মামুন মইনুল
দেশ-বিদেশে অগনিত আশেকান-জাকেরান ও ভক্ত-মুরিদান ভাই-বোনদের ইহকাল ও পরকালের বান্ধব আরেফে কামেল, মুর্শিদে মোকাম্মেল, মোজাদ্দেদে জামান শাহসূফী আলহাজ হযরত মাওলানা সৈয়দ জাকির শাহ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী কেবলাজানের ফয়েজ তাওয়াজ্জ্ব সবার অন্তর আত্মায় বর্ষিত হোক।
আমার জন্ম এমন একটি পরিবারে যেখানে সূফীবাদ চর্চা হয়। ছোটবেলা থেকে গর্ভধারণী মাকে দেখেছি সূফীবাদের চর্চায় ধ্যানে মগ্ন থাকতে। সে সময় বুঝতাম না। কিশোর বয়স পর্যন্ত সূফীবাদের প্রতি আগ্রহ ছিল। এরপর যখন যৌবনে বোঝার মত বয়স হলো, কেমন করে যেন ধীরে ধীরে এর থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়লাম। ওই সময় সূফীবাদ বিরোধী একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে, সূফীবাদের নামে অপব্যাখ্যা আর খেয়াল খুশি মত গীবত করা যাদের স্বভাব, আমিও তা-ই করতে শুরু করলাম। এভাবে চলতে থাকার পর খেয়াল করলাম, পরিবেশটাই পাল্টে যাচ্ছে আমার জন্য। একসময় এমনও হয়েছে, সপ্তাহে তিনদিন, পাঁচদিন করে মসজিদে থাকতাম, বাসায় ফিরতাম কম। আমাদের এলাকার অনেকেই আছেন যারা সূফীবাদের চর্চা করেন। একদিন কয়েকজন সাথীভাই যুক্তি করলাম, সূফীবাদীরা নামাজের পর যখন জিকির করবে, তখন আমরা তাদের বিরক্ত করবো। দিনে দিনে এই ইচ্ছা ব্যাপক আকার ধারণ করলো, সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, মাগরিব নামাজ শেষে খানকা শরীফে জিকির করতে বসলেই টিনের চালে ঢিল মারবো! যেদিন ঢিল ছুঁড়বো ভেবে ঠিক করেছি, কী কারণে যেন সেদিন সবাই আর এক হতে পারলাম না।
যা-ই হোক, রাতে ঘুমের ভিতরে স্বপ্নে দেখি একজন নূরানী চেহারার হুজুর আমাকে একখানা জায়নামাজ ও আকাশী রঙের একছড়া তসবিহ উপহার দিয়ে বললেন, ‘নামাজ পড়ো, জিকির করো, কাউকে বিরক্ত করবার দরকার নাই। তুমি, তোমার কাজ কর, তোমার হিসাব তুমি দিবে আল্লাহর কাছে।’ কথাগুলো বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। তারপরও আমার বোধকে জাগ্রত করতে পারিনি। তবে মাঝে-মধ্যেই কেমন একটা অনুশোচনা কাজ করতো। সেই স্বপ্নের কথা অনেক দিন নিজের ভিতরে চেপে রাখলাম। হঠাৎ এক সময় মনে হল, স্বপ্নের বিষয়টি শেয়ার করি এমন কারো সঙ্গে, যে বুঝবে এর মানে কী হতে পারে? পেয়ে গেলাম একজনকে যিনি আমার সম্পর্কে চাচা, তিনিও সূফীবাদের ভক্ত। বিস্তরিত শোনার পর চাচা বললেন, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি কর স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য। এরপর এলমে তাসাউফের বইপত্র পড়া শুরু করলাম, যত ঘাটি ততই এর প্রতি সহজেই বিশ^স্ততার সঙ্গে আগ্রহ এবং উদ্দীপনা বেড়ে যেতে লাগলো। সূফীবাদের চর্চা করে এমন দুই একজনের সঙ্গ নিতে লাগলাম। তারা বলেছেন, ‘আগে স্কুলে ভর্তি হও, তারপরে এর মূল্য পাবে।’ তাদের কথা শুনে ভাবতাম আমি তো স্কুল, কলেজসহ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষাও শেষ করেছি! ওনারা কোন স্কুলের কথা বলছেন? চাচা বলতো, মুর্শিদের দীক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। আর বলতো, স্কুল তো অনেক আছে, ভালো স্কুলের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করো, ভাগ্যে থাকলে পাবে। চাচার কথামত চেষ্টা করতে লাগলাম, একদিন পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা।
কথা প্রসঙ্গে বললো, সে ফার্মগেট কুতুববাগ দরবার শরীফে যাতায়াত করে, ওখানে গেলে ওর অন্তরটা শীতল হয়ে যায়! আর বললো, ‘ভালো লাগে, অনেক শান্তি অনুভব করি।’ বন্ধুর কথা শোনার পর আমারও আগ্রহ সৃষ্টি হলো কুতুববাগ দরবার শরীফে যাওয়ার জন্য। এদিকে এলাকার সাথী ভাইদের মধ্যে সূফীবাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে, তারা প্রবল বিরোধিতা ও সমালোচনা করতো, যা আমার পছন্দ না। তাদের বলতাম, আপনারা আগে সূফীবাদ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন, তারপর যদি মনে হয় সূফীবাদের দর্শন ভুল, তখন বলতে পারেন। কিন্তু কোন বিষয় সম্বন্ধে না জেনে এভাবে বলা ঠিক না। তারা বলে, পীরের কাছে যেতে হবে কেন?
এমনই এক সময় সেই বন্ধু আব্দুস সালামের সঙ্গে আবারও দেখা, ও বললো, আজকে হযরত শাহ আলী (রঃ) এর মাজার শরীফে কুতুববাগের মাহফিল আছে, খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান যেখানে নসিহত বাণী পেশ করবেন। মাহফিলে গেলাম দেখি অসংখ্য মানুষের সমাগম, দূর থেকেই শুনতে পেলাম কেবলাজানের সুমধুর সুরেলা কণ্ঠে পবিত্র কোরআনের বাণী। ‘আলা-ইন্না আউলিয়া আল্লাহি লা-খাওফুন, আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহ্যানুন!’ অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নাই এবং তারা কোন কারণে চিন্তাযুক্তও হবেন না।’ ধীরে ধীরে মাহফিল প্যা-েলের কাছাকাছি হাজির হলাম। দেখলাম এক কান্তিময় সুপুরুষ, তাঁর চেহারা মোবারকে নূরানী আলোর ফোয়ারা। নিজের চোখে দেখেও বিশ^াস করতে পারছিলাম না, কী করে মানুষ এত সুন্দর হয়! তাঁর মধুময় কণ্ঠে কোরআন, হাদিসের বিভিন্ন দলিল উত্থাপন করে ইসলাম ধর্মে সূফীবাদের মধ্যেই প্রকৃত মুক্তির সন্ধান সেই তথ্য পেশ করছেন। বিশ^খ্যাত সূফী-কবি হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ)এর মসনবী শরীফ থেকেও সূফীবাদের করণীয় দিক ও তরিকতের পথে পীর-মুর্শিদের গুরুত্বের কথা তুলে ধরছেন। এরপর আখেরী মোনাজাতে মহান আল্লাহর দরবারে বিশ^বাসীর কল্যাণ ও শান্তি চাইলেন। নদী-নালায় মাছ, গাছে ফল, ক্ষেতে ফসল বাড়ানোর জন্য আল্লাহর দয়া চাইলেন। তখন আমার শুধুই কেন যেন মনে হতে লাগলো, আল্লাহতায়ালা দোয়া কবুল করছেন! কুতুববাগী কেবলাজানের এ দোয়ার মধ্যে যেন, অন্যরকম একটা বিশেষ মর্যাদা এবং দয়াশীলতা অনুভব করলাম।
মোনাজাত শেষে শুধু বললেন, যারা বাইয়াত নিতে চান তারা সামনে আসেন। দেখলাম মানুষের ঢল। আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না, তরিকা নিবো কি নিবো না, এই দ্বন্দ্বে পিছনে সরে গেলাম। সেদিন আর তরিকা নেওয়া হল না। কয়েক দিন পর বন্ধু সালামের সঙ্গে দেখা, দরবারে আসতে দাওয়াত দিলো। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, দরবার শরীফের সাপ্তাহিক (গুরু-রাত্রি) মাহফিল। দরবারের তিনতলায় গিয়ে বসলাম। অনেক মানুষ। সবার মধ্যেই আদব আর নিরবতা খেয়াল করলাম। রাত দশটার কিছু পর খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। সেই নূরানী চেহারা মোবারক দেখলাম আর সত্যিই এক অবর্ণনীয় আনন্দ অনুভব করলাম। কিন্তু বারবার একটি কথাই মনে উঁকি দিচ্ছিল, মানুষ এত সুন্দর কী করে হয়! যাঁর কথা-বার্তা, অঙ্গ-ভঙ্গি, চাল-চলন, পোশাক সবই আমাদের সবার থেকে অনেক অনেক আলাদা।
আজ আর দেরি না করে সূফীবাদের দীক্ষা নিতে তরিকার স্কুলে ভর্তি হলাম এবং কেবলাজানের দেওয়া অজিফা আমল শুরু করলাম। এভাবে দরবারে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম। কিছুদিন পর আমার মেজ বোনের শ^শুর হজ পালন করে আসার সময়, একটা জায়নামাজ আনেন এবং আমাকে উপহার দেন। জায়নামাজখানা হাতে নিয়ে দেখি, এ তো সেই সবুজ রঙের জায়নামাজ! যা স্বপ্নে দেখেছিলাম, কিন্তু সে কথা কাউকে আর বললাম না।
তরিকতের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভক্তি বিশ^াস বহুগুণ বেড়ে গেল। এরপর একদিন সাপ্তাহিক মাহফিলে দরবারে গেলাম, প্রধান গেট থেকে প্রবেশ করলেই বাম পাশে দরবার শরীফের নিজস্ব লাইব্রেরি, সেখানে সুন্দর সুন্দর টুপি ও তসবিহ পাওয়া যায়। লাইব্রেরিতে ঢুকলাম, দেখি এমন একছড়া তসবিহ আলাদা করে এক পাশে রাখা, যা কি না স্বপ্নে দেখা সেই তসবিহ ছড়ার হুবহু!
আমি অবাক হলাম, এও কি সম্ভব! বুঝতে পারলাম সত্যিই আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের পথ খোলা রেখেছেন, আর সে পথের সন্ধান শুধুমাত্র তরিকতের মধ্যেই পাওয়া যায়। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি যদি সূফীবাদের দীক্ষা নিয়ে জীবন গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া যায়, তবে ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ আসবেই। খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের দীক্ষা নেওয়ার পর থেকে, এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করেছি এবং বিশ্বাসের এই দৃঢ়তা কুতুববাগ দরবার শরীফে এসে পেয়েছি। মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা, সবাইকে যেন সময় থাকতে কামেল মুর্শিদের সান্নিধ্যে আসার তাওফিক দান করেন। আমিন।