সাইফুল ইসলাম দীপক
মহান আল্লাহ্পাকের বিশালতা বা উদারতার বহিঃপ্রকাশ তাঁর সৃষ্টি জগতের সর্বত্রই। সৃষ্টি জগতের চারদিকে তাকিয়ে দেখুন কীভাবে মানুষ থেকে শুরু করে তুচ্ছাতি তুচ্ছ প্রাণীও এই পৃথিবীতে বাস করে, আহার করে, জীবন ধারণ করে। আমার গুরু খাজাবাবা কুতুববাগী বলেন, আঠার হাজার মাখলুক ও আশি হাজার আলম আছে এই পৃথিবীতে। শুধু পৃথিবী কেন, এই সৌরজগত, এই ছায়াপথ, এ যেন এক বিশাল কর্মকান্ড। আর এ সবকিছুই চলছে খুবই নিখুঁতভাবে। সূর্য্য উঠে আবার অস্ত যায়, দিনের পর রাত আসে, বীজ থেকে ফসল হয়, গাছে ফুল থেকে ফল ধরে, জোয়ার ভাটা হয়, সবকিছুই চলে অবলীলায়। আমরা খেয়াল করি না তাই বুঝতে পারি না। আর সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হচ্ছে সৃষ্টির সেরাজীব। কিন্তু সত্যিই কি আমরা সেই সেরা হতে পেরেছি? প্রশ্ন থাকল সবার কাছে। নিজেকেই এর উত্তর খুঁজতে হবে। আমি আজকাল এর উত্তর খুঁজতে শুরু করেছি। আর খুঁজতে গিয়ে যা দেখছি, তা দেখে আতঙ্কিত আমি। আমার মধ্যে সেই সেরার বৈশিষ্ট্য খুবই সামান্য, প্রায় নাই বললেই চলে। কীভাবে সেটা একটু পরে ব্যাখ্যা করব তার আগে বলে নেই, আমার এ উপলব্ধি কীভাবে হল। আমি যখন আমার গুরু, আমার শিক্ষক খাজাবাবা কুতুববাগীর আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডের সাথে আমার কর্মকান্ডের তুলনা করি তখনই ¯পষ্ট হয় এটা। খাজাবাবা বলেন, ‘বাবা, অকারণে কোনো প্রাণী হত্যা করবেন না।’ আমরা এমন যে, সামনে একটা পিঁপড়া দেখলাম আর সেটাকে পাড়া দিয়ে মেরে ফেললাম যদিও সে আমাকে কামড়ায় নাই। ভাবছেন হয়ত সামান্য পিঁপড়া মারলে ক্ষতি কী? ক্ষতি আছে। প্রাণী হিসাবে পিঁপড়া আকারে ক্ষুদ্র হলেও তারও কিন্তু কাজ আছে। আল্লাহ্ তাকে বিশেষ কারণে সৃষ্টি করেছেন। আপনি আমি তার খবর রাখি না। আর যেহেতু আমাদের সেই খবর নাই, তাই আমরা সকল সৃষ্টির অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও নই। আর এই কারণেই আমরা বাহ্যিকভাবে মানুষের সুরত হলেও সৃষ্টির সেরার বৈশিষ্ট্য সামান্যই আছে। অলি-আল্লাহগণ কিন্তু আল্লাহর বিশালতা, উদারতা হতে বেখবর নন। শুধু তাই নয়, তাঁরা তাঁদের সাধনার বলে এই গুণাবলী হাসিলও করেছেন। আর এ কারণে ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখবেন, সকল বড় বড় অলি-আল্লাহর দরবারে সকল শ্রেণি-পেশা, বর্ণ-ধর্মের মানুষ হাজির হচ্ছেন। এমনকি অন্যান্য মাখলুকও হাজির হয়ে যায়। অলি-আল্লাহগণ কাউকেই ফিরিয়ে দেন না। খাজাবাবা বলেন, ‘অলি-আল্লাহরা হচ্ছে নদীর মত। এখানে বহু রকমের মানুষ আসে পাক-সাফ হওয়ার জন্য।’ নদী যেমন সাগরের সাথে যুক্ত, তেমনি অলি-আল্লাহগণ আল্লাহর সাথে যুক্ত। তাই তাঁরাও সেই আল্লাহর বিশালতা, সেই উদারতা ধারণ করতে সক্ষম। আমরা পারি না। শুধু তা-ই নয়, আমরা এই বিশালতা বুঝতেও অক্ষম। যে কারণে অনেকেই অলি-আল্লাহ্ স¤পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন, কটু কথা বলেন। কিন্তু খাজাবাবাকে দেখেছি এসবের কোনো কিছুই যেন তাঁকে ¯পর্শ করে না। তিনি বিচলিত বা উত্তেজিত হন না। বরং বলেন, ‘বাবারা, লোকনিন্দা আতরের মত গায়ে মেখে ফেলবেন। মনে করবেন আপনি আল্লাহ্র আরো কাছে গেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে হবে, ত্যাগী মানুষ হতে হবে।’ এই সব শিক্ষা এ যুগে কে দেয়। আমি চিন্তা করে দেখেছি আমাকে কেউ সামান্য কটু কথা বললেই আমি উত্তেজিত হয়ে যাই। তাকে আরেকটা কটু কথায় জবাব দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাই। কিন্তু কই? আমিতো পারি না খাজাবাবার মত উত্তেজিত না হতে। এর একমাত্র কারণ আমার ক্ষুদ্রতা আর খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের বিশালতা। আপনি নদীকে বা সমুদ্রকে যতই গালমন্দ করেন তাতে কিন্তু নদীর স্রোত বন্ধ হয়ে যায় না, সমুদ্রের ঢেউ থেমে যায় না, তা চলতেই থাকে। অলি-আল্লাহ্গণও তেমনি তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।
একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটা বলি। একবার আমার এক আত্মীয় খাজাবাবার বাণী স¤পর্কে অনেক মন্তব্য করলেন, অনেক ভুল ধরার চেষ্টা করলেন, কোরআন-হাদিস এনে রেফারেন্স দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আমি তাকে বললাম, দেখুন আমিতো কোরআন ও হাদিসের বিশারদ নই, আপনি চলুন আপনাকে নিয়ে যাই খাজবাবা কুতুববাগীর কাছে। আপনি সেখানে গিয়ে আলোচনা করতে পারেন। তিনি রাজী হলেন না। ঘটনা এখানেই শেষ না। তিনি খাজাবাবার জীবন-যাপন পদ্ধতি নিয়েও মন্তব্য করতে লাগলেন। আমি শুধু বললাম, আপনি যে মন্তব্য করছেন তা কি নিজে দরবারে গিয়ে দেখেছেন? উনি বললেন, যাওয়ার দরকার নাই। বাইরে থেকেই বোঝা যায়। আমি বললাম, না জেনে মন্তব্য করা কি গীবত নয়? উনি বললেন, না এটা গীবত হবে কেন? অথচ পবিত্র কোরআনে আছে, গীবত করা অনেক বড় গুনাহর কাজ। আর না জেনে কোন সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করাই হল গীবত। যাই হোক, আমি আর কিছুই বললাম না, চলে আসলাম। পরে একদিন খাজাবাবকে ঘটনাটা বললাম। পুরোটা বলি নাই, বলার মতো রুচি হয় নাই।
খাজাবাবা আমার কখা শুনে শুধু বললেন, ‘বাবা, অহঙ্কারের কারণে মানুষ এসব করে।’ আসলেই তাই আমরা অল্প কিছু লেখাপড়া করেই নিজেকে অনেক বিদ্বান আর জ্ঞানী ভাবতে শুরু করি। আর তখন নিজের স্বল্প জ্ঞান দ্বারাই সবকিছুকে তুলনা বা বিচার করি। কথায় বলে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর’ আমাদের হল এই অবস্থা। আজকাল একদল লোকেদেরকে দেখি, তারা কোরআন ও হাদিসের আংশিক পড়েই বিভিন্ন মতবাদ, ব্যাখ্যা বা ফতোয়া দেওয়া শুরু করে। তারা বলে কোরআনের বঙ্গানুবাদ পড়লেই তো জানা যায়। তাদেরকে বলি, মুখে মুখে তর্ক বা কথা বলা খুবই সহজ। আপনার যদি অক্ষর জ্ঞান থাকে তাহলে আপনি আক্ষরিকভাবে পড়তে পারবেন ঠিকই, কিন্তু তাতে কোরআনের গভীর তত্ত্ব বোঝা কখনই সম্ভব না। সাধারণভাবে চিন্তা করে দেখেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষক ছাড়া কিন্তু কোনো বিষয়েই শিক্ষা লাভ করি নাই। আর কোরআন হচ্ছে এই সকল বিদ্যার অনেক অনেক উর্ধের বিষয়। আর তাই এমন শিক্ষক ধরতে হবে যাঁর বিশেষ জ্ঞান আছে। এই বিশেষ জ্ঞানের নাম হচ্ছে, ‘এলমে লাদুন্না’ বা ‘এলমে তাসাউফ’, এটা এমন এক বিশেষ জ্ঞান যা আল্লাহ্র থেকে নবীপাক পেয়েছেন, নবীজির থেকে খোলাফায়ে রাশেদিনগণ, তাঁদের থেকে আহলে বাইয়াত অর্থাৎ বেলায়েতে মাশায়েখ অলি-আল্লাহ্গণ হলেন এই জ্ঞানের অধিকারী। আল্লাহ্ প্রদত্ত এই বিশেষ জ্ঞান বিলিয়ে দিতে আমাদের মাঝে বেলায়েতে মাশায়েখগণ আসতে থাকবেন কেয়ামত পর্যন্ত। এই জ্ঞানের কোনো সীমা নাই, যা অফুরন্ত ও বিশাল। আল্লাহ্পাক কোন কোন বিশেষ মানুষকে সেই জ্ঞান দান করে থাকেন যাঁরা আল্লাহ্র মনোনিত আউলিয়া সকল। যারা নবীপাকের পরে মানুষের হেদায়েতের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নদীর মতই মানুষ ও মানুষের কলব বা অন্তরাত্মাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, পৌঁছে দিচ্ছেন সমুদ্রের কাছে। আর একটি কথা না বললেই না সেটা হল, আপনি কিংবা আমি না চাইলেও নদী বহমান থাকবে চিরকাল। আপনার বা আমার কথায় নদীর স্রোত বন্ধ হবে না। সৌভাগ্য সেই পুকুরের, যে পুকুর এই বহতা নদীর সাথে সংযোগ স্থাপন করে মহা সমুদ্রের জলে সে পূর্ণতা পায়, অর্থাৎ আল্লাহ্র সেই বিশালতার সন্ধান পেল। আমি অধম এক বদ্ধ ডোবা, বড় আশা করে চেষ্টা করে যাচ্ছি সেই নদীর সাথে মিলনের, যে নদী আমাকে মহা সমুদ্রের পথ দেখাবে।