মানবপ্রেমের পাঠশালা

নাসির আহমেদ আল মোজাদ্দেদি

‘শুন হে মানুষ ভাই
সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই…’
সেই কোন সুপ্রাচীন কালের কবির উচ্চারণ! আজো বিস্মিত হয়ে দেখি মানবতার এই বাণীই চির সত্য।
অর্থাৎ মানুষ যে আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে সৃষ্টির সেরা জীব, সে কথা যুগে যুগে মুনিঋষিরা তো বলে গেছেনই, বলে গেছেন কবি-সাহিত্যিক এবং আধ্যাত্মিক মহাসাধকেরাও। পবিত্র কোরআন শরিফসহ পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থেও মানুষেরই মহিমার কথা নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে। মানবগুরুর দীক্ষাই যে বড় জ্ঞানের ভা-ার সেকথাও আমরা জানি। পবিত্র হাদিস শরিফেও মানুষের মহত্তের কথা বলা হয়েছে।
সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই, এই চিরসত্য জেনেও ক’জন আমরা নিজের ভেতরে যে এই মহত্ত লুকিয়ে আছে,তা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি? যারা আবিষ্কার করতে পেরেছেন, তারা মহৎ মানুষ হয়ে মানবজাতির দীক্ষাগুরু রূপে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। আর যারা নিজেকে চিনতে পারেননি, তারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকেও চিনতে পারেননি। আর মানুষের পরম সত্তার মহিমাও বুঝতে সক্ষম হননি। যে কারণে পবিত্র হাদিস শরিফে স্বয়ং রাসুল করিম (সঃ)-এর জবানিতে পাওয়া যায়Ñ ‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু।’
অর্থাৎ যে নিজেকে বা নিজের নফসকে চিনতে পেরেছে, সেই পরম করুণাময় আল্লাহকে চিনতে পেরেছে। কারও পক্ষেই একা একা নিজেকে চেনা এবং আল্লাহকে চেনা সম্ভব নয়। সে জন্য পূর্ণ এবং পূণ্য মানুষ হতে হয়। সাধনার দ্বারা, ধ্যানের দ্বারা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নিজেকে চিনতে হয়। সেই চেনার জন্য চাই একজন পরম গুরু। যাকে বলা যায় আধ্যাত্মিক মহাসাধক। সেই সাধক বা সিদ্ধ পুরুষের সন্ধান পেলেই প্রকৃত মানুষের মহত্ত্ব অর্জন করা যায়। নিজের ভেতরের পরম অচিনকে চেনা যায়। পৃথিবীতে যত মহামানব এবং পরম সাধকদের কথা জানা যায়, তারা সকলেই কোনো না কোনো উছিলায় নিজেকে চেনার সাধনার সুযোগ পেয়েছেন। সকল অলি-আল্লাহ বা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়াগণও কোনো না কোনো মহান গুরু সাধক, কামেল পীর-ফকিরের সান্নিধ্য ও সেবার মধ্য দিয়ে পরম জ্ঞান লাভ করে সিদ্ধ পুরুষ হয়েছেন।
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান, এ সত্য কবিতায় পড়ে জেনেছিলাম বাহ্যিক অর্থ মাত্র, এর প্রকৃত স্বাদ, এর বাস্তব প্রমাণ পেলাম আমার মোর্শেদ যুগের হাদি খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের নৈকট্য লাভ করে।
তিনি নিজেকে চেনার যে পরম সাধনায় বহু বছর ধরে নিমগ্ন, সেই নিমগ্নতার সামান্য অনুসরণও যারা করতে পারছেন, তাদেরই জীবন বদলে যাচ্ছে। নিষ্ঠুর মানুষটিও নিষ্ঠুরতা ভুলে গিয়ে কোমল হৃদয়ের অধিকারী হচ্ছেন। বেনামাজি নামাজি হচ্ছেন। অবিশ্বাসী বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন। গত প্রায় দেড় যুগ ধরে খাজাবাবার সান্নিধ্যে আসা অনেক মানুষের পরিবর্তন দেখলাম। এ আমার পরম সৌভাগ্য। খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান সবসময় বলেন, বাবারা, মানবসেবাই পরম ধর্ম। আপনারা মানবসেবা করবেন সাধ্যমতো। নিজের দোষ তালাশ করবেন, অন্যের দোষ খুঁজবেন না। তাহলেই শুদ্ধ মানুষ হয়ে যাবেন।
এই বাণী যে কত বড় সত্য, তা এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা সুফিসাধক পীর ফকিরদের জীবনাচারের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যাবে। তারা তলোয়ার চালিয়ে ইসলাম প্রচার করেননি, আধ্যাত্মিক সাধনা দ্বারা, মানবসেবা আর মানুষকে ভালোবেসেই তাদের মন জয় করে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে শান্তির ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছেন। আমরা খাজাবাবা কুতুববাগীর দরবারেও সেই মানবপ্রেমের শিক্ষা পাই। তাঁর দরবার শরীফে গরিব-ধনী ভেদ নেই, ধর্ম-বর্ণ ভেদ নেই, সকলেই সমান। সব মানুষই খাজাবাবার কাছে নিত্য দিন আসেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ আসেন। তিনি তাদের সব কথাÑঅভাব অভিযোগ, রোগ-শোক এমনকি আত্মার সমস্যার কথাও মনোযোগ দিয়ে শোনেন। সবর (ধৈর্য) ধারণের শিক্ষা দেন। আল্লাহর পথে, সৎপথে, মানবসেবার পথে চলার শিক্ষা দেন। কুতুববাগ দরবারের লঙ্গরখানা বারোমাস খোলা, সেখানে ধনী-গরিব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সবাই তবারক গ্রহণ করেন। মানবসেবার জন্য দানও করেন অনেকে। মানবপ্রেম শেখার এমন পাঠশালা তো দীর্ঘ জীবন-পথে আর কোথাও দেখলাম না। তাই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ চিত্তে বলি, আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শোকরিয়া, এখানে আসতে পেরেছি। আল্লাহ সবাইকে নামাজে হুজুরি, দিলজিন্দা আর মানবপ্রেমের শিক্ষা গ্রহণের জন্য এই দরবারে আসার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

(Visited 166 times, 1 visits today)
Share