লাইলাতুল মেরাজ মহিমান্বিত এক রজনী

নাসির আহমেদ আল মোজাদ্দেদি

লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রজনী, যা সচরাচর শব-ই মেরাজ হিসাবে আখ্যায়িত। যে রাতে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় অলৌকিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং স্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেন সেই রাত শব-ই মেরাজ বা সাক্ষাতের রজনী হিসেবে পরিচিত। মুসলমান সমাজ এবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে এই রাতটি উদযাপন করেন। ইসলাম ধর্মে শব-ই মেরাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এই মেরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ, নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক বা ফরজ নির্ধারণ করা হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নির্দিষ্ট করা হয় শব-ই মেরাজের মাধ্যমে। ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বছরে (৬২০ খ্রিস্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রথমে কাবাশরীফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন। সেখানে তিনি নবীদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামে একটি প্রাণি, যার ডানা আছে, স্বর্গীয় সেই বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন। সিদরাতুল মুনতাহা হচ্ছে ঊর্ধলোকের সেই পর্যন্ত, যতটুকু পর্যন্ত জিব্রাইল (আঃ) যেতে পারেন বা তাঁর অবস্থানস্থল ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। [১] কোরআন শরীফের সূরা বনি ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
উচ্চারণ: ‘সুবহানাল্লাজি আস্রা বিআবদিহি লাইলাম মিনাল মাসিজদিল হারামী ইলাল মাসিজদিল আকসা।’
অর্থাৎ: ‘পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি তাহার এক বান্দা হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে মসজিদে হারাম (কাবাঘর) থেকে মসজিদে আকসা (বাইতুল মোকাদ্দাস) পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়েছেন। এর মধ্যে তাঁকে অসংখ্য নিদর্শনাবলী দেখান হয়েছে।

পবিত্র মেরাজুন্নবী (সঃ) নবুয়তের একাদশ বছরের মাঝামাঝি রজব মাসের ২৭তম রাতে মক্কা শরীফে উম্মেহানীর (রাঃ) বাসগৃহ থেকে অনুষ্ঠিত হয়। এই মেরাজুন্নবী (সঃ) এর সবচেয়ে রহস্যপূর্ণ মোজেজা এর মাধ্যমে সব নবীদের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। আরশের ওপর আরোহন ও মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হবার মাধ্যমে, তাঁর মহান মর্যদা প্রমাণিত। এই মেরাজ তিন ভাগে বর্ণিত। (এক) মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা। (দুই) সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা। (৩) সেখান থেকে আরশেআজিম পর্যন্ত বা আল্লাহতালা যতটুকু নিয়ে গেছেন ততটুকু পর্যন্ত। প্রথামাংশ : ইসরা, দ্বিতীয়াংশ-মেরাজ, তৃতীয়াংশ-ইরাজ। পবিত্র কোরআন এর সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা আন্জামে এটি বর্ণিত আছে। তারপরও বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা এ রজনীর মহিমা প্রমাণিত। ইসলামের দ্বিতীয় রুকন নামাজ এই রাতে ফরজ হয়। প্রথমে আল্লাহতায়ালা দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ নির্ধারণ করে দিলেও হযরত মুসা (আঃ) এর সহযোগিতায় মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তা পাঁচ ওয়াক্ত স্থির করা হয়। নবীগণ ইন্তেকালের পরও যে মানব কল্যাণ করতে পারেন, তা হযরত মুসা (আঃ)-এর সহযোগিতার দ্বারাই প্রমাণিত। এ রাতের অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরণের অলৌকিক ভ্রমণের ঘটনা সম্পন্ন হওয়া মহান আল্লাহর অপরিসীম কুদরতেরই নিদর্শন। মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনগুলো দেখানো হয়েছে। নবীজীকে আল্লাহ কর্তৃক সাক্ষাৎ দানে ধন্য করা, রহস্যপূর্ণ জ্ঞানদান করে তাঁর অন্তরের প্রশান্তি, উম্মতদের মুক্তির নিশ্চয়তা, জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করানোর লক্ষ্যে সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় প্রিয় নবী (সঃ) আল্লাহতায়ালা জগতসমূহে ভ্রমণ করিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মেরাজের ঘটনাকে মানুষের জন্য পরীক্ষা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ দুর্বল ঈমানের অধিকারী অনেকে এই ঘটনাকে বিশ্বাস করতে না পেরে ধর্মত্যাগ করেছে। মেরাজের ঘটনার ওপর আস্থা বিশ্বাস স্থাপন করাই হচ্ছে মজবুত ঈমানদারের পরিচয়।

পবিত্র শব-ই মেরাজ সম্পর্কে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদদের অভিমত বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত।
মেরাজের ঘটনা সমগ্র মানবজাতির জন্য সত্যি এক অনুপম বিস্ময়কর ঘটনা। মেরাজের ঘটনা যে বিশ্বাস করল না সে তার ঈমানকে দুর্বল করল। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা মেরাজের ঘটনার ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বলেছেন। পবিত্র শবে মেরাজ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আলেমদের অভিমত হচ্ছে, মেরাজ মহানবী (সঃ) এর একটি শ্রেষ্ঠ মুজিযা। এটি মানব ইতিহাসে অবিস্মরণীয় বিস্ময় জাগানো যুগান্তকারী ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে এ ঘটনা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত ও অর্থবহ। বিশ্বের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, গবেষক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ এ ঘটনায় বিস্ময়ে নির্বাক। এটা কী আশ্চর্য, অদ্ভুত, অকল্পনীয় ব্যাপার। যা ইতিপূর্বে কখনো সংঘটিত হয়নি। এই বিস্ময়কর ঘটনা ঈমানদারের ঈমানাকে করেছে আরো শাণিত ও মজবুত। পক্ষান্তরে দুর্বলচিত্ত ও সংশয় প্রকাশকারীদের ঈমানকে করে নড়বড়ে। অবিশ্বাসীদের অবিশ্বাসকে ঠেলে দিয়েছে গহীন অন্ধকারে। মেরাজুন্নবী (সঃ) এর দুটো সমন্বিত নাম হচ্ছে মেরাজুন্নবী (সঃ) প্রথমটি সূরা বনী ইসরাঈলের প্রথম আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। দ্বিতীয়টি মুতাওয়াতির ও মশহুর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হাফেজ ইবনুল কাসীর (রাঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে পঁচিশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন, যাঁদের থেকে মেরাজ সংক্রান্ত হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় রাসুলে করিম (সঃ) মসজিদে আকসা থেকে সপ্তাকাশে ভ্রমণ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার যাবতীয় ঘটনা প্রবাহকে মেরাজ বলা হয়। উম্মতের অধিকাংশ আলেম, চিন্তাবিদ ও সাধারণ মুসলমান এই আক্বীদা পোষণ করেন যে, মেরাজ রাসুলের দৈহিক ও জাগ্রত অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেরাজুন্নবী (সঃ) যে রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বশরীরে হয়েছে এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এ ঘটনা নিয়ে জনসমাজে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া। ঘটনাটি যদি নিছক আত্মিক বা স্বপ্নযোগে হতো, তাহলে ইসলামের পক্ষ-বিপক্ষ কোন মহলই এ নিয়ে বিতর্ক করতেন না। সবাই বিনা বাক্যে নির্দ্বিধায় মেনে নিতেন। নি:সন্দেহে মেরাজ মানব ইতিহাসের বিস্ময়কর ঘটনা। পবিত্র শব-ই মেরাজ গোটা মুসলিম জাহানের জন্য গৌরব বা অহঙ্কারের বিষয়, কারণ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কেই একমাত্র মেরাজ (সাক্ষাৎ) প্রদান করেছেন আল্লাহতায়ালা। পৃথিবীর আর অন্য কোন নবীকে আল্লাহতায়ালা মেরাজ প্রদান করেননি। এই মেরাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মহান আল্লাহতায়ালা নবী করিম (সঃ) কে কয়েক স্তরের মেরাজদান করেছেন। এটা হচ্ছে : মেরাজে বসরীঃ খানায়ে কাবা বায়তুল্লাহ শরীফ থেকে মসজিদে আকসা বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত প্রথম স্তরের বসরী মেরাজ। এই বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে লক্ষ-লক্ষ নবীগণ নবী করিম (সঃ) এর ইমামতিতে নামাজ আদায় করেন। এ হচ্ছে নবী করিম (সঃ) এর শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রমাণ। কারণ পৃথিবীর সমস্ত নবীর ইমাম হচ্ছেন রাসুলে করিম (সঃ)। পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় হচ্ছেন নবীগণ। ঐ নবীগণের ইমামরূপে নামাজ আদায় করিয়ে আল্লাহ তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এরপর মেরাজে মরকী (ফেরেশতা জগতের মেরাজ) বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃৃত্বীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম আকাশ হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা অর্থাৎ, হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর অবস্থান স্থল পর্যন্ত নবী করিম (সঃ) কে নবীগণ সংবর্ধনা প্রদান করেন। প্রথম আসমানে হযরত আদম (আঃ), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসূফ (আঃ), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আঃ), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আঃ), সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সাক্ষাৎ হয়। তারপর সেখানে থেকে নবী করিম (সঃ) সিদরাতুল মুনতাহায় গমন করেন। এরপর হযরত জিব্রাইল (আঃ) বলেন, আমার আর যাওয়ার ক্ষমতা নেই। যেখানে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর যাওয়ার ক্ষমতা নেই, সেখানে নবী করিম (সঃ) যাওয়ার ক্ষমতা রাখলেন। এখান থেকেই প্রমাণ হয় নবী করিম (সঃ) এর মহিমার অনন্য গৌরব।

(Visited 1,165 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *