হযরত মুহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং সূফীদর্শনের প্রবর্তক

বাদল চৌধুরী

আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো সূফীবাদ। সার্বক্ষণিক আল্লাহতায়ালাকে স্মরণের মাধ্যমে কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেম অর্জন সূফীবাদের উদ্দেশ্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাতিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাই সূফীবাদের মর্মকথা ও মুখ্য বিষয়। আপন নফসের সঙ্গে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ ব্যাতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করতে পারলেই কেবল ইহকাল ও পরকালে শান্তি পাওয়া যাবে। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। আর তাসাওউফ দর্শন বা সূফীবাদ অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্শাইখ, ফানাফির রাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন অন্তরে সার্বণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। আর এ কাজটি কারো পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন একজন কামেল মুর্শিদ। যিনি মাধ্যম বা উছিলা হিসাবে আল্লাহকে পাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবেন। যিনি পথভ্রষ্টদের এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করিয়ে থাকেন, ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকে পীর-মুর্শিদ বলা হয়।

পাপের সাগরে নিমজ্জিত মানুষকে হেদায়েতের জন্য কাল পরিক্রমায় আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে নবী-অলি-আউলিয়া-পীর-মুর্শিদের জগতে পাঠিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা মায়িদা’র ৩৫ নং আয়াতে বলেন, ‘ইয়্যা আয়্যু হাল্লাযীনা আ-মানুত্তাকুল্লা অবতাগু ইলাইহিল উছিলাহ’। অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় কর এবং তাহাকে পাওয়ার জন্য উছিলা (মাধ্যম) তালাশ কর।
এছাড়াও মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা নিছা’র ৫৯ নং আয়াতে আরো বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুা-হাল্লাযিনা আমানু আত্বি’উল্লা-হা ওয়া আত্বি’র্উ রাসুলা ওয়া-ঊলিল্ আম্রি মিন্‌কুম’। অর্থ : হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করো, তবে তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসুলের অনুগত হও এবং রাসুলের ইত্তেবা, পায়রুবি কর। তোমাদের কওম ও জামানায় যাঁরা সাহেবে হুকুম ও কামেল পীর-মুর্শিদ তাঁদের অনুগত হয়ে যাও এবং তাদের পায়রুবি কর। আর রাসুল (সঃ) বলেন, ‘আস্ শাহিকু ফি কাওমিহি কান্ নাবিয়্যি ফি উম্মাতিহি’। অর্থ : তোমাদের কওমে বা জামানায় যাঁরা কামেল মুর্শিদ পাবে, তাঁদেরকে রাসুলতুল্য ভলোবাসবে, যে রকম আমার সাহাবাগণ আমাকে ভালোবেসেছে, তদ্রুপ তোমরাও তোমাদের কামেল মুর্শিদকে ভালোবাসবে।

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং সূফীদর্শনের প্রবর্তক। মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, ‘মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কল্ব বা হৃদয়। আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয়’। শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে ঘোর-কলিযুগের পাপসংকুল পৃথিবীতে সৃষ্টির কুল কায়েনাতের মূল উৎস দো’জাহানের নবী মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে অসংখ্য ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া বা বেলায়েতে মাশায়েখগণ আগমন করেছেন এবং করতে থাকবেন। তাঁরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের পাপী-তাপী-গুনাহগার ও পথভ্রষ্ট মানুষেদের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সঠিক পথের সন্ধান দিবেন।

বাংলাদেশে নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার বর্তমানে একমাত্র খেলাফতপ্রাপ্ত পীর- মুর্শিদ, আরেফে কামেল, মুর্শিদে মোকাম্মেল শাহসূফী আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী (মা.জি.আ.) কেবলাজান হুজুর। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মনোনীত অলি-বন্ধু। এই জ্ঞান তাপসের আধ্যাত্মিক গুণের আলোয় মানুষের অন্ধকার কলব প্রতিনিয়ত আলোকিত হচ্ছে এবং যাঁর আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের নূরানী স্পর্শ, আর তাঁর পবিত্র সান্নিধ্য পাওয়ার বুকভরা আশা নিয়ে ছুটে আসছেন কুতুববাগ দরবার শরীফে। আমার প্রাণপ্রিয় পীর-মুর্শিদকেবলাজানের সুমহান শিক্ষা-‘আদব, বুদ্ধি, মহব্বত, সৎ-সাহস, বিশ্বাস ও ভক্তি। খাজাবাবা কুতুববাগী বলেনÑ ‘বাবারা অন্যের দোষ দেখার আগে নিজের দোষ তালাশ করেন। গীবত বা পরনিন্দার মতো গর্হিত কাজ কেউ করবেন না। মা-বাবার খেদমত করবেন, ছোটদের স্নেহ করবেন, বড়দের শ্রদ্ধা করবেন। আর ক্ষুধার্ত মানুষ পেলে খানা খাওয়াবেন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন। মা-বোনদের পর্দায় রাখবেন, সম্মান-ইজ্জত দিবেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন। পীরের দেয়া অজিফা আমল নিয়মিত করবেন’। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর কেবলাজানের শিক্ষা অনুযায়ী যে আমল সকল মুরিদের করতে হয়,

ফজরের নামাজের পর মনোযোগসহ পাককালাম ফাতেহা শরীফ পাঠ ও বিশেষ মোনাজাত করতে হয়। ১. আওযুবিল্লাহ্ ও বিসমিল্লাহ্-সহ তওবা (ইস্তেগফার) সাত বার, (উচ্চারণ : আস্তাগফিরুল্লা-হা রাব্বী মিন কুল্লি জাম্বিউ ওয়া আতুবু ইলাইহি।) ২. বিসমিল্লাহ্-সহ সূরা ফাতেহা তিন বার। ৩. বিসমিল্লাহ্-সহ সূরা ইখ্লাস দশ বার। ৪. দুরূদ শরীফ এগারো বার, (উচ্চারণ : আল্লাহুমা ছল্লি আলা সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিউ ওছিলাতি ইলাইকা ওয়া আ-লিহী ওয়া ছাল্লিম।) এরপর খতম শরীফ আদায় করতে হয়। ১. দুরূদ শরীফ একশত বার । ২. পাঁচশত বার ‘লা হাওলা ওয়ালা কুউ’আতা ইল্লা বিল্লাহ’ । ৩. দুরূদ শরীফ একশত বার।

যোহরের ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর দুই রাকাত নফল নমাজ আদায় ও মোনাজাত করতে হয়, প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফেরুন ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা এখলাস।

আছরের নামাজের পরে তসবীহে ফাতেমী অর্থাৎ, সুবাহানাল্লাহ্ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ্ ৩৩ বার এবং আল্লাহু-আকবার ৩৪ বার পড়তে হয়।

মাগরিবের ফরজ ও সুন্নত নামাজের পরে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় ও মোনাজাত করতে হয়, পূর্বের নিয়মে (যোহরের)।
এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পরে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় ও মোনাজাত করতে হয়, পূর্বের নিয়মে (যোহরের)। বেতের নামাজের পরে পাঁচশত বার দুরূদ শরীফ পড়িয়া নবী পাককে নজরানা দিতে হয়।

রাত্রির তৃতীয় ভাগে রহমতের সময় ইয়া আল্লাহু, ইয়া রাহমানু, ইয়া রাহিম- আল্লাহর এই তিন নাম ধরে ও দয়াল নবীকে ইয়া রহমাতাল্লিল আলামিন বলে ডাকতে হয়।

কুতুববাগ দরবার শরীফের সদর দপ্তর ৩৪ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা-তে প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের পর থেকে সাপ্তাহিক ইসলামী দোয়া মাহফিলের জলসা ও কোরআন-হদিসের আলোকে দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনা হয়। এশার নামাজের পরে পীরকেবলাজান সকল মুরিদদের আত্মার পরিশুদ্ধির তালকীন দিয়ে থাকেন এবং রাত্রির তৃতীয় ভাগে মুরিদদের সঙ্গে নিয়ে ‘রহমতের ডাকে শামিল হন।

মুর্শিদ কেবলাজানের আরো অনেক শিক্ষা আছে যে সব শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের পরিশুদ্ধ করে নিচ্ছি, যা সঠিকভাবে পালন করতে পারলে পরকালের মুক্তির ও ইহকালের শান্তি লাভ করা যাবে। একুশ শতকের আধ্যাত্মিক মহাসাধক খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান অক্লান্ত ভ্রমণ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, শহর-বন্দরে মানুষকে সূফীবাদের দাওয়াত দিচ্ছেন। শুধু দেশেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সফর করছেন, উদ্দেশ্য একটাই পথহার জনগোষ্ঠীকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে, আল্লাহর দিকে রুজু করানো। খাজাবাবা বলেন, ‘বাবারা আমিও আমার পীর-মুর্শিদের হুকুম পালন করছি মাত্র, আমিও আপনাদের মতো তরিকতের একজন কর্মী’। বাবাজান দোয়া করেন বলেই আমাদের অনেক জটিল কাজ সহজেই সমাধান হয়ে যায়। আমরা যারা বাবাজানের রুহানী সন্তান, তাদের উদ্দেশ্যে সবসময়ই বলেন, ‘আপনারা প্রত্যেকেই দয়াল নবীজির সত্য তরিকার প্রচারক, যে যেখানেই যাবেন আপ্রাণ চেষ্টা করবেন তরিকার দাওয়াত দিতে, আল্লাহ ও রাসুল (সঃ) আপনাদের সকল প্রকার সাহায্য ও জান-মালের হেফাজত করবেন। তাই আমরাও বাবাজানের দোয়া নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করি দয়াল নবীর সত্য তরিকার দাওয়াত দিতে।

আমার খুব বেশি দিন হয়নি তরিকা গ্রহণের বয়স, তবু এ অল্প সময়ের মধ্যে যেটুকু বুঝতে পেরেছি এবং জানতে পেরেছি, তাতেই মনে হয়েছে যে, এমন সত্য পথের সন্ধান আমি কেন আরো আগে পেলাম না! যদি আগেই পেতাম তা হলে হয়তো আমার জীবনকে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে পারতাম, যে জীবনের হাতছানি পেলে কাউকেই হতাশার ঘেরাটোপে পড়তে হয় না। তাই মহান আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া জানাই এ জন্য যে, দেরিতে হলেও এটুকু আনন্দ যে, এ পথ ধরেই যেন যেতে পারি শেষ নিশ্বাসের মুহূর্ত পর্যন্ত।

(Visited 1,092 times, 1 visits today)
Share