মোঃ শাখাওয়াত হোসেন
মহানবী রাসুল (সঃ) এরশাদ করেছেন, কোন ব্যক্তিই পুরোপুরি ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং পৃথিবীর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হবো। সুতরাং পূর্ণ ঈমানদার হতে হলে শুধু রোজা, নামাজ হলেই হবে না, রোজা নামাজের সাথে রাসুলে করিম (সঃ)-কে অধিক পরিমাণে ভালোবাসতে হবে। একদিন রাসুলেপাক (সঃ) হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাস? ওমর ফারুক (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার অন্তরে আপনার ভালোবাসা, আমার নিজের জন্য ভালোবাসা ও আমার পরিবারের জন্য ভালোবাসা বিদ্যমান। রাসুলেপাক (সঃ) বললেন, ‘এখনো তুমি পূর্ণ মুমিন হতে পারোনি।’ এই বলে তিনি ওমর ফারুক (রাঃ)-এর কাঁধে তাওয়াজ্জুহ্ দান করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি অবস্থা?’ উত্তরে ওমর ফারুক (রাঃ) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার অন্তরে আপনার ভালোবাসা ও আমার নিজের জন্য ভালোবাসা বিদ্যমান।
রাসুলেপাক (সঃ) বললেন, এখনও তুমি পূর্ণ মুমিন হতে পারনি।’ এই বলে তিনি ওমর ফারুক (রাঃ)-এর কাঁধে পুনরায় তাওয়াজ্জুহ্ দান করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তোমার কি অবস্থা? উত্তরে ওমর ফারুক (রাঃ) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার অন্তরে আপনার ভালোবাসা ব্যতিত অন্য কারো ভালোবাসা নেই। রাসুলেপাক (সঃ) বললেন, ‘এখন তুমি পূর্ণ মুমিন হয়েছ।’ উপরোক্ত হাদিস দ্বারা এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, শরিয়ত অনুসারে হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত আদায় করে, রাসুলেপাক (সঃ)-এর পবিত্র সংস্পর্শে থাকার পরও পূর্ণ মুমিন হতে পারেননি, যতক্ষণ না রাসুলেপাক (সঃ) তাঁকে তাওয়াজ্জুহ্ দান করেছেন। তাওয়াজ্জুহ্ এক প্রকার আধ্যাত্মিক শক্তি, যা নবী-রাসুলগণ তাঁদের উম্মতের ওপর ও অলি-আউলিয়াগণ তাঁদের মুরিদদেরকে দান করেন। যার ফলে ওই উম্মত কিংবা মুরিদের মনের কু-প্রবৃত্তির অবসান হয়ে সু-প্রবৃত্তির উদয় হয়। মানুষ নফসে আম্মারা থেকে নফসে মুতমাইন্নায় পৌঁছতে সক্ষম হয়।
তাওয়াজ্জুহর প্রকার ভেদ : মাওলানা শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিছে দেহলভী (রঃ) ‘তাফসিরে ফতহুল আজিজ’-এ সূরা ইকরা-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘কামেল ব্যক্তিদের তাসির যাহা অন্য মানুষের অন্তরে আছর সৃষ্টি করে, তরিকতের ভাষায় যাহাকে তাওয়াজ্জুহ বলা হয়।’ আমার পীর-মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান বলেছেন তাওয়াজ্জুহ চার প্রকার যথা,
তাওয়াজ্জুহে এনকাছী : এর ধরন বা স্বরূপ, যেমন এক ব্যক্তি অধিক পরিমাণ সুগন্ধ মাখিয়া কোন এক সভায় উপস্থিত হলো এবং সেই আতরের সুঘ্রাণ উপস্থিত সকলকে সুরভীত করে তুললো। কিন্তু ওই ব্যক্তি মজলিস থেকে বাহিরে গেলে সেখানে ঘ্রাণ আর পাওয়া যায় না, কেননা এ ঘ্রাণ স্থায়ী নয়। এটাই তাওয়াজ্জুহের সর্বনিম্ন প্রকার।
তাওয়াজ্জুহে এলকাহী : এর ধরন বা স্বরূপ, যেমন এক ব্যক্তি একটি নিভানো প্রদীপ নিয়ে অন্য এক ব্যক্তির নিকট হাজির হলো। তার কাছে ছিল আগুন, সে আগুন প্রদীপে ছোঁয়াতেই আলোময় হয়ে উঠল। এ প্রকারের তাওয়াজ্জুহ অবশ্য কিছু ক্ষমতা রাখে। কেননা শিক্ষাদাতার সান্নিধ্য থেকে দূরে গেলেও এর তাছির থাকে। কিন্তু যখন কোন প্রতিবন্ধকতা উপস্থিত হয় যেমন ঘূর্ণিবার্তা, ঝড়বাদল ইত্যাদি, তখন এর প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করে।
তাওয়াজ্জুহে এছলাহী : এর ধরন বা স্বরূপ, যেমন কোন বদ্ধ পুকুর বা ডোবার সাথে নালা কেটে নদীতে সংযুক্ত করলে পুকুর বা ডোবায় অনবরত পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু বিনা পরিচর্যায় ময়লা-আবর্জনা পরে কখনো নালাটি বন্ধ হতেই পারে এবং হয়। তখন তা পরিষ্কার করে দিলে আবার পানি প্রবাহিত হয়। উপরে উল্লেখিত দু’টি তাছির অপেক্ষা এই প্রকারের তাছির অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন। এর দ্বারা নফসের এছলাহ এবং লতিফার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। কিন্তু এ তাছিরের ধারণ ক্ষমতা নির্ভর করে পুকুর বা ডোবার বিস্তৃতির ওপর। যে নদী থেকে পানি প্রবাহিত হয় এর ওপর নয়।
তাওয়াজ্জুহে এত্তেহাদী : এর ধরন বা স্বরূপ, যেমন দুধে চিনি মিশ্রণ করলে চিনি আর খুঁজে পাওয়া যায় না, দুধের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। তেমনই কামেলপীর তাঁহার কামেল রুহকে মুরিদের রুহের সঙ্গে ভালো করে মিলিয়ে নিবেন। পীরের কামেল রুহ মোবারক মুরিদের রুহের উপর প্রভাব বিস্তার করিবে। তাওয়াজ্জুহসমূহের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী। কেননা উভয় রুহের সম্মিলনের ফলে পীরের পবিত্র রুহের সমস্ত কিছু মুরিদের রুহে প্রবেশ করে। এরপরে তার বারবার ফয়েজ গ্রহণ করার দরকার থাকে না। যেমন হযরত বাকী বিল্লাহ (রঃ) বর্ণিত, ‘একদা তাঁর বাড়িতে কয়েকজন মেহমান উপস্থিত হলেন। কিন্তু ঘরে কোন খাদ্যদ্রব্য না থাকায় তিনি চিন্তিত হয়ে খাদ্যান্বেষণ করতে লাগলেন। তাঁর গৃহ সংলগ্নেই ছিল এক রুটিওয়ালার দোকান। হুজুরের এ অবস্থা জানতে পেরে রুটিওয়ালা ঘিয়ে ভাজা সুস্বাদু রুটিতে খাঞ্জা পরিপূর্ণ করে যতœসহকারে হযরত বাকী বিল্লাহর খেদমতে উপস্থিত হলেন। খাজাসাহেব সন্তুষ্ট হয়ে রুটিওয়ালাকে খাবারের মূল্য জিজ্ঞাসা করলেন। রুটিওয়ালা বিনীতভাবে বললো, আমি এর মূল্য চাই না, তবে আপনি আমাকে আপনার মত বানিয়ে দিন। তিনি বললেন, ‘তুমি তাহা কিছুতেই হইতে পারিবে না। বরং মূল্য গ্রহণ কর।’ রুটিওয়ালা কিছুতেই রাজী হলো না। বরং বারবার বিনীতভাবে একই অনুরোধ করতে লাগলো। অগত্যা খাজাসাহেব নাচার হইয়া তাকে হুজরার মধ্যে নিয়ে গেলেন এবং তাওয়াজ্জুহে এত্তেহাদী প্রয়োগ করিলেন। অতঃপর হুজরা থেকে বাহির হলে দেখা গেল উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। উভয়ের সুুরত সম্পূর্ণ এক। তবে পথর্ক্য এই যে, খাজাসাহেব স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছেন, আর রুটিওয়ালা সম্পূর্ণ বেহুঁশ-অস্থির। এভাবে তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বেহুঁশ অবস্থায় রুটিওয়ালা ইন্তেকাল করলো’ (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
আমার পীর-মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের শাজারা মোবারকে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-এর পরে যিনি পীর-মুর্শিদ ছিলেন হযরত আদম বিন নূরী (কুঃ ছিঃ আঃ), তিনি বলেছেন, আমি সর্বপ্রথম হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর খলিফা খাজা খিজির (রঃ)-এর দরবারে হাজির হয়ে তরিকার জিকির শিখেছিলাম ও উচ্চতর হালত অর্জন করেছিলাম। হাজী সাহেবের নিকট নিজের অলৌকিক ঘটনাবলী উল্লেখ করেছিলাম। হাজী সাহেব বললেন, এর থেকে বেশি কিছু আমার কাছে নেই। এখন তুমি হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ) এর দরবারে যাও। আমি হাজী সাহেবের অনুমতি নিয়ে হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর কাছে উপস্থিত হলাম। সকল ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, এতো প্রাথমিক অবস্থা। এখনও কামালত আসেনি। একথা শুনে আমি বুঝলাম, হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ) আমার আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য এরূপ বললেন। তা না হলে এর থেকে বেশি কামালতের আর কী হতে পারে? কিন্তু হযরতের প্রতি আমার গভীর আস্থা ছিল। তাই আমি তাঁর দরবারেই রয়ে গেলাম। কিছু কাল পর আমার এমন হালত হল যে, এর তুলনায় আগের হালকে প্রাথমিক অবস্থার হালও বলা যায় না’ (সূত্র- হাজরাতুল কুদুস, পৃঃ-৩৪৫)।
হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) বলতেন, মহান আল্লাহ এই ফকীরকে এমন শক্তি দান করেছেন যে, সে যদি কোন শুষ্ক কাঠের প্রতি তাওয়াজ্জুহ দেয়, তাহলে তার দ্বারা একটি জগত নূরে নূরান্বিত হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ জামানায় এই ধরনের কারামতের বহিঃপ্রকাশ মহান আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-এর সেই তাওয়াজ্জুহ শক্তি সিনাবো-সিনা হয়ে তাঁর ১৩তম খলিফা, বর্তমান জামানার মোজাদ্দেদ আমাদের খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের কাছে এসেছে। রাসুলেপাক (সঃ) যে তাওয়াজ্জুহ দ্বারা সাহাবিদের পবিত্র করেছেন, সেই তাওয়াজ্জুহ্ প্রদানের শক্তিই রাসুলেপাক থেকে সিনাবো-সিনা হয়ে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) হয়ে, হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-এর কাছে এসেছে। খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের প্রিয়তম মুর্শিদ ঢাকা জেলার ডেমরা থানাধীন মাতুয়াইল নিবাসী বিশ্বখ্যাত মোফাসসিরে কোরআন শাহসূফী খাজা মাতুয়াইলী (রঃ)-এর হাতে বাইয়াত হয়ে, দীর্ঘ ১১ বছর গভীর ও কঠোর রিয়াজত-সাধনা, ধ্যান-মোরাকাবা ও আপন পীরের খেদমত করে অর্জন করেন সেই মহামূল্যবান কামালিয়াতের দরোজা। যে দরোজা বা মোকামের শক্তির নূরে, কেবলাজানের নূরানী হাতে কেউ সবক নিলে তাঁর কলব আল্লাহর জিকিরে নেচে ওঠে। কারো কারো একটু সময় লাগে তবে ৪০ দিন রিয়াজত-সাধনা ও তরিকার আমল করলে অবশ্যই কলবে আল্লাহর জিকির জারি হবেই। তখন আস্তে আস্তে এক সময় মানুষের শরীরের ৩৩ কোটি লোমকূপের গোড়া থেকে আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ নামের জিকির জারি হয় এবং রক্ত, মাংস, শিরা-উপশিরা সবাই আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে ওঠে। তখন সুলতানুল আসগার জারি হলে একজন সাধারণ মানুষ, অসাধারণত্ব লাভ করে আল্লাহর বন্ধুতে পরিণত হয়। আর তাই পরম আত্ম-বিশ্বাস নিয়ে বলছি, কুতুববাগ দরবার শরীফ হচ্ছে, মহান আল্লাহর অলি বা বন্ধু গড়ার কারখানা, যে কারখানার কারিগর কামেল গুরু খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান।
লেখক : এ্যাসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিঃ, খাদেম, কুতুববাগ দরবার শরীফ