নুরুল আমিন বাবু
আমার ছোট বেলা থেকে নিয়মিত একটা অভ্যাস ছিল। রসুল (সঃ) এর জীবনী পড়া ও শুনা। যখন কোথাও কোন মাহফিল হত আমি সেখানে ছুটে যেতাম, বড় বড় মাওলানা মুফতি সাহেবদের মুখে রসুল (সঃ) এর গুণগান শুনতে ভালো লাগতো। রসুল (সঃ) এর জীবনী, সাহাবা কেরামগণের জীবনী এবং পীর-মাশায়েখগণের জীবনী পড়া আমার নিয়মিত অভ্যাস। তাঁদের সম্পর্কে যতই পড়ি ততো ভালো লাগে, আর তখন মনে তীব্র আকাক্সক্ষা জাগত যে, আমার জন্ম যদি রসুল (সঃ) এর জামানায় হতো, তাহলে রসুল (সঃ) এর সঙ্গী হতে পারতাম! রসুল (সঃ) এর সঙ্গী হয়ে ইসলাম প্রচারে অংশ নিতে পারতাম। এ নিয়ে একটা আপসোস আমার মধ্যে সব সময় কাজ করতো। কিন্তু রসুল (সঃ) তো আর শরিয়তিভাবে পর্দা করেছেন কিয়ামত পর্যন্ত পর্দায়ই থাকবেন। তবে কোরআন-হাদিসে আল্লাহ-রসুলের নির্দেশনা অনুযায়ি আল্লাহতা’লা যুগে যুগে বেলায়েতে মাশায়েক বা নায়েবে রসুল পাঠাবেন, যাঁরা বিভিন্ন বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকা পড়ে বিপথের দিকে চলে যাচ্ছেন, তাদেরকে রসুল (সঃ) এর আদর্শ তরিকার সত্য ও সুন্দরের পথ দেখাবেন।
আমার জীবনের এক পরম সৌভাগ্য যে, খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজান হুজুরের মধ্যে সেই অমূল্য ধন নায়েবে রসুল (সঃ) এর সুঘ্রাণ লাভ করতে পেরেছি। তাঁর বাচন-ভঙ্গি, কথাবার্তা, চাল-চলন, ধৈর্য্য শক্তি আদেশ-উপদেশসহ ইসলাম ধর্মের আসল সত্য, সুফিবাদের শান্তির বাণী প্রচারের যে পদ্ধতি এর সব কিছুর মধ্যেই রসুল (সঃ) এর বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাই। যাঁকে এক নজর দেখলে রসুল (সঃ) এর কথা মনে হয়, তাঁকে অনুসরণ করলে রসুল (সঃ) এর সত্য আদর্শের কথা মনে পড়ে। বাবাজানের সংস্পর্শে থাকার কল্যাণে প্রকৃত ইসলাম কি? এবং ইসলামে সুফিবাদ কি? বা শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত সম্পর্কে জানা, বুঝা ও শেখার চেষ্টা করছি ।
বাবাজানের তিনটি মূল শিক্ষা: (১) আত্মশুদ্ধি (২) দিলজিন্দা ও (৩) ইবাদতে (নামাজে) হুজুরী। এই তিনটি শিক্ষা যদি আমরা নিজেদের মধ্যে রপ্ত করতে পারি, তাহলে আমরা প্রকৃত মুমিন বান্দা হতে পারবো।
আমিত্বকে বিলীন করে নিজেদের মধ্যে যে খারাপ রিপুগুলো আছে, তা পাক-সাফ করে আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ, জিকিরের মাধ্যমে দিলকে জাগ্রত রাখা এবং আল্লাহকে (হাজির-নাজির) উপস্থিত জেনে নামাজে হুজুরি (একাত্মতা) আনা। বাবাজানের কাছ থেকে অনেক অজানাকে জানতে পারছি, যেগুলো নিজের আয়ত্তের মধ্যেই ছিল কিন্তু এতদিন অজ্ঞানতা এবং অবহেলার কারনে জানতে ও বুঝতে পারিনি। একজন সত্যিকারের মুর্শিদ বা মানুষ-গুরু-ই পারেন আমাদের ছোট-বড় সব ধরণের মন্দ স্বভাব থেকে বেঁচে থাকার সঠিক শিক্ষা দিতে। বাবাজানের কাছে বাইয়াত গ্রহণের পর থেকে আমি নিজের মধ্যে তা অনুভব করছি যে, ইমান এবং আমল দুটোই ঠিক রেখে কীভাবে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করা যায়।
বাবাজানের কাছে মুরিদ হবার পর বুঝতে পারলাম, তাঁর মুরিদ কখন কোথায় কি করে, কোন অবস্থায় আছে বা থাকে সব খবরই বাবাজান রাখেন। এমনই একটি কেরামতির কথা এখন আমি আপনাদের বলবো। বাবাজানের সাথে বন্দর, নারায়ণগঞ্জের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, অনুষ্ঠানস্থলের গেটে এবং এর আশপাশে অনেকগুলো কুকুর দেখতে পেলাম। আমি যখন গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করি তখন কুকুরগুলো তাড়িয়ে তারপর ভিতরে প্রবেশ করলাম। কিছুক্ষণ পর আমি চা খাওয়ার জন্য দোকানে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বেঞ্চের পাশে কতগুলো কুকুর, আমি কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে বেঞ্চে বসলাম। কিন্তু কুকুরগুলো তাড়ালেও আবার এসে জড়ো হয়, তাই একটু পর পরই কুকুরগুলোকে তাড়াচ্ছিলাম। কুকুরগুলো এলোমেলো দৌড় দিলে একটি কুকুরের শরীরে আমার ধাক্কা লাগলে আমি বিরক্তবোধ করি, কারণ আমাকে এখন পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। আবার অযু করতে হবে। এও ভাবছি যে আমার পোশাক নাপাক হয়েছে কি না? যাই হোক, চা খেয়ে আমি মাহফিলে চলে গেলাম, কিছুক্ষণ পর বাবাজান মঞ্চে আসলেন, নসিহত-বয়ান শুরু করলেন। আমি অবাক হলাম, বাবাজান নসিহত বাণীর শুরুতেই যে কথা বললেন তা শুনে! বাবাজান বললেন, একদিন এক বুুজুর্গ ব্যক্তি একটি সরু পথ দিয়ে যাচ্ছিলো, অপর পাশ থেকে একটি কুকুর আসছিল, কুকুরটিকে দেখে বুজুর্গ ব্যক্তি বলল এই কুকুর তুই সর, তোর গায়ে আমার শরীর লাগলে আমার পোশাক নাপাক হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতা’লা কুকুরের জবান খুলে দিলেন, এবার কুকুর বলল, হে বুজুর্গ, তুমি এত বড় বুুজুর্গ আমার গায়ে তোমার পোশাক লাগলে ময়লা হয়ে যাবে। কিন্তু তা পানিতে ধুলে পরিস্কার হবে, তোমার মনে এত হিংসা, যা পৃথিবীর সমস্ত পানি দিয়ে ধুলেও তোমার মনের হিংসা দূর হবে না। বুজুর্গ ব্যক্তি এবার লজ্জিত হলো এবং তাঁর ভুল বুঝাতে পারলো। এরপর ওই বুজুুর্গ ব্যাক্তি নিজে কাদায় নেমে কুকুরের জন্য পথ ছেড়ে দিলেন। বাবাজানের মুখে যখন আমি এই নসিহত বাণী শুনলাম, তখন আমিও নিজের ভুল বুঝতে পারলাম এবং নিজের ভিতর যে দ্বিধা-দন্দ্ব ছিল তা দূর হয়ে গেল।