাবাজানকে আর কিছু দিন এখানে রাখলে আমাদের এই তিন তলা বাড়িতে কুলোবে না। এর চেয়ে বড় বাড়ি নিতে হবে। আরেকদিন এক হিন্দু ভাই বাবাজানের কাছে এসে বললেন, বাবা আমার একটি মেয়ে সন্তান আছে। আমি পরের সন্তানটি ছেলে চাই। বাবাজান চোখ বন্ধ করলেন। একটু পর চোখ খুলে বললেন, মালিক দয়া করেছেন, আপনার একটি ছেলে সন্তান হবে! এই বলে তাঁকে বিদায় দিলেন। তিনি বাবাজানের কাছ থেকে গিয়ে অন্য রুমে বসে কী যেন ভাবছেন। একটু পরে আবার আসলে বাবাজান তাঁকে বললেন, বাবা আপনার নাম? তিনি বললেন অজিত সাহা। বৌ মার নাম? তিনি বললেন অনামিকা। তখন বাবাজান তাঁকে বললেন, আমি আপনার ছেলের নাম রাখলাম স্বরুপ সাহা’। যে ছেলে এখনও পৃথিবীতে আসেনি, ক্বেবলাজন তাঁর নামও রেখে দিলেন! ছেলের নাম শুনে অজিত সাহার চোখ আনন্দের অশ্রুতে ভিজে উঠল। তিনি দৌড়ে গিয়ে অদূরেই বাজার থেকে মিষ্টি কিনে আনলেন, সবাইকে মিষ্টি মুখ করালেন।কাঠুরিয়ার মাহফিল শেষ করে বাবাজান দু:স্থদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করলেন। সব কাজ শেষে আমি ও অরুপ ভাইজান যখন ধুপগুড়ির উদ্দেশে যাত্রা করি, তখন ওখানকার এক জাকের ভাই মোহাম্মদ শফিরুল হক আমাদের এসে বললেন, ভাইজান অনেক আশা ছিল, বাবাজানের কদম আমাদের বাড়িতে পড়বে, কিন্তু এই গভীর রাতে বাবাজানের আরও দুটি প্রোগ্রামের কথা শুনে আমাদের বাড়িতে নেওয়ার কথা বলিনি। আপনারা তাঁর খাদেম, দয়া করে আপনারা যদি আমাদের বাড়িতে আসেন, তাতেও অনেক খুশি হবো। আমি ও অরুপ ভাইজান গেলাম। বাড়িতে ঢোকার সময় ভাইজান বললেন, আমি একজন দিনমজুর, দিন আনি দিন খাই। কিন্তু যখনই বাবাজানের আসার কথা শুনেছি, মাহফিলের কথা শুনেছি। তখন থেকে আমি মাহফিলের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেছি, কাজে যাইনি। প্রতিদিন মাহফিলের কাজ করেছি। আমার ছয় মেয়েসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে গত ছয় দিন শুধু আলু খেয়ে ছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, ভাইজান আপনিতো কখনও বাবাকে দেখেননি, তাহলে তাঁর প্রতি এত ভালোবাসা কীভাবে হল? তিনি বললেন, বাবাজানের ছবি মোবারক দেখার পরই আমি বুঝেছি তিনি আল্লাহর মহান একজন অলি। না দেখে মনে মনে আমি তাঁকে মুর্র্শিদ হিসেবে গ্রহণ করেছি। সুতরাং তিনি যখন আসবেন আমি কি তখন বসে থাকতে পারি। দক্ষিণ গোসাইর হাট মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে মাহফিল শুরুর আগে বাবাজান ওখানকার এক জাকের ভাইয়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ বসলেন। মাগরিবের হলে নামাজ আদায় করলেন। এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। মাহফিল পরিচালনা কমিটি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। বাবাজান চোখ বন্ধ করলেন। একটু পর চোখ খুলে বললেন, প্রথমে সামান্য বৃষ্টি হওয়া রহমতের লক্ষণ, মাহফিলের সময় বৃষ্টি হবে না। ঠিকই মাহফিলের সময় দক্ষিণ গোসাইর হাটের অন্যান্য স্থানে বৃষ্টি হলেও মাহফিলের মাঠে কোনো বৃষ্টি হয়নি। এরপর অত্র এলাকায় প্রায় সবাই বাবাজানের তরিকার নিয়ে শিষত্ব্য গ্রহণ করল ।ভারতের যেখানেই বাবাজান গিয়েছেন, সেখানেই মানুষের ঢল। যেদিন আমরা দেশে ফিরে আসব ওই দিন এক বোন আমাদের বললো, ভাইজান আসাম থেকে ট্রেনে তাঁর এক আত্মীয় বাবাজানকে দেখতে এবং দোয়া নিতে আসছে। প্রায় ১৮ ঘন্টা জানি, এখনও সে ট্রেনে আছে। আমি বললাম আমরাতো এখন চলে যাচ্ছি। আল্লাহ যদি আবার আনে, তখন তাঁকে আসতে বলবেন। যখন আমরা রওয়ানা হয়ে বাংলাদেশে আসছি, তখনও শত শত মানুষ হয়তো পথে ছিল বাবাজানের সাক্ষাৎ লাভের আশায়। ধূপগুড়ি থেকে ঢাকা যাত্রার মুহূর্তেও শত শত মানুষ বাবাজানকে বিদায় জানাতে আসলো। এসে বলতে লাগল বাবা বিদায় দিতে ইচ্ছে করে না। আবার কবে আসবেন? নিজ মুর্শিদ ছাড়া, গুরু ছাড়া আমরা কীভাবে থাকব? বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন উপস্থিত সবাই। তাঁদের কান্না দেখে আমাদের চোখেও পানি এসে গেল। হায়রে! মালিক বিনা সুতার বাঁধন কত দৃঢ়-শক্ত করে বানিয়েছো তুমি, তার মহিমা শুধু তুমিই জানো। গুরুর সঙ্গে ভক্তের এই যে আত্মার বাঁধন সত্যি-ই এটা ঐশ্বরিক। শত শত মানুষ চেংরাবান্দা স্থল বন্দর পযর্ন্ত আসলো ক্বেবলাজানকে বিদায় জানানোর জন্যে। সেখানকার বি.এস.এফ ও ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা বাবাজানকে আদব-ভক্তির সঙ্গে তাঁদের অফিসরুমে বসালেন। বাবাজানের কাছে অনেক কিছু জানতে চাইলেন, বাবাজান সংক্ষিপ্তভাবে সুফিবাদ সর্ম্পকে কিছু ধারণা দিলেন। তাঁরা বাবাজানের কথায় মুগ্ধ হয়ে বাবাজানের ছবি মোবারক সংগ্রহ করে রাখল এবং বলল ছবি মোবারক বাঁধাই করে অফিসে রাখব। বাবাজানের গাড়ি যখন বাংলাদেশ ভূখ-ে চলতে শুরু করল, তখন বাবাজান বললেন, সত্যি-ই ওদের হৃদয়ের টান এতই প্রবল যে, আমার গাড়ি থেকে নেমে ধূপগুড়িতে আবার যেতে ইচ্ছে করছে।