সহজ মানুষের সঙ্গলাভে নতুন জীবন

মোঃ সাইফুল ইসলাম দীপক

মাসিক ‘আত্মার আলো’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার সময় থেকেই আমার শ্রদ্ধেয় কয়েকজন জাকের ভাই বললেন, লেখা দেওয়ার জন্য। চিন্তা করে পাই না কীভাবে লিখব। কথায় হয়ত প্রকাশ করতে পারি; কিন্তু লেখায় প্রকাশ করার মতো ভাষা-জ্ঞান আমার নেই। এই লেখাটির দুদিন আগে আমার মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী নিজেই বললেন, আপন পীরকে খেয়াল করে কলম ধরেন। মুর্শিদের সেই হুকুমকে মাথায় নিয়ে লেখার এই চেষ্টা।

খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজানের কথা আমি প্রথম শুনি শ্রদ্ধেয় জাকের, মাহবুব ভাইয়ের কাছে। সম্ভবত ২০০৫ সালের শুরু অথবা তারও কিছুদিন আগে। এমন একটা সময়, যখন আমার জীবনে চরম এক অশান্তি চলছে পারিবারিকভাবে। তার উপর এই মানসিক অশান্তির সঙ্গে শারীরিকভাবেও অসুস্থ ছিলাম, সবকিছু মিলে দুর্বিসহ সময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিলাম। মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৯ সালে আমার প্রথম চাকুরির সুবাদে। এরপর আমি অন্য কোম্পানিতে চলে যাই। কিন্তু কী এক বিচিত্র কারণে মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়ে গেল। আমার সেই কষ্টের সময় প্রায়ই মাহবুব ভাইয়ের কাছে যেতাম। গেলে ভালো লাগত, তাঁর সঙ্গে কথা বলে মন-কষ্টের ওজন থেকে হাল্কা হওয়া যেত। তাঁর পরামর্শে আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মানসিক শক্তি নিজের কাছেই আছে মনে হতে লাগলো! সেই নিজেকে যদি আরও শক্তিশালী করতে হয়, তাহলে একজন গুরুর দীক্ষা নেওয়া খুবই প্রয়োজন।

অনেক কথায়ই তো মাহবুব ভাই বলতেন এবং পরক্ষণেই বলতেন, এটা আমার কথা না, বাবার কথা।’ তখন থেকে খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজানের অনেক গুণের কথা শুনি এবং তা নিজের জীবনে কাজে লাগাতে শুরু করি, নিজের অজান্তেই। আজকে লিখতে বসে মনে হলো সেসব কথা শুনলে, মনের গভীর থেকে কেউ বলত এটাই সঠিক। আসলে মনের ভিতরে কোনো বিষয় দারুণভাবে দাগ না কাটলে, কেউই তা পালন করতে পারে না। এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ২০০৬ সালের মহাপবিত্র ওরছ শরীফ। ওই দিন ছিল আখেরি মোনাজাতের আগের রাত। এমনিতেই মাহবুব ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম তিনি বললেন, ওরছ শরীফে আছেন। আমাকেও দাওয়াত দিলেন আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে। পরের দিন আমি গেলাম। মাহফিলের স্থান ছিল মানিক মিয়া এভিনিউস্থ রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। আমি কিছুটা মাঠের পিছন দিকে বসলাম। সেখান থেকে মঞ্চ পরিস্কার দেখা যায় না। জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর, বাবাজান মোনাজাত শুরু করলেন। কণ্ঠস্বর শুনেই আঁতকে উঠেছিলাম! এ কী শুনছি! এত মধুর কণ্ঠস্বর। বাবাজানের সঙ্গে মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে হাত তুললাম, কান্নার ঢেউ উপ্চে উঠে অঝোরে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। সারাজীবনে এত কাঁদিনি কখনও। পড়নের জামা প্রায় পুরটাই ভিজে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে ধ্যানমগ্নতার মধ্যে চলে গেলাম তখন মনে হল, আমি এমন একটা জায়গায় বসে আছি, যেখানে আমি আর বাবা ছাড়া কেউ নেই। বাবা একটি টিলার মত উঁচু জায়গায় বসা আর আমি নিচে।

ধর্মভীরু মানুষ কখনও ছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিজেকে একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ মনে করতাম। সব কিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করতাম। আধ্যাত্মিকতা ব্যাপারটাকে মনে হতো কুসংস্কার এবং অশিক্ষার ফল। কিন্তু একজন মানুষের শুধু কণ্ঠস্বর শুনেই ভিতরে এমন অনুভূতি হবে কখনও ভাবিনি। আসলে এটা এমন এক অনুভূতি যা, লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না। যাদের হয়েছে কেবল তারাই বুঝবেন। এই অনুভূতির কথা যতবার চিন্তা করেছি বা কাউকে বলেছি, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যেত। লিখতে গিয়েও তা হচ্ছে। বাবাজানের মোনাজাত শেষে আমার মনে হল, শত জন্মের কালিমা যেন ভিতর থেকে বের হয়ে গেল। ফিরে পেলাম নতুন জীবনীশক্তি। কিছুদিন পর দরবারে যাতায়াত শুরু হয়। তখন খানকা শরীফ ছিল ফার্মগেট, খামারবাড়ি কৃষি ভবনের ঠিক পিছনে মনিপুরীপাড়ায়। ৩৪ ইন্দিরা রোডের বর্তমান দরবার শরীফ (সদর দপ্তর)-এর কাজ চলছে। মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক গুরুরাত্রিতে দরবার শরীফে যাওয়া শুরু করি। সম্ভবত দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার আমি এই মহাগুরু, মহাসাধকের শাহাদাত অঙ্গুলির পবিত্র স্পর্শ নিজের ক্বালবে নিয়ে, তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের মাধ্যমে নকশ্ বন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার সুশীতল ছায়াতলে আত্মনিয়োগ করি।

সেই থেকে প্রায় আট বছর অধম কাঙ্গাল মিসকিন আমি বাবাজানের পবিত্র কদমে আছি। এ সময়ের মধ্যে নিজের জীবনের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আমি একজন নৈরাশ্যবাদী মানুষ ছিলাম। এখন শত জাগতিক দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আশার আলো দেখতে পাই। আগের মত অল্পতেই হতাশ হই না। পারিবারিক জীবনেও এসেছে শান্তিময় মনোরম পরিবেশ। শারীরিক অসুস্থতাও দূর হয়েছে অনেক আগে। মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি। খাজাবাবা বলেন, প্রেমের কারণেই আল্লাহ এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এর ভিতর দিয়েই আল্লাহকে পাওয়া যায়।’ নিজের ভিতর যে ‘আমিত্ব’ নামক দানব বাস করে, তা-ই জানতাম না। এখন সেই দানবকে চিনতে পারি অনেক সময়, তখন তার সঙ্গে যুদ্ধ করি। মাঝে মধ্যে মনে হয়, দানব পরাজিত। কিন্তু আবার দেখি কোনো এক পথে সে হাজির। সেই দানবকেও পরিপূর্ণ বশ করতে পারব একদিন আমার মুর্শিদ ক্বেবলার উছিলায়, এই বিশ্বাস করি। অনেকে হয়ত বলবেন, এসব শিক্ষা তো বই-পুস্তকে আছে। আছে, আমিও জানি; কিন্তু শুধু বই পড়ে এই জ্ঞান অর্জন দূরে থাক, উপলব্দিতেও আসবে না। আর তাছাড়া বই-পুস্তকের জ্ঞান দিয়ে আপনি এই আত্মযুদ্ধে নফসের সঙ্গে জয়ী হবেন এ আশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়। এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কোনো মাদ্রাসা-স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যাবে না। এই শিক্ষা শুধু একজন কামেল মোকাম্মেল মুর্শিদের কাছেই পাওয়া যায়। খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজানের মত কামেল অলি-আল্লাহগণ এমন মানুষ, যাঁরা শুধু দিতে এসেছেন, বিনিময়ে কিছুই নিতে চান না। তাঁরা শুধু একে অন্যের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, শান্তি ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে চান। আর এ সবকিছুই আমাদের সার্বিক মঙ্গলের জন্যে প্রয়োজন। তাঁরা মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে এত ভালোবাসেন, মায়া করেন, তা বর্তমান জগতে সত্যিই বিরল এর অন্য কোথাও দেখা যায় না।

হয়ত অনেকে ভাবছেন, এটা হয় নাকি এই ডিজিটাল যুগে? তাদেরকে আমি বলব, হয়, আসলেই হয়। এই অসম্ভবকে সম্ভবরূপে দেখতে হলে এমনই একজন মানুষের সঙ্গে উঠাবসা করতে হবে। দূর থেকে আমরা না জেনে, না বুঝে কারো মুখে শুনে কিংবা ধারণা করে অনেক সময় অনেক মন্তব্য করি, আমি নিজেই করতাম। আমার মুর্শিদের কাছে এসে বুঝতে পারলাম, এটা কত বড় পাপ। নাউজুবিল্লাহ! পীর নামধারী অনেক ভন্ড লোকও আছে। কিন্তু কামেল-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদ সবাই হতে পারেন না। যাচাই করে নিতে হয়। এই লেখার মাধ্যমে অধমের বিনীত অনুরোধ রইলো, বিশেষ করে আমার মতো যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত তাদের প্রতি। বস্তু জগতের কোথাও শান্তি নেই। আমরা যতই শান্তি শান্তি বলে মুখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, আসলে কিন্তু অশান্তির শেষ নেই। শান্তি আছে শুধু সুফিবাদ বা আধ্যাত্মিক জগতে। সুচিন্তার সেই জগতে যেতে হলে, নিতে হবে সুফিবাদের শিক্ষা। কারণ, সুফিবাদই শান্তির পথ এবং এ পথের বিকল্প কোনো সুশৃংখল পথ নেই। সুফিবাদের শিক্ষা একা একা কেউ অর্জন করতে পারে না। এর জন্য চাই একজন সত্যিকারের কামেল মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদ বা সুফি-সাধকের বরকতপূর্ণ সান্নিধ্য এবং তাঁর দেওয়া সিলেবাস অজিফা আমলসহ হুজুরী ক্বলবে নামাজ আদায়। সুফিবাদ মানে সংসার ত্যাগী বৈরাগ্যতা নয়, কর্মবিমুখতা বা অলসতা নয়। জাগতিক কাজ-কর্ম তো করতেই হবে; এর সঙ্গে যদি সুফিবাদের আদর্শ-শিক্ষায় জীবনযাপন করা যায়, তাহলে সেই জীবন হবে শান্তির, চির কল্যাণকর। তখন নিজের ভিতর আরেক নিজের জন্ম হবে, সেই নিজ হবে সাদা মনের মানুষ, যাঁর মধ্যে কোনো অন্ধকার-কালিমা নেই। শেষ করি বাউল ফকির লালন সাঁইয়ের বাণী দিয়ে ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে ॥’ তাই কোরআন-হাদিস মতে প্রতিটি মানুষকেই একজন কামেল মুর্শিদের উছিলা ধরতে হবে, যে উছিলা নিয়ে পরপারে হাজির হতে হবে মহান আল্লাহর সামনে, তখন উছিলা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকবে না। রসুলপাক (সাঃ)এর উম্মতের উছিলা তিনি নিজেই কিন্তু সেই রসুল (সাঃ)কে পেতে হলেও উছিলা ধরতে হবে। বর্তমানে হাতের কাছে পেয়ে যদি সেই উছিলা না ধরে মরে যাই তবে, এর চেয়ে আহাম্মকি আর কী হতে পারে?

(Visited 101 times, 1 visits today)
Share