শরিয়ত ও মারেফতের জ্ঞান ছাড়া কেউ ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া হতে পারবেন না

আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ্ নকশ্‌বন্দি মোজাদ্দেদি

হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী (র:) সাহেবের ‘মকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবে আছে, আখবার মে আয়া কাহ্ আল ওলামায়ু ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া ওলামায়ুল আম্বিয়ায়ে আলাহিছ সালাতুস সালামকে ওরেছ হে। ও এলেম জু আল আম্বিয়ায়ে আলাহীস সালাতু ওয়া তাসলিমাত ছে বাক্বী রাহা হে। ও দো কেছেম কা হায় এক এল্মে আহকাম, দুছরে এলমে আসরার আওর এলমে ওয়ারেস হো। ছখছ্ হে জিন কো উনদুনুছে হেচ্ছা হাসেল হো। ইহাকা ছখছ্ জিছকো একহি কেছিম কা এলমে নসিব হো আওর দোছরা এলমে এসকা নসিব না হো কাহ্ এক বাত ওরেছাত কে মুনাফি হে। কিউ কে ওরেছ কে সব কেসেম তার কা-ছে হেচ্ছা হাসেল হোতা হায়। নাকে বাছ কো ছুরকার বাছে আওর ওহ্ ছখ্ছ জিছকো বাছ মাইয়্যিন মে ছে হেচ্ছা মিলতা হায়। ও গারমা ইয়ানী ক্বরছ্ খাওয়াহো মে দাখেল হায়। কা জিছ্কা হেচ্ছা উস্কে হক ইয়া জিনছে তায়াল্লুক হায়। আওর আইছিহি আ-হযরত আলাইহি ওয়ালা আলীহিস সালাতু ওয়াস সালাম নে ফরমায়া হে, ওলামাই উম্মাতি কা আমি¦য়ায়ে বানি ইসরাইল মেরি উম্মতকে উলামায়ে বানি ইসরাইল কে নবী-উ কি তারাহে ইন ওলামাউ-ছে মুরাদ ওলামায়ে ওরেছ হে। নাহ্ কে ঘরমা কে জিনহু-নে বাছ তার-কাছে হেচ্ছা লিয়া-হে। কিউকে ওরেছ-কু র্ক্বাব জিনছিয়াত কে লে-হাসছে মুওত্ কি মানান্দ কাহ-সেক্তি হে বরখেলাফ গরীমা-কে কা-আলাফাছে চাল্লি হে।’ (মাকতুবাতে ১ম খ- পৃ: ২৬৮-৫৪০)

হযরত রাসুলে করীম (সঃ) বলেছেন, আলেমগণ পয়গম্বরগণের ওয়ারিশ। অর্থাৎ, পয়গম্বরগণ যে ইলেম দুনিয়াতে রেখে গেছেন, তা দুই ভাগে বিভক্ত। (১) ইলমে শরিয়ত বা জাহেরী বিদ্যা, (২) ইলমে এছ্রার বা তত্ত্বজ্ঞান। যিনি এই দুই রকম ইলমের অধিকারী হয়েছেন, তিনিই প্রকৃত ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া বা নায়েবে নবী। যিনি মাত্র একটি ইলমের অধিকারী হয়েছেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে পয়গম্বরের ওয়ারিশ নন। যেহেতু পরিত্যক্ত সম্পত্তির সব বিভাগ থেকে অংশের অধিকারী হওয়াকেই ওয়ারিশ বলে। আর যে পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোন নির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার অধিকারী হবে সে গরিব বা সম্পত্তিবিশেষের আংশিক অংশীদার মাত্র। হযরত রাসুল (সঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে আলেমগণ বনী ইসরাইল বংশীয় পয়গম্বরগণের সদৃশ বা সমান। এই হাদিসের মর্মার্থে দুই প্রকারের ইলেমের অধিকারীগণকেই ‘আলেম’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে যাঁরা কোন এক বিষয়ে মাত্র শিক্ষা লাভ করেছেন, তাঁরা আলেম নন।

হযরত মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেব তাঁর ‘কৌলেচ্ছাবেৎ’ কিতাবে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন এবং ‘জাদুত্তাকোয়া’ নামক কিতাবে লিখেছেন, মাত্র শরিয়ত শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমগণ মারেফত আমল অনুসরণ ছাড়া ফাছেক। তাকে নায়েবে নবী বা ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া বলা চলে না।

মেশকাত শরীফের শরাহ্ মেশকাত শরীফের ১ম খন্ডে বর্ণিত হয়েছে, ইন্নাহু-লা ইয়াতাহাক্কাকু সাইয়ুন মিনএলমে বাতেনী ইল্লা বা’দাল হাকিকী বিএসলাহীর জহিরী কামা ইল্লা এলমে জহেরী রা ইয়াতিমু ইল্লা বি-এসলাহিল বাতেনী ওয়ালি হাজা ক্বলা ইমামু মালেকু মান তাফাক্কাহু ওলাম ইয়াতা ছাওফুন ফাকাদ তাহাক্কাকু ওয়ামান তাছাউফা ওরাম ইয়াতা ফাক্কাহু ফাকাদ তা জিন্দিকুন ওমান জামা-য়া বাইনাহুমা ফাকাদ তাহাক্কাকু ওক্বালা আবু তালেবুল আল-মাক্কী মিম্মা এলমানে লা ইয়াস তাগমী আহাদু হুমা আনিল আখেরী বিমুনজিল্লাতিল ইসলামে ওয়াল ঈমানী মুরাত্তাবাতু কুল্লু মিনহুমা বিল আখেরী কালজিসমী ওয়াল ক্বালবী লা ইয়ান কাউকা আহাদুন আন ছহেবী।’

অর্থাৎ, ইলমে শরিয়ত অবলম্বন না করতে পারলে মারেফত হাসিল হয় না। একইভাবে মারেফত হাসিল না করলে পূর্ণ শরিয়ত আদায় হয় না। এগুলোর একটি অপরটির পরিপূরক। অর্থাৎ, একটি ছাড়া অন্যটি পূর্ণ হয় না। এ কারণেই হযরত ইমাম মালেক (র:) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাত্র ইলমে তাসাউফ আমল করল কিন্তু ফিকাহ্রে (শরিয়ত) আমল করল না, ওই ব্যক্তি জিন্দিক (কাফের ) আর যে কেবল ফিকাহ্রে আমল করল, কিন্তু তাসাউফ আমল করল না, ওই ব্যক্তি ফাছেক। যে ব্যক্তি উভয় আমলই করল, সে ব্যক্তিই হক রাস্তায় আছেন।

ওই কিতাবে আবু তালেব মক্কি বলেছেন যে, উক্ত দুই প্রকার ইলেমই আসল। একটি ছাড়া অপরটি পূর্ণ হয় না। যেভাবে ইসলাম ও ইমান। এই দুইটি ইলেমের মধ্যে এমন সম্পর্ক যেমন, একটি দেহ অপরটি প্রাণ। অর্থাৎ, একটি ছাড়া অপরটি কায়েম থাকতে পারে না। ওইভাবে শরিয়ত ও মারেফতের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। একটি ছাড়া আপরটি পূর্ণ হয় না। এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা আবশ্যক যে, যাঁরা চারটি বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে থাকে এবং যাঁরা মাত্র একটি বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে থাকে, তাঁদের জ্ঞান ও বুদ্ধি সমান হবে কি না? অর্থাৎ, যাঁরা শরিয়ত, তরিকত হকিকত ও মারেফত এই চারটি বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে থাকে এবং যাঁরা মাত্র (জাহেরা) শরিয়তে পারদর্শিতা লাভ করে থাকেন। তাঁদের জ্ঞান ও বুদ্ধি সমান হবে কি না? এ স্থলে জ্ঞানী মাত্রই চারটি বিদ্যায় বিদ্বানদের বেশি জ্ঞানী ও তাঁদের বুদ্ধিকেই নির্ভুল ধরে নিবেন। আর চারটি বিদ্যায় বিদ্বানদের কোন ভুল-ভ্রান্তি একটি বিদ্যায় যারা বিদ্বান, তারা কখনও ধরতে পারেন না। কিন্তু একটি বিদ্যায় বিদ্বানদের ভুল-ত্রুটি চারটি বিদ্যায় বিদ্বানগণ সব সময়ই ধরতে পারেন। সুতরাং, চারটি বিদ্যার বিদ্বানদের জ্ঞান বা বুদ্ধিকেই নির্ভুল মনে করতে হবে। এ কারণেই আল্লাহতায়া’লা একশ বছর পর পর পৃথিবীতে মোজাদ্দেদ পাঠিয়ে থাকেন। এই হাদিসটির ব্যাখ্যা এর আগে করা হয়েছে।

“ইন্নালাহা আজ্জা ওয়া জাল্লা এয়াব আছু লিহাজিহিল উম্মাতি আলা রাছিন কুল্লি মিআতিম মিন ছানাতিন এয়াজদাদু লাহা দী-নাহা।’ (রাওয়াহু আবু দাউদ)

অর্থাৎ, নিশ্চয় মহৎ ও সম্ভ্রান্ত আল্লাহ একশ বছর পর পর উম্মতের জন্য এমন এক ব্যক্তি সৃষ্টি করবেন। যিনি দ্বীনকে (ধর্মকে) সতেজ ও সজীব করবেন। আবু দাউদ রেওয়ায়েত করেছেন, জগতে মোজাদ্দেদ রূপে যিনি আসেন, তিনি উপরোক্ত চারটি বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেন। মেশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ আছে, মোজাদ্দেদ ইসলাম ধর্মে যে সমস্ত ভুল-ভ্রান্তি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন রীতি-নীতি ধর্মনীতি বলে কুখ্যাত হয়, তা দূরীভূত করবেন। সহি হাদিস শরীফে আছে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মিনহা জাহেরু ওয়া বাতেনু।’

অর্থাৎ, কোরআনের দুই প্রকার অর্থ : একটি জাহের অপরটি বাতেন। যাঁরা উল্লেখিত চার ধরণের ইলেম শিক্ষা লাভ করেন, তাঁরা কোরআন-হাদিসের জাহের ও বাতেন বা গভীর তত্ত্ব জানতে ও বুঝতে সক্ষম হন। আর যাঁরা মাত্র (জাহের) শরিয়ত শিক্ষা করেন, তাঁরা কোরআন-হাদিসের জাহেরী অর্থ বুঝতে সক্ষম হন, কিন্তু বাতেনী অর্থ বা গভীর তত্ত্ব বুঝতে পারেন না। কাজেই যাঁরা কোরআন-হাদিসের গভীর তত্ত্ব বুঝতে অক্ষম, তাঁরা কোন প্রকারেই পয়গম্বরগণের ওয়ারিশ হতে পারেন না। চিন্তা করে দেখুন, আল্লাহতায়া’লা বলেছেন, ইউছাব্বিহু লিল্লাহি মা ফিছ-সামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদি।’

অর্থাৎ সাত তবক আসমান ও জমিনের ভিতর যা কিছু আছে, সবাই আল্লাহর জিকির করছে। দেখা যাচ্ছে আগুন, পানি, মাটি, বাতাস, বৃক্ষলতা, ঘোড়া, গরু, পশুপাখি যা কিছু সাত তবক আসমান জমিনের ভিতর রয়েছে, সবাই-ই আল্লাহর জিকির করে আসছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, যাঁরা মাত্র জাহেরা বিদ্যা শিক্ষা করে থাকেন, কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করেন না, তারা ওই সব আগুন, পানি, মাটি, বাতাস, গাছপালা, পশুপাখি ইত্যাদির জিকির শুনতে পারে কি না? দেখা যাচ্ছে, কেউ যদি জাহেরী বিদ্যার সাগরও হয়, তবুও ওই সব জিকির শুনতে সক্ষম হয় না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি জাহেরী লেখা পড়া কিছু নাও জানেন, সে যদি কোন অলিয়ে কামেলের কাছে থেকে ইলমে তাসাউফ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন, তবে ওই ব্যক্তি আগুন, পানি, পশুপাখি ইত্যাদির জিকির শুনতে পায়। ওই সব জিকির শ্রবণ করা বেশি কঠিন বিষয় নয়। অতি সহজ বিষয়। যাঁরা ওই সহজ বিষয়টি শুনতে বা বুঝতে সক্ষম হন না, তাঁরা কোরআন-হাদিসের বাতেন ও গভীর তত্ত্ব কী করে বুঝবে? তা কখনও হতে পারে না। কাজেই তাঁরা কখনও পয়গম্বরগণের ওয়ারিশ হতে পারেন না।

ইলমে তাসাউফ ছাড়া শরিয়ত পূর্ণ হবে না। হযরত মাওলানা কেরামত আলী (র:) সাহেব তাঁর “জাদোত্তাকত্তয়া” নামক কিতাবের হাদিসে জিবরাইল (আ:)-এর মর্মার্থে লিখেছেন,

কাহে দীন বুলতি হ্যায় ইসলাম , ঈমান ও ইহসান সাবকো মিলাকে আওর শরীয়াতে নাম হে। ইছ মাজমু ওয়া কা আওর ভী দরমাইয়া হে, কাহে ফিকাহ আওর তাসাউফ আওর কালাম আপস মে এককু এককু লাজেম হে, একছে দুছরা আলাগ নেহী উনমে ছে এক বে দুছরে কে পুরা নেহী হুতা হে।’

অর্থাৎ- ইসলাম, ইমান ও এহ্ছান এই তিনটি মিলে শরিয়ত। তিনি আরও বলেছেন, ফিকাহ্, তাসাউফ ও আকায়েদ প্রভৃতি সমাধাণের জন্য এবং তা যথার্থভাবে প্রতিপালন করতে একটি অপরটির দিকে বিশেষভাবে মুখাপেক্ষি। আবার মূলে একটি থেকে অপরটি ভিন্ন এবং একটি ছাড়া অপরটি পূর্ণ হতে পারে না। উক্ত কিতাবে আরও আছে, আহকাম ইনহী বে-ফেকা পৌঁছানী নেহী জাতে আওর ফিকাহ্ বে তাসাউফ কে পুরী নেহী হুতী।’
অর্থাৎ, খোদাতায়া’লার আদেশগুলি ফিকাহ্ ছাড়া জানা যায় না এবং মারেফত ছাড়া ফিকাহ্ পূর্ণ হয় না। পীরের খেদমত ছাড়া ইলমে তাসাউফ হাসিল হয় না। মাওলানা কেরামত আলী (র:) সাহেব উক্ত ‘জাদোত্তাকওয়া’ কিতাবে আরও লিখেছেন,

‘আওর এভী মা’লুম হো চুকা কাহ্ ফিকাহ্ কে মোওয়াফেক আমল ভী বে তাছাউফ কে দুরস্ত নেহি হোতা, তু-আব ছাবেত হুয়া কেহ মুমিন কো তাছাউফ ফর আমল করনে কী বরে হাজত হে, আওর তাছাউফ ফর আমল করনা বেগায়ের ছোহবত আওর তালিমে মুর্শিদ কামেল কে জু তাছাউফ ছে ওয়াক্কেব আওর ইস ফর আমল হে মোনজিল নেহী।’

অর্থাৎ, তাসাউফ ছাড়া ফিকাহের আমল পরিপূর্ণভাবে করা যায় না। সুতরাং এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়, তাসাউফ আমল করা প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জন্য অবশ্যই কর্তব্য। যাঁর তাসাউফের পূর্ণ জ্ঞান আছে এবং যে তা আমল করে তবুও একজন উপযুক্ত পীরের সোহবত (সংস্রব) ও তালিম (শিক্ষা) ছাড়া তেমনভাবে সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয় না।

খাজাবাবা কুতুববাগীর প্রকাশিত লেখা সমুহ

(Visited 9,047 times, 1 visits today)
Share

2 Comments

  1. Saiful Islam

    হযরত রাসুলে করীম (সঃ) বলেছেন, আলেমগণ পয়গম্বরগণের ওয়ারিশ। অর্থাৎ, পয়গম্বরগণ যে ইলেম দুনিয়াতে রেখে গেছেন, তা দুই ভাগে বিভক্ত। (১) ইলমে শরিয়ত বা জাহেরী বিদ্যা, (২) ইলমে এছ্রার বা তত্ত্বজ্ঞান। যিনি এই দুই রকম ইলমের অধিকারী হয়েছেন, তিনিই প্রকৃত ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া বা নায়েবে নবী।

    কোরআন শরীফ ও হাদিস শরীফের রেফারেন্স চাই?

    Reply
  2. md toiab ali

    দ্বীনি শিক্ষা উপস্হাপনের জন্য ধন্যবাদ

    Reply

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *