সেহাঙ্গল বিপ্লব
মানুষের ভেতরে আর বাহিরে সবখানেই শুধু অশান্তি আর অভাব। সারাক্ষণ জীবন আর সংসারের ঘানি টেনে ক্লান্ত হয়ে ফিরছে ঘরে। তবু সুখ নেই। কোথাও সুখ নেই। যে যার মত করে চলছি, যেন কেউ কারো কাছে দায়বদ্ধ নই। তবুও নিত্য প্রয়োজনের ফিরিস্তি হাজির হয় সামনে। যার যত প্রয়োজন তাকে ততো বড় চিন্তার অক্টোপাস গ্রাস করে নিচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মহামূল্যবান সময়ের অমূল্য একেকটি মুহূর্ত। এলোমেলো করে দেয় একান্ত নিজের জন্য একটু সময়। যে সময়টুকু হবে একান্ত আমার, যেখানে জৈবিকতার কোন স্থান নেই। কিন্তু শত দেয়ার পরও কারো প্রয়োজন মিটছে না। দিনদিন কপালের ভাঁজে চিন্তারেখা প্রবল হয়ে উঠছে। দুঃশ্চিন্তার মত এমন চিতা, তার আগুন কমছেই না, বেড়েই চলছে বিরামহীন। সঙ্গে আরো যেন বুকভরা চাপা দীর্ঘশ্বাসের বাতাস পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে জ্বলছে! চারিদিকে শুধু হা-হুঁতাশ!
কোথায় গেলে মিলবে শিশিরভেজা স্নিগ্ধ ভোরের মত শান্তিময় একটু সোনালী রোদের দেখা? যেখানে তাড়া করে ধরতে পারবে না দুঃশ্চিন্তা নামের অকাল ব্যাধি। এই ব্যাধির খপ্পরে জীবন যাই যাই করে বেঁচে আছি। তবু কি সুখে থাকা যায়? তাহলে? হায় আল্লাহ! কী হবে আমাদের? আমরা কি তোমার দেয়া শান্তির একটু পরশ পাবো না? এমন খেদোক্তি আমরা প্রায়ই করে থাকি, তা হোক সে একা একা, অথবা অন্য কারো সঙ্গে। চারিদিকে অশান্তির ঘেরাটোপ এ থেকে মুক্তি দিতে পারে শুধু ইসলামের সহজ-সরল ‘সুফিবাদ’ এর পথ। যে পন্থা এসেছে মহান আল্লাহতায়া’লার পবিত্র কোরআন এবং প্রিয়নবী রাসুল (সঃ)-এর প্রবর্তিত ইসলামের সত্য তরিকা থেকে। আর এই তরিকতের মহা নেয়ামতই হলো সুফিবাদের আমল ও শিক্ষা। যে আমল ইলমে শরিয়ত ও মারেফতসম্মত। যে শিক্ষা হিংসা ও অহংকার থেকে মুক্ত করে মানুষকে মানবিকতায় উদার করে। আমরা সাধারণ মানুষ জানি না যে, পৃথিবীর কোথায় কী আছে? সাধারণের, তা জানার কথাও না। জানেন শুধু, যিনি আপন মহিমায় অপরূপ সুচারুশিল্পের বুননে সৃষ্টি করেছেন এই জগৎ সংসার। সেই চির অমর, অক্ষয় অবিনশ্বর পরম দয়ালু মহান আল্লাহতায়া’লা। আর মহান আল্লাহতায়া’লা যাঁকে জানাতে ইচ্ছা করেন, তিনিই জানতে পারেন সৃষ্টি ও স্রষ্টার নিগুঢ় রহস্য বা খবরাখবর। আর এই খবর যাঁদের কাছে অনবরত আসতে থাকে, তাঁরাই হলেন কামেল মোকাম্মেল পীর ও মুর্শিদ। আল্লাহ তাঁদের অসীম ক্ষমতা দান করে এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এখানে একটা উদাহরণ দিতে চাই, আমরা মানুষ, আমাদের কম বেশি প্রায় সব মানুষেরই ব্যক্তিগত গোপন কথা থাকে এবং থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে সব এমন বিষয় যা অপরিচিত, কম পরিচিত, সুপরিচিত অথবা রক্ত সম্পর্কের কারো কাছেও কখনো কখনো প্রকাশ করা যায় না। একমাত্র বিশ্বস্ত কোন প্রিয়বন্ধু ছাড়া। কারণ, একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর কথায় ও কাজে আরেক বন্ধু তাঁর নিজের জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিবে। বন্ধুর কাছে গচ্ছিত আরেক বন্ধুর আমানত বা ওয়াদা রক্ষার প্রতি থাকবেন বিশ্বস্ত। তাই বন্ধুর কাছেই প্রকাশ করা যায় গোপন বা প্রকাশ্য এর সবকিছু। সেই প্রকৃত বন্ধু হচ্ছেন আপন পীর বা মুর্শিদ।
মহান আল্লাহতায়া’লার বিধানেও ওই একই নিয়ম। কারণ, আদম (আঃ) রহমত পেয়েছেন হযরত রাসুল (সঃ)-এর কাছ থেকে আর রাসুল (সঃ) রহমতপ্রাপ্ত হয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে। তবে এই নিয়মের ধারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে। তিনি এই মহাবিশ্বের আসমান ও জমিন কুলকায়েনাত পরিচালনা করছেন নিশ্চয়ই গোপনভাবে ফেরেশতা এবং প্রকাশ্যে নবী-রাসুল তথা তাঁর বন্ধু-অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে। এঁরাই হলেন মহান আল্লাহর বন্ধু। আর যিনি আল্লাহতায়া’লার বন্ধু হিসেবে মনোনীত হন, তাঁর কাছেই থাকবে আল্লাহতায়া’লার নিগুঢ় রহস্যের ভেদ। তখন শুধু তিনিই হন এক আল্লাহর বাণীবাহক এবং পবিত্র সেই বাণীর প্রচারক। এ সত্য সবারই জানা। কিন্তু মেনে নিতে গেলেই যেন বাধার দেয়াল সামনে এসে দাঁড়ায়। এই বাধা অতিক্রম করে একবার মেনে নিতে পারলেই জীবন-মরণ নিয়ে আর ভয় থাকে না। তখন অশান্তি নামের বুনোহাতি তাড়া করতে পারে না। কঠিন যন্ত্রণাদায়ক এই কুরিপুর শক্তি মরে যায়। ঘরে-বাহিরে কাজে-কর্মে তার আত্মিক অনুভূতিতে অন্যরকম শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে।
পরম করুণাময় আল্লাহতায়া’লা নবী-রাসুলদের নবুয়তির দুয়ার বন্ধ করেছেন সত্য কিন্তু বেলায়েতের দুয়ার খোলা রেখেছেন। সেই ঘোষণার বরাত দিয়েই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, তাঁর প্রিয় বন্ধু আখেরী নবীর পর্দা গ্রহণের পর থেকে তাঁর অনুসারী বন্ধু আউলিয়াদের আল্লাহ প্রেরণ করে চলছেন। তাঁদের কাছেই রয়েছে, ইস্প্রিচুয়াল পাওয়ার বা আধ্যাত্মিক শক্তি। যে মহাশক্তির কল্যাণে সাধারণ মানুষের দুর্গন্ধময় আত্মা থেকে অশান্তির ময়লাকালি দূর করতে পারেন। তখন জাগতিক শত অভাব-অনটন, চাওয়া-পাওয়ার খাতায় হিসেব কিছুটা কমতি হলেও, পরম দয়ালু আল্লাহতায়া’লা তাঁর দয়াল নামের গুণে তওবাকারী আর বিশ্বাসীদের জন্য ক্ষমার দুয়ার খোলা রেখেছেন। কিন্তু এই তওবা করা আর আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন একা একা কখনোই পরিপূর্ণ হয় না। কারণ, আমি কাকে বিশ্বাস করছি বা কী বিশ্বাস করছি? আর কার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা বা তওবা করছি? তাই এখানেই চলে আসে মাধ্যম অথবা উছিলা অবলম্বনের বিষয়। কারণ, আল্লাহকে সরাসরি কেউ কোনোদিন পায়নি আর পাবেও না। মানুষের কাছে এই বিষয়ে পরিস্কার হওয়ার জন্যই নবীদের পর থেকে শতবর্ষ পর পর পৃথিবীতে একজন মোজাদ্দেদ বা সংস্কারক আল্লাহর আপন মহিমায় আর্বিভূত হন। তাঁরাই তখন মানুষের আত্মায় চির শান্তিময় আলোর আবাস গড়ে দিতে পারেন। কোরআন-হাদিসের অঙ্গিকার অনুযায়ি অলি-আউলিয়াগণই বহন করেন আল্লাহ-রাসুলের পবিত্র কোরআন তথা ইসলামের সত্য-শক্ত ভিত ইলমে মারেফত, আল্লাহর গোপন ভেদ-রহস্যের মহাসমুদ্র। সেই জ্ঞান-সমুদ্রের পূর্ণ অধিকারী হচ্ছেন কামেল পীর-মুর্শিদ। তাঁরা সমাজের আবর্জনা-কুসংস্কার ও অজানা-অচেনার অন্ধকারে মানুষের মনের কুমতি দূর করে সুমতির পথে চলতে শেখান। এই চলতে শেখার প্রধান একটি পথ বা পদ্ধতির নাম সুফিবাদ। আর এই সুফিবাদের আলো মানুষের ক্বলব থেকে ক্বলবে জ্বালিয়ে চিরতরে অন্ধকার দূর করে দেয়ার জন্য, আমার ইহকাল-পরকালের বন্ধু-সখা প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজান হুজুর বিরামহীন তাঁর কর্তব্য পালন করে চলেছেন। তাঁর কাছে রয়েছে মহান আল্লাহতায়া’লার রহমতের দান, সেই আলোকবর্তিকা, যার আলোয় তিনি আলোকিত করে চলছেন মানুষের অন্তর-আত্মা, সমাজ ও রাষ্ট্র।
পৃথিবীতে যত প্রাণি আছে, তার মধ্যে মানুষই ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ট জীব। মানুষকে কেন আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব করেছেন? মানুষকে কেন এত সম্মান দেয়া হলো? যিনি মহান স্রষ্টা তিনিই তো সর্বশক্তিমান পরম দয়ালু। মানুষকে এত সম্মানিত করার কারণ, তিনি শুধু মানুষকেই দিয়েছেন অমূল্য এক বস্তু, যার নাম বিবেক। যা অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হয়নি। বিনিময়ে মানুষের উচিত সব চেয়ে ভালো এবং সেরা কাজের সঙ্গে থেকে মহা স্রষ্টার দেয়া আদেশ-নিষেধ পালন করে অনন্ত গন্তব্যের পথে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু পথ না চিনে যাত্রা করলে পথে বিপদ-আপদের আর শেষ থাকবে না। এ কথা ঠিক যে, সেখানে সাহায্যের জন্য কাউকেই পাওয়া যাবে না, সাহায্য শুধু সে ব্যক্তি পাবেন, যিনি কামেল মুর্শিদের হাতে হাত রেখে তওবা করে বাইয়াতের তবারক নিয়ে যাত্রা করেছেন। মুর্শিদের দেয়া এই তবারকই হলো সেই অন্ধকার বিপদসংকুল পথের চালিকাশক্তি।
সুফিবাদ পবিত্র ইসলাম ধর্মের একটি পরিপূর্ণ শুদ্ধ দর্শন, যা প্রতিটি মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে সরাসরি সর্ম্পকযুক্ত। সে দর্শনে নিষ্ঠার সঙ্গে আত্মনিয়োগ করলেই নিজেকে জানা যায়, চেনা যায়। এই চেনা-জানার পথ তৈরি হয় নিরলস চর্চার ভেতর দিয়ে। এর জন্য প্রয়োজন একজন কামেল মুর্শিদের সান্নিধ্যে থেকে কঠোর সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। সুফিবাদের মৌলিক আদর্শ কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতিকে দূরে ফেলে, সামাজিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সমাজকে একীভূত করে, এ জীবনের শান্তিময় ভিত ও পরজীবনে দুর্গম পথের আলো রচনা করা। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকেই সুফিবাদের গুরুত্ব এবং দুনিয়ার জীবন শেষেও সুফিবাদের আলোয় আলোকিত হবে মানুষ। পৃথিবীর নানান দেশে সুফিবাদের চর্চা এবং এর বিকাশ কামেল পীর বা মুর্শিদের মাধ্যমেই হয়ে আসছে। যিনি পীরেকামেল মুর্শিদে মোকাম্মেল, তিনি তাঁর ভক্ত-অনুসারিদের আধ্যাত্মবাদের চেতনায় উজ্জীবিত করে, তাদের অন্তরাত্মায় সুফিবাদের আলো জ্বেলে দেন। যে কারণে তারা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন অতি কোমল আর নমনীয়। তাদের মনে আল্লাহপ্রেমের মায়ার সঞ্চার হয়। তখন অন্যকে আঘাত করার আগে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেন যন্ত্রণার পরিমাণ।