আত্মার আলো ডেস্ক : কোনো সূফী সাধককেই শরিয়ত অমান্য করলে চলবে না। কেননা শরিয়ত অমান্য করলে কেউ মুসলমান থাকতে পারে না। আবার কেবল শরিয়ত আমল করেও সূফী হওয়া যাবে না। সূফী-সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে পীর-মুরিদ বা গুরু-শিষ্য পরম্পরা, এ সাধনার মধ্যে চরমভাবে নিষ্ঠাবান থেকে জীব তার পরমকে সন্ধান করেন। পরিপূর্ণরূপে খাঁটি মানুষ হতে গেলে অবশ্যই আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজন আছে এবং সে সাধনা কোনো কামেলপীর বা সূফী-সাধকের সান্নিধ্যে গিয়ে করলে শিষ্য বা মুরিদের কামিয়াবী অর্জনের পথ সহজ হয়। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) সূফী দর্শনকে মানুষের কাছে খুব সহজে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিরলস কলম চালিয়েছেন এবং তাঁর সুচিন্তার ফসল কিতাব আকারে তুলে ধরেছেন সারাবিশ্বের মানুষের সামনে। যাতে মানুষ বিস্মৃত না হন যে, আল্লাহর মনোনীত ইসলামের অন্তর্নিহিত সূফী মতাদর্শ একটি মৌলিক ও পরিচ্ছন্ন পথ বা পদ্ধতি। আর এ পদ্ধতি অনুসরণকারী হবেন সূফীসাধক, তাকে সাধনার মধ্য দিয়েই অভীষ্ট লক্ষে অর্থ্যাৎ আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে যেতে হবে। কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী দুনিয়ার জীবনযাপনের জন্য নির্ধারিত নিয়ম-নীতিকেই শরিয়ত বলা হয়। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য শরিয়ত অনুসরণ করা কর্তব্য। পারলৌকিক জীবনকে আরো সুন্দর করার জন্য, ইহলৌকিক জীবনেই আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্য দিয়ে জীবনকে উন্নিত করতে হয়, এ কারণেই সূফীবাদ নামক মরমী এক জীবনাদর্শের আবির্ভাব ঘটেছে, যা একদিকে তাত্ত্বিক আর অন্যদিকে ব্যবহারিক অনুশীলনীয়। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সময় থেকেই সূফী মতবাদের উৎপত্তি এবং ধীরে ধীরে তা সারাবিশ্বে উৎকর্ষ লাভ করে। কিন্তু একপর্যায়ে এই মতবাদ বিভিন্ন আত্মবিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এ অবস্থা থেকে সূফীবাদকে উত্তরণের মাধ্যমে শরিয়তের সঙ্গে তার সুন্দর সমন্বয় সাধনের জন্য সচেষ্ট হন। তবুও সেই আত্মবিরোধীরা এখনো কোথাও না কোথাও বিরোধ সৃষ্টিতে লিপ্ত রয়েছে, তবে তারা কখনোই সফল হতে পারবে না, কারণ সূফীবাদের ওপর রাসুল (সঃ)-এর অর্ন্তদৃষ্টি সদা জাগ্রত। ঢাকার ফার্মগেট কুতুববাগ দরবার শরীফের পীর কেবলাজানের সূফীবাদী আদর্শের মধ্যেও রয়েছে পরিপূর্ণ শরিয়ত ও পরিপূর্ণ ফারেফত। কেবলাজানের অমূল্য বাণীতে আমরা পাই, তিনি বলেন, ‘ইসলাম শুধু শরিয়ত নয়। শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত এ চারটি বিষয়ের সমন্বয়ে হলো পরিপূর্ণ ইসলাম।’ অন্তত শরিয়তের মৌলিক বিষয়গুলো সূফীতত্ত্ব অস্বীকার করে না, বরং কামেলপীর বা সূফী-সাধকগণ শরিয়তের ওপর জোর তাগিদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সূফীতত্ত্বের কিছু কিছু অপব্যাখ্যাকারী এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেন শরিয়তের সঙ্গে সূফীবাদের ব্যাপক বিরোধ। এ কারণে সূফীবাদ বলতেই সাধারণ মানুষ ইসলাম থেকে ভিন্ন মতাদর্শ ভাবতে শুরু করে। তবে কিছু কিছু ‘সূফী’ নামধারী এ মতাদর্শের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে আসছিলো, ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এ অবস্থা দেখে ব্যথিত হন। তিনি এর সংস্কার করা বড় দায়িত্ব মনে করলেন এবং সূফীতত্ত্বের সংস্কার সাধন করে শরিয়তের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে প্রয়াস নেন। বিভিন্ন সূফীসাধক ও ধর্মতত্ত্ববিদ আল্লাহর সঙ্গে গভীর প্রেমের বন্ধন গড়ে তুলতে ও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর সত্তায় বিলীন হওয়ার জন্য বিভিন্ন মত ও পথের সৃষ্টি করেন, এই পথ বা পদ্ধতিই হলো তরিকা। সূফীতত্ত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে ইমাম আল-গাজ্জালী (রহ.) দেখান যে, সূফীবাদ ও ইসলামী শরিয়তের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং একটি আরেকটির সহায়ক। সূফীবাদের মধ্যে কিছু তাত্ত্বিকতা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে দার্শনিক আলোচনার বিষয়বস্তু। সেখানে ব্যক্তিগত আবেগ, যুক্তি ও অভিরুচি আরোপ করা যেতে পারে, কিন্তু এই আত্মিকতা ও ব্যক্তিগত অভিরুচি এমন পর্যায় পর্যন্ত যাওয়া সঙ্গত নয়, যেখানে শরিয়তের সঙ্গে সূফীতত্ত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী (রহ.) অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কোনো সূফীতাত্ত্বিকের শরিয়তবিরোধী বা শরিয়তের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব বা তরিকা প্রদান করা সঙ্গত নয়। তিনি আরো বলেন, শরিয়তের মূল শিক্ষাকে অক্ষুণœœ রেখে যেকোনো তত্ত্ব বা ব্যবহারিক মতাদর্শ প্রদান করা যেতে পারে। তার জন্য চাই অতিরিক্ত সাধনা; আর এই সাধনার জন্য থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট সাধনা-পদ্ধতি। এই সাধনা-পদ্ধতি হলো সূফীতত্ত্ব। একজন সূফীর জীবনে শরিয়ত হলো প্রাথমিক এবং আবশ্যিক ধাপ বা স্তর।
জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে আল্লাহর সান্নিধ্য যদি কেউ লাভ করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই শরিয়তের সঙ্গে সূফী সাধনায় রত হতে হবে বলেও ইমাম গাজ্জালী (রহ.) মত প্রকাশ করেন। ইমাম গাজ্জালী কোরআন ও হাদিসের যুক্তি দিয়ে দেখান যে, কেবল শরিয়তের নিয়মে বাহ্যিকভাবে ইবাদত-বন্দেগী করলেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। এ জন্য ইবাদতের অভ্যন্তরীণ দিকের প্রতি কঠোর নজর দিতে হবে। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় ইবাদতের অভ্যন্তরীণ দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আর এভাবেই তিনি তাঁর সমসাময়িক বিভিন্ন প্রকার সূফীতত্ত্ব ও শরিয়তের মধ্যকার আপাতবিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেন। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) শরিয়তের সঙ্গে সূফীতত্ত্বগুলোর সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য। বস্তুুত তাঁর এই প্রয়াস শুধু শরিয়ত বা সূফীতত্ত্বকেই নয়, সার্বিকভাবে ইসলামকেই উপকৃত করেছেন। এ জন্য তাঁকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বলেও অভিহিত করা হয়। তাই আসুন, কামেল পীর-মুর্শিদ ও সূফীবাদের প্রতি সমালোচনা, হিংসা ও ভীতি দূর করে আল্লাহতায়ালার প্রিয় খাঁটি বান্দা ও রাসুল (সঃ)-এর আদর্শবান উম্মত হতে কামেল পীরের খাস সান্নিধ্য লাভ করি।