নাসির আহমেদ
প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে/ স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে। সেই কবে ছোটবেলায় পড়েছি এই কবিতা, কিন্তু তার রেশ আজো মন থেকে মুছে যায়নি। তখন প্রেমের মর্ম বোঝার মত বয়স ছিল না। বড় হয়েও যে এর গভীর তাৎপর্য খুব উপলব্ধি করতে পেরেছি, তা-ও আজ আর মনে নেই। কারণ, সাধারণ মানুষ প্রেম বলতে নর-নারীর প্রেমকেই বুঝে থাকেন। স্নেহ-মায়া-মমতার সঙ্গেও যে প্রেমের তুলনা হয় না, তা-ও আমরা কজন বুঝি! আসলে প্রেম তো আল্লাহতায়া’লা প্রদত্ত এমন এক অনুভূতি, যা সত্যিকার অর্থেই স্বর্গীয়। এ এমনই এক তীব্র আবেগের নাম যার সবটুকু ভাষায় প্রকাশ করাও অসম্ভব। প্রেম কেবল অনুভবের জিনিস, এ সত্য যর্থাথভাবে উপলব্ধি করা যায়, কারো মনে যখন স্রষ্টার জন্য প্রেম সৃষ্টি হয়, পরম করুণাময় আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধু আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহাম্মদ মুজ্তবা (সঃ)-এর জন্য যার অন্তরে প্রেম, মহব্বত বা ইশ্ক সৃষ্টি হয়, তিনিই বুঝতে পারবেন প্রেমের প্রকৃত মহিমা আর এর উত্তাপ। আখেরী নবীর আহলে বাইয়াত কামেল পীর-মুর্শিদ ফকিরগণের দিলের সঙ্গে যদি কেউ নিমগ্ন হয়ে বসে নিজের দিল মিশাতে সক্ষম হন, আল্লাহ যদি দয়া করে অন্তরের সেই বিনা তারের সংযোগ তৈরি করে দেন, তখনই উপলব্ধি করা সম্ভব প্রকৃত প্রেম কাকে বলে! জাগতিক প্রেমে একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য ব্যাকুল হন, প্রেমিকাও প্রেমিকের প্রতি আসক্ত হন। এমন কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও গভীর প্রেমময় সম্পর্ক হতে পারে। কিন্তু জাগতিক এসব প্রেম অমরতা পায় না। অনেক সময় প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে নানা কারণে, স্বার্থের দ্বন্দে বিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে। পরম প্রিয়তম স্বামী-স্ত্রীর সংসারও ভেঙে যেতে পারে। আর যদি ইহজাগতিক প্রেম আজীবন টিকেও থাকে, তারপরও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনে সঙ্গে এরও পরিসমাপ্তি ঘটে। কামেল মুর্শিদের কাছ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা না পেলে এই চিরন্তন সত্যও উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না।
মুর্শিদ প্রেমেই জানা যায় এই জাগতিক বা জৈবিক সম্পর্কযুক্ত প্রেমের বাইরে এমন এক প্রেম আছে, যার শুরু আছে শেষ নেই। সেই প্রেম জাগতিক অথবা জৈবিক স্বার্থযুক্ত নয়। সেই প্রেম স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, আশেকের সঙ্গে মাশুকের। অনন্তকাল সেই প্রেমের শিখা অনির্বাণ; জ্বলতেই থাকে নূরের তাজ্বাল্লি হয়ে। সম্ভবত সে কারণেই কবি লিখেছেন, ‘প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে/ স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।’ স্বর্গ থেকেই প্রেম এসেছে আল্লাহর সিফাত থেকে। মৃত্যুর পরও সেই অনন্ত প্রেম মমিনের হৃদয় বেহেশত জগতে জাগরুক থাকবে। তার মাশুকের সঙ্গেই কাটবে তার পরকাল।
পরম প্রেমময় বিশ্ব পালনকর্তা তাঁর সৃষ্টি জগৎ তথা আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। কেননা তিনি যত প্রাণি সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে মানুষকেই সব দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন। জ্ঞানে-বুদ্ধিতে দয়া মায়া প্রেমে, এক কথায় সব অর্থেই মানুষ শ্রেষ্ঠ। পরম করুণাময় আল্লাহ তার সমস্ত গুণাবলিই মানুষের মধ্যে দিয়েছেন। তা আছে সুপ্ত অবস্থায়। সেই সুপ্ত শক্তি আর গুণাবলি যারা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তারাই মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আহলে বাইয়াত হয়ে সেই শ্রেষ্ঠত্ব আজো রাসুলপ্রেমিক অলি-আল্লাহ তথা আউলিয়া কেরামগণ বহন করে চলেছেন। পরশ পাথরের মতো তাঁদের পবিত্র আত্মা। সেই আত্মা বা ক্বলবের সঙ্গে যারই আত্মার সংযোগ ঘচবেম তারই ক্বলবে নেমে আসবে চিরন্তন প্রেমের সেই অনন্ত ফল্গুধারা। তার প্রেমময় হৃদয় তখন মানবপ্রেমেও বিভোর হবে। গরিব-দু:খি সাধারণ মানুষকে এই সুফি-সাধকরাই ভালোবাসতে শেখান। নিজেকে তুচ্ছ জানা, অন্যের দোষ তালাশ না করে নিজের দোষ তালাশ করা, প্রতিটি প্রাণির প্রতি দয়া করা, ক্ষুধার্ত মানুষকে আহার দেয়া, দরিদ্র বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়া, শরিয়তের সমস্ত আদেশ নিষেধ পালনের মধ্য দিয়ে ধ্যান-মোরাকাবায় আল্লাহর জিকির অন্তরে জারি করা, এভাবে আত্মশুদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে হুজুরি দিলে আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তাঁর কুদরতি কদমে সেজদার মাধ্যমে নামাজ আদায় করাই হলো এই তরিকার মূল শিক্ষা। এসব শিক্ষা একজন কামেল পীর-মুর্শিদের নিবিড় সান্নিধ্যেই অর্জন করা সম্ভব।
কুতুববাগ দরবার শরীফের মহান মুর্শিদ আধ্যাত্মিক মহাসাধক শাহসুফি আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী ক্বেবলাজান হুজুরের কদমে আছি গত প্রায় এক যুগের অধিক কাল। তাঁকে দেখলে অন্তরে এমন অনুভূতি জাগে, যেন আল্লাহর রাসুলকেই দেখছি। আল্লাহপ্রেম জেগে ওঠে মনে। রাসুলে করিম (সঃ) যে সব গুণাবলি অর্জন করেছিলেন, সেইসব গুণ তাঁর জীবনেও দৃশ্যমান। আমি আমার এই জীবনে কত মানুষের কাছে গেছি কিন্তু খাজাবাবা কুতুববাগীর মতো এমন অমায়িক, এমন বিনম্র, এমন স্নিদ্ধ এবং এমন দয়ালু মানবপ্রেমিক আর কাউকে দেখিনি। তার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ। এক পত্রিকার সম্পাদক একবার দরবার শরীফে এসেছিলেন মুর্শিদ কেবলার সম্পর্কে খোঁজ দিতে। আসলে এসেছিলেন নিন্দুকদের নানা সমালোচনা শুনেই হয়ত। প্রেস ইন্সটিটিউটে আমি সাব এডিটরদের প্রশিক্ষণ ক্লাস নিই মাঝে মাঝে। পরে তার কাছ থেকেই জেনেছি ওই সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকও নাকি আমার ক্লাসে একাধিকবার ছিলেন। যা-ই হোক, খাজাবাবার সঙ্গে তিনি দেখা করলেন। দরবার শরীফ ঘুরে দেখলেন সব কিছু। তারপর তিনি এমন এক লেখা লিখলেন খাজাবাবার ছবি মোবারকসহ যা গভীর প্রেম ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। তার লেখার শিরোনাম ছিল ‘খাজাবাবা কুতুববাগীর সোহবত মুগ্ধ করেছে,’। কুতুববাগ দরবার শরীফে বাবার সান্নিধ্যে যারাই এসেছেন, তারাই মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের অনেকের জীবনধারাই পাল্টে গেছে। তারা প্রকৃত মানবপ্রেমিক শুদ্ধ মানুষ হয়ে গেছেন। এমন কি যারা দূর থেকে মিথ্যা রটনা আর অপপ্রচার শুনে সন্ধিহান ছিলেন, তারাও মুর্শিদ কেবলার সান্নিধ্যে এসে ভ্রান্ত ধারণা থেকে শুধু মুক্তই হননি, বাইয়াত গ্রহণ করে নতুন জীবনও লাভ করেছেন। আমি একবার দরবারে আসা কিছু মানুষ সম্পর্কে আমার দয়াল মুর্শিদের কাছে সবিনয়ে জানতে চেয়েছিলাম, বাবা এরা এত এলেমদার মানুষ অথচ শরিয়তের অনেক কিছু লংঘন করছে, যথা সময়ে নামাজ আদায় করছে না, অসত্য বলছে, অশালীন শব্দ উচ্চারণ করছে। বাবা এমন হয় কেন? আমার দরদী মুর্শিদ কেবলাজান সামান্যও বিরক্ত না হয়ে বললেন, বাবা আমি নদী। নদীতে সব কিছু আসে। ময়লা আবর্জনা, মাছের সঙ্গে সঙ্গে হাঙ্গর-কুমির পর্যন্ত আসে স্রোতে ভেসে, আবার চলেও যায়। তাতে নদীর পানি নষ্ট হয় না। কারণ, নদীর যোগ স্রোত সাগরের সঙ্গে। আর সব মানুষ তো বাবা হেদায়েতপ্রাপ্তও হয় না। তারা অন্তরে সত্য সুন্দরের প্রেমময় শিখা প্রজ্জ্বলিত করতে পারে না।
বাবার কথা শুনে মুহূর্তের আমার ধারণা স্পষ্ট হলো। কত বেনামাজি নামাজি হয়ে যেতে দেখলাম, নিষ্ঠুরকে দেখলাম দয়ালু হতে, মিথ্যা বলতো যে ব্যাক্তি, তাকে সত্যবাদী হয়ে যেতে দেখলাম। তা হলে কিছু মানুষ সৎপথে যদি তরিকা-মাফিক না চলে, তাতে হতাশ হবো কেন। দামি চালের মধ্যেওতো খুদ বালিকণা থাকে। থাকতেই পারে। আর একটা সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছি বাবার সান্নিধ্যে এসে, তা হলো তিনি সত্যিকার অর্থেই রাসুলের সমস্ত গুণাবলি তার ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করেন। নবীজির কাছে যেমন সব ধর্ম সব মতের মানুষ আসতেন এবং তিনি তাদের সাদরে গ্রহণ করতেন, ঠিক তেমনই খাজাবাবা কুতুববাগীও তার দরবারে সবাইকে সাদরে গ্রহণ করেন। এমনকি যারা তরিকাপন্থী নন, ক্ষেত্র বিশেষে এমনও দেখা গেছে, যে কেউ কোনও কুমতলব নিয়ে এসেছে, খাজাবাবা তাকেও সমান আদর যতœ করেছেন। দরবারে নতুর কেউ এলে প্রথমেই তিনি জানতে চান, খেয়েছেন কিনা । আগে কিছু খেতে দিতে খাদেমদেরকে নির্দেশ দেন। যে কোনও মানুষের দু:খকষ্ট অভিযোগ তিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এ এক অসীম ধৈর্য্যের ব্যাপার। প্রতিদিন শত শত মানুষ আসছেন। সবার নালিশ শুনতে হচ্ছে। কখনো কখনো রাত ১টাও পার হয়ে যেতে দেখেছি। যেমন গত ২৫ নভেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে আমরা একটার পরে বাবার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। হাসিমুখে সবার সব রকম অভিযোগ শুনে একটা সমাধান বাত্লে দেওয়া সহজ কথা নয়। গভীর জ্ঞানেরও প্রয়োজন। এই জ্ঞান ঐশ্বরিক আলোকিক জ্ঞান ছাড়া আর কিছু নয়।
এ প্রসঙ্গেই একটা ঘটনার উল্লেখ করি। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। খাজাবাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত জেনারেল (অব:) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেব। বাবা আর তিনি কথা বলছিলেন। সে সময় আমি গেলে মুর্শিদ কেবলা আমাকে ডাকলেন এবং সেখানে বসতে বললেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অনেক বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। তিনি কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, আমি দুনিয়ার বহুদেশ ঘুরেছি, বহু পীর মুুর্শিদের দরবারে গেছি, কিন্তু হুজুরের মতো এত জ্ঞানী মানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি। তিনি আরও বললেন, জানো নাসির অনেকের কার্যকলাপ দেখে পীর-মুর্শিদের ওপর থেকে আমার আস্থাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কুতুববাগী হুজুর আমার হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি আল্লাহর খাঁটি অলি সবাই নন কেউ কেউ।
তিনি যথার্থই বলেছেন, অনেক নাকেচ পীরের কারণে পীর-মুর্শিদ সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়। ইসলামের নামে অনেক সময় তারা এবং তাদের অনুসারিরা কখনো কখনো নিষ্ঠুরতারও আশ্রয় নেয়। বিভেদ সৃষ্টি করে ধর্মীয় কাজে পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অথচ খাজাবাবা কুতুববাগী বলেন, বাবা মানুষকে ভালোবাসাও এবাদত। কেননা ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে শরিয়ত ঠিক রেখে তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের শিক্ষা গ্রহণের জন্যই সবাইকে আমি আহ্বান করি। এখানে দলমত নির্বিশেষে সবাই আসবেন। অথচ খাজাবাবার এই শিক্ষা থেকে বহু দূরে অনেক ‘পীর’ অনেক ফাসেক আছে যারা পীর পরিচয় দেয়। অথচ নামাজ রোজাসহ ছোট বড় অনেক শরিয়ত তারা লংঘন করে। তাদের অনুসারীরাও তা করে। পীরকে সেজদা দেয় তারা। অনেকেই কট্টরভাবে দলীয় রাজনীতি করে। মারামারি হাঙ্গামা সমর্থ করে। রাস্তায় মিছিল করে। জঙ্গীবাদী কর্মকা-ও করে। কুতুববাগ দরবার এর ব্যতিক্রম। এখানে কোনো দলীয় রাজনীতি নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অনেক দলের নেতারা দোয়া নিতে আসেন। খাজাবাবা বলেন, বাবা কুতুববাগ হচ্ছে সমুদ্রের মতো এখানে মানব প্রেমের শিক্ষা নিতে সবাই আসবেন।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
খাদেম, কুতুববাগ দরবার শরীফ