নাসির আহমেদ আল মোজাদ্দেদি
আমরা সুন্নি মুসলমান হানাফী মাজহাবের অনুসারী, আমাদের ইমাম, ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা (রঃ)। তাঁর আসল নাম নোমান বিন সাবেত। তিনি ছিলেন তাবেঈ। একশত পঞ্চাশ হিজরীতে ইরাকের বাগদাদে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সবকিছুর মধ্যেই ইলমে তাসাউফের রূপরেখা সফলভাবে বিকশিত হয়ে আছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত সদয় অনুগ্রহপ্রবণ ও উত্তম রীতিনীতির এক উজ্জল নির্দশন। সেই সময় তাঁর মাধ্যমেই ইলমে তাসাউফের ব্যাপক বিস্তার লাভ করেন। ‘দুর্রে মুখতার’ কিতাবের লেখক আল্লামা মুহাম্মদ বিন আলী বিন মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন হাছকুফি (রঃ) [মৃত্যু ১০ই শাওয়াল ১০৮৮ হিজরী] বলেন, আমি ইলমে তাসাউফ অর্জন করেছি হজরত শিবলী (রঃ) থেকে, তিনি হজরত ছিররী সকতী থেকে, তিনি হজরত মারূফ কারখী (রঃ) থেকে, তিনি হজরত দাউদ তায়ী থেকে, তিনি ইলমে তাসাউফ, ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকাহ অর্জন করেছেন ইমাম আবু হানিফা নুমান বিন সাবেত (রঃ) থেকে।’ আল্লাহতায়ালার সুগভীর ভেদতত্ত মারেফতের অমূল্য এ জ্ঞান তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, খাঁটি যোগ্য শিষ্য তৈরি করে গেছেন। তাঁরাও নিরলসভাবে দেশ থেকে দেশান্তরে, বন থেকে বনান্তরে নিয়ে গেছেন ঐশী আলোর বাণী এবং সত্য পথের দিশা দিয়ে মানুষ ও সমাজের আঁধার দূর করেছেন। বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনায় এসেছে যে, শতশত শতাব্দীর ব্যবধানে এমন চারজন শ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন যারা ইলমে তাসাউফের মধ্যে থাকার কারণে তাঁদের জীবন মর্যাদা ও অবস্থান উজ্জল নক্ষত্রের মতো সারাজাহানে আলোকিত হয়েছে। ইমাম মহিউদ্দিন শরীফ নদভী ‘আল মাকসাদ’ কিতাবে আধ্যাত্মিক সাধনার মূলনীতি বর্ণনায় লিখেছেন, নির্জনতায় বা অনির্জনতায় সর্বাবস্থায় আল্লাহতায়ালার তাকওয়া অবলম্বন করা। কোন কাজ বা উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে হুজুরপাক (সঃ) এর কাজ বা উপদেশ অনুসরণ করা। অধিক বা স্বল্প রিযিকে আল্লাহর উপর কৃতজ্ঞ থাকা। সুখে-দুঃখে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ থাকা। তেমনই আমাদের হানাফী মাজহাবের আরো একজন অলিআল্লাহ যিনি ইলমে তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক মহাসাধক হজরত জুনাঈদ বোগদাদী (রঃ) তাঁর তরিকার মূল নীতি বা আদর্শে মধ্যে রয়েছে, কোন আমল লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না করে ইখলাসের সঙ্গে আমল করা। ইমামে আজম আবু হানিফা নোমান বিন সাবেত (রঃ) তাসাউফপন্থি তথা সূফী-সাধকদের আধ্যাত্মিক মহাগুরু ছিলেন। তাঁর সমস্ত জীবনই যে ইলমে তাসাউফের মধ্যে বিশেষত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলো এ ব্যাপারে বহু আগেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষক-বিশ্লেষকগণ একমত হয়েছেন। ইলমে তাসাউফপন্থি সূফী সাধকদের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে, সূফীশাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য কিতাব ‘আলফুতুহাত ওয়াল আয়ওয়াক’ এ লিখেন, ইমাম আবু হানিফা (রঃ) সূফী সাধকদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি শুধু ভালোই বাসতেন না বরং তাঁদের আধ্যাত্মিকতার স্তর ও জীবনযাত্রাকেও অনেক সম্মান করতেন। তাই প্রাচ্যবিদগণ দ্রুত ইসলামী ইলমের শিক্ষা জরুরীভাবে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ও সুন্দর একটি রূপে রূপান্তরিত করার জন্য, তাঁর প্রতি গভীর মনোনিবেশ করেন। এভাবেই ইলমে তাসাউফের শিক্ষা-দীক্ষাকে সময়োপযোগী করার জন্য সূফী-সাধকগণ আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তাঁদের থেকে প্রাচ্যের বিখ্যাত পন্ডিতগণও ইলমে তাসাউফের নিগুঢ় সন্ধান লাভের জন্য সূফী সাধকদের সঙ্গ নিতেন। তাই আসহাবে কুলুব ও পন্ডিতগণ বিভিন্ন সময়ে তাঁদের লেখাসহ যেকোন তথ্য বা তত্ত কাজে প্রাচ্যবিদগণের ইলমকে অনুসরণ করতেন। আর এই একনিষ্ট সূফী- যাঁদেরকে স্বয়ং রাসুল (সঃ) এ পৃথিবীর বুকেই শাফায়াত করেছেন, অর্থ্যাৎ মসজিদে নবুবীর বারান্দায় যাঁরা আল্লাহর ধ্যান-সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন তাঁদেরকে রাসুল (সঃ) জান্নাতী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের সেই মহান ব্যক্তিবর্গের নির্লোভ সাধনা ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে ইলমে তাসাউফ শাস্ত্র। যে শাস্ত্র চর্চার মধ্যে রয়েছে নিরন্তর শান্তির সুশিতল পরশ। এ কারণেই একজন সূফীবাদ চর্চাকারীর জীবন-যাপন ও কর্মে অন্য দশজনের চেয়ে সামান্য হলেও ব্যতিক্রম দেখা যায়। কিন্তু বহুকাল থেকেই সূফী-সাধকদের সরল প্রাণের সুযোগ ব্যবহার করে, ইসলাম ধর্মে এক শ্রেণির উগ্র ইয়াজিদী মুসলমান ভোগ-বিলাসের মোহে গোমরাহীর পথ বেছে নিয়েছেন। তাহলে প্রকৃত ইলমে তাসাউফ কোনটি? যেমন যেকোন বিষয়ের দুটি দিক থাকে, একটি ইতিবাচক অন্যটি নেতিবাচক। ইসবাত বা ইতিবাচক : ইতিবাচক তাসাউফ বলা হয় ঐ তাসাউফকে যা পবিত্র কোরআন-হাদিসের দ্বারা পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ও আল্লাহকে পাওয়ার সুগম পথ পরিচালনা শিক্ষা দেয়। আমরা দেশ-বিদেশে অগনিত আশেক-জাকের ভাই-বোন সকলের অন্তপ্রাণের প্রিয় মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের কাছে ইলমে তাসাউফের মূল আদর্শ বা ইতিবাচক শিক্ষাই পেয়ে থাকি। অন্যদিকে মহান আল্লাহতায়ালার মনোনীত ইসলাম ও নূরনবী রাসুল (সঃ)এর মৌলিক আদর্শ তথা ইলমে তাসাউফ থেকে ছিটকে পড়া গোত্রই হলো তাসাউফের ‘নফী’ নেতিবাচক। তারা ইলমে তাসাউফ তথা সূফীবাদের অনুসারি ও পীর-ফকিরদের জীবনাদর্শকে বেদাআত বলে অপপ্রচার করেন। এ জন্যে অতি সাধারণ মানুষের কাছে তাদের অজ্ঞতা ও ভুলবশত কিছুটা সমর্থন পেলেও, তারাসহ বাকিরা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ দরবারে চরম অপমানিত হওয়ার বন্দবস্ত পাকা করছেন। ইলমে তাসাউফ তথা সূফীবাদের উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ইসলামের প্রচার ও প্রসার মধ্যপ্রাচ্য থেকে এবং ইসলামের মধ্যে মতের বিভক্তিও শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তাই অনায়াসে বলা যায় এদেশে সূফীবাদের বিদ্বেষীরা ওইসব দেশেরই এজেন্ট হয়ে কাজ করছেন। যেমন স্বচ্ছ আয়নার উপর কাদা ছিটালে আয়নাটি আর পরিস্কারভাবে নিখুঁত প্রতিবিম্ব দেয় না। তেমনই তাদের অন্তর আত্মার ওপর কলুষতার কালি পড়ে গেছে, তাই সেখানে কোন দৃশ্য বা ধারণা তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিতে আসে না। দুনিয়ার মোহে সেচ্ছায় তারা প্রতিদ্বন্দ্বি রুপে আবির্ভূত হয়েছেন! কিন্তু ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) এর জীবন আধ্যাত্মিকতার আমল দ্বারা পরিপূর্ণ ছিলো। তাঁর দাদার নাম ছিলো জাওয়াহ। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর নাম রাখেন নোমান। আর নোমানের সঙ্গে হযরত আলী (রাঃ) এর সুসম্পর্ক ছিলো। যদি বলা হয় যে, ইলমে তাসাউফ তথা সূফীবাদের সুবিশাল শহর হলেন দয়াল নবী কারীম (সঃ) এবং সে শহরের দরোজা ছিলেন শের-এ খোদা হযরত আলী (রাঃ), সে শহরের ভিত্তি বা খুটি ছিলেন আমীরুল মোমেনীন হযরত আব বক্কর সিদ্দীক (রাঃ), সে শহরের দেয়াল ছিলেন আমীরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এবং শহরের ছাদ ছিলেন আমীরুল মোমেনীন হযরত ওসমান গনী (রাঃ)। একদিন হযরত নোমানের ঘরে একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিলে তার নাম রাখা হয় সাবেত। হযরত নোমান নবজাত সন্তান সাবেতকে নিয়ে হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে গেলেন দোয়া নিতে। হযরত আলী (রাঃ) নবজাতকের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। এরপর একদিন সাবেত বিন নোমানের ঘরে জন্ম হয় এক পুত্র সন্তান, সাবেত তার ছেলের নাম রাখলেন বাবার নামে ‘নোমান’ অপর নাম হলো আবু হানিফা। অর্থ্যাৎ নসবনামা হলো নোমান বিন সাবেত বিন নোমান। হযরত আবু হানিফা (রঃ)এর শিক্ষকদের শিক্ষক ছিলেন আমীরুর মোমেনীন হযরত আলী (রাঃ), আর এ থেকেই বোঝা যায় ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রঃ) এর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা ও বিশালতা সম্পর্কে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সময় থাকতে আধ্যাত্মিকতা বোঝা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পবিত্রভাবে জীবনযাপন করার তাওফিক দান করুন আমিন।