কারী মাওলানা শফিকুল ইসলাম আল মোজাদ্দেদি
প্রথম সংখ্যায় আমি কে? এই কথার ধারাবাহিকতায় আমি কে হাসিল করার লক্ষ্যে প্রেম করতে হবে, প্রেমের মাধ্যমে, ‘আমিতে’ পৌঁছতে হবে। তরিকতের ভাষায় বলা হয় ‘ক্ষুদি’ হাসিল। যা বান্দা+আল্লাহতে=একাকার হয়ে ফানাফিল্লাহ বা বাকাবিল্লাহতে পৌঁছা যায়। হাদিস শরীফে রাসুল পাক (স.) বলেন, মান আরাফা নাফছাহু ফা ক্বাদ আরাফা রাব্বাহু। অর্থ- যে নিজেকে অর্থাৎ আমিকে চিনেছে সে তার আল্লাহকে চিনেছে।
হাদিসে কুদ্সি: কুন্তু কানজান মাকফিয়ান আন আহ্ বাবতু ফাক্বাদ খালাকতু খালকান। অর্থাৎ , আমি ছিলাম একটি গুপ্ত ধনাগার-ভা-ার। ইচ্ছা করিলাম প্রকাশ হইব, তাই নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সৃষ্টি করিলাম।
ব্যাখ্যা : আল্লাহপাক ছিলেন অতি গুপ্ত ধনাগার-ভা-ার। তিনি ইলমে মহিদের দ্বারা নিজেই নিজের ভিতর ডুব দিলেন এবং ডুব দিয়ে দেখলেন এই সুন্দর পৃথিবী আর মাখলুকাত, তাই তিনি নিজের ইচ্ছা মতো সুনিপুণভাবে সব কিছু সৃষ্টি করলেন।
আল্লাহপাক বলেন, আমি স্রষ্টা; সৃষ্টি করতে পারি আবার ভাঙ্গতেও পারি। আমি যদি সৃষ্টি না করি তা হলে আমি আল্লাহর কোনো স্বাদ বা মজা থাকে না। তাই নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সৃষ্টি করলেন সৃষ্টির মূল প্রেম। এই প্রেমের কারণেই মহান আল্লাহপাক সৃষ্টি করলেন কুলকায়েনাত ১৮ হাজার মাখলুকাত ও ৮০ হাজার আলম; কিন্তু তবুও তাঁর সৃষ্টির সাধ মিটেনি, তাই সব শেষে সৃষ্টি করলেন মানুষকে শুধু প্রেমের কারণে।
প্রেম হলো সেতুস্বরূপ, প্রেম হলো আকর্ষণ শক্তি, দুটি বস্তুর মিলনের মাধ্যম হলো প্রেম। প্রেম হলো আকর্ষণ। দেখা দেখিতে প্রেম হয়, প্রেমে মিলন ঘটায়, মিলনে জন্ম হয়, জন্মে বিস্তার ঘটায়। তাই আল্লাহকে পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো প্রেম। আমার মুর্শিদ কেবলা বলেন, আল্লাহর আরশে আজিম দুটি খুঁটির ওপর অবস্থিত। প্রথম খুঁটি হলো ইবাদত এবং দ্বিতীয় খুঁটি হলো প্রেম। সুতরাং এ কথার দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহ প্রাপ্তির পথ হলো ইবাদত এবং প্রেম। অর্থাৎ প্রেমের মাধ্যমেই ইবাদত, এটিই ধর্ম।
বিশ্ববিখ্যাত আলেম মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ঐশী প্রেম হলো সব রোগের মহৌষধ। প্রেম মনকে কর্দমতা ও পাপাশক্তি থেকে মুক্ত করে। প্রেম আত্মাকে পবিত্র করে এবং উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়। মুর্শিদ ক্বেবলা খাজাবাবা কুতুববাগী (মাঃজিঃআঃ) বলেন, এশ্কে মেজাজী থেকে মানুষ এশ্কে হাকিকীতে পৌঁছে যায় এবং এ ক্ষেত্রে এশ্ক বা প্রেম হলো মাধ্যম। অর্থাৎ প্রথমে সাধারণ মানুষকে অসাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রেম করতে হয়। তা হলেই সেই অসাধারণ মানুষের মাধ্যমেই আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। সেই মানুষ হলো একজন সম্যক গুরু বা পীর-মুর্শিদ। একজন কামেল মুর্শিদের সঙ্গে প্রেম করলে তিনিই আপনাকে পৌঁছে দিতে পারেন আল্লাহর নৈকট্যে।
তরিকতের ভাষায়Ñ ১. ফানাফিল অজুদ, ২. ফানাফিশ শায়েখ, ৩. ফানাফির রাসুল, ৪. ফানাফিল্লাহ্।
১. ফানাফিল অজুদ হলো নিজেকে নিজের মধ্যে বিলীন করে দেওয়া অর্থাৎ নিজেকে এমন মনে করতে হবে যে, আমি কিছুই না। আমি বলতে কিছুই নেই, নিজের হাস্তিকে বা আমিত্বকে চিরতরে দূর করে দেওয়া। এসব বিষয়ের অহংকার দূর করে দিতে পারলেই একজন সাধারণ মানুষ ফানাফিল অজুতের মাকাম বা স্তর লাভ করতে পারেন; কিন্তু এই স্তর কোনোদিনও একা একা লাভ করা যায় না। এই স্তর লাভ করতে হলে একজন কামেল মুর্শিদের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২. ফানাফিশ্ শায়েখ হলো নিজের মুর্শিদের সঙ্গে ফানা বা বিলীন হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ মুর্শিদের সঙ্গে ফানা হতে পারলেই আমিত্বকে দূর করা সম্ভব। তখন আর নিজের বলতে আর কিছুই থাকে না, যা কিছু আছে তা কেবল অন্যের আমি বা আমার বলে কোনো বস্তু নির্দিষ্ট থাকে না। শুধু তুমি আর তুমির মধ্যেই একাত্মতা পোষণ করা।
৩. ফানাফির রাসুল হলো নিজেকে রাসুল প্রেমের দরিয়ায় ডুবিয়ে দেওয়া, যেখানে ডুবলে আর অন্য কিছুর প্রয়োজন থাকে না; কিন্তু এই দরিয়ায় ডুবতে হলে একজন কামেল মোকাম্মেল মুর্শিদের একান্ত সান্নিধ্যের প্রয়োজন হয়। যিনি এই দরিয়ার গভীরতার খোঁজ রাখেন, যেখানে রয়েছে অমূল্য ধন-রতেœর অফুরন্ত ভা-ার, যে ভা-ারের হদিস কোনো মানুষ পেলে নিশ্চয়ই সে পার্থিব সুখ-শান্তির কথা ভুলে রাসুল প্রেমের দরিয়ায় ডুবে থাকবেন।
৪. ফানাফিল্লাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া। কেউ যদি আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারেন তবে তার জন্য রয়েছে দোজাহানের অপার সুখ আর চির শান্তির ঠিকানা; কিন্তু এই যে আল্লাহর সঙ্গে ফানা বা নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার একমাত্র পথ বা মাধ্যম হলো তার মুর্শিদের উছিলা। মুর্শিদের কৃপা ছাড়া এই স্তরে কেউ কোনোদিনও যেতে বা সিদ্ধি লাভ করতে পারবেন না। কারণ রাসুল প্রেমে ফানা হতে হলে মুর্শিদের একনিষ্ঠ অনুসারী হতে হবে। তাঁর আদেশ-নির্দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করতে হবে। তবেই রাসুলের প্রেম তার হৃদয়ে সদা জাগ্রত থাকবে। আর যার হৃদয় বা ক্বলবে রাসুলের প্রেম জাগ্রত হবে না, সে কখনও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে না।
প্রেমের জগৎ সব বিচার ও যুক্তির ঊর্ধ্বে
ঐশী প্রেমের দ্বারা যার হৃদয় পুত-পবিত্র, তার মন সর্ব প্রকার অবিলতা থেকে মুক্ত। ঐশী প্রেমের বলে মাটির দেহ আকাশে উন্নীত হয়। প্রেমের পরশে জড়ো পাহাড় পর্যন্ত সচল হয়ে ওঠে। একদিন এই প্রেমের দ্বারাই তুর পাহাড় জীবন সঞ্চার করেছিল। প্রেম উন্মাদনা ও উন্মত্ততা এনেছিল। হযরত জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) বলেন, আমার সত্তা তারই সত্তার মধ্যে লুকিয়ে আছেÑ এ গোপন রহস্য-ভেদ প্রকাশ করলে, সমগ্র জগত ওলটপালট হয়ে যাবে। কারণ এই ঐশী প্রেম অব্যক্ত ও জীবনের গোপন রহস্য।
পার্থিব জগতের যাবতীয় সৌন্দর্য পরম সৌন্দর্যেরই আংশিক প্রকাশ মাত্র। পরম সুন্দর সব সৌন্দর্যের মূল উৎস। সূর্যালোকের অভাবে যেমন পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যায়, তেমনি ঐশী সৌন্দর্যের অভাবে বিশ্বের সব বস্তু মলিন হয়ে পড়ে।
প্রেমই সৃষ্টির মূল তত্ত্ব। পৃথিবী সৃষ্টির কারণ পরম সৌন্দর্যের প্রকাশ, অতএব যেই প্রেম দ্বারা মহান আল্লাহ সমগ্র পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সেই প্রেম তো আল্লাহর সত্তারই নির্যাস। প্রেম দ্বারা মানবাত্মা পরিবর্তিত হয়ে পরম আত্মার স্বভাবে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে অথবা পরমাত্মার রঙে রঙ্গিন হয়ে ওঠে।
এই প্রেম দ্বারাই জড় জগত থেকে আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান লাভকারী জগতবিখ্যাত আলেম মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির (রহ.) মতে যাবতীয় কর্মের নিয়ত্তা একমাত্র সয়ং আল্লাহ। তিনি মানুষকে কতগুলো কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই সীমার ভিতর থেকেই মানুষ তার পছন্দমতো কর্ম সম্পাদন করতে পারে, যদিও কর্ম-শক্তি ও কর্মক্ষেত্র আল্লাহরই দান। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে কারণ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আল্লাহ মানুষকে তার স্বাধীন মতানুযায়ী পছন্দ করার শক্তিদান করেছেন।
চুম্বকের আকর্ষণ যেমন বিচ্ছিন্ন লৌহ খ-কে একত্রিত করে, তেমনি প্রেমের আকর্ষণ হলো একরকম বিনা তারে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানোর মতো শক্তি। প্রেমে একজন রোগীকেও সুস্থ করে তুলতে পারে এবং প্রেমের কারণে কঠিন ক্রোধ দমন হয়ে কোমলতায় রূপ নিতে পারে। তখন শত্রুও পরিণত হয় পরম মিত্রতে। প্রেমের কারণেই মানুষের মৃত আত্মাও জীবিত হয়ে ওঠে। বাদশাহকে পরিণত করে গোলামে। প্রেম কারাগারকেও পরিণত করতে পারে কুসুম-কাননে। আবার মাটির দেহ আসমানেও আরোহণ করে এবং যা কখনও মাটিতে খেতে পারে না।
একজন আল্লাহ প্রেমিক সুফি-সাধকের প্রার্থনা আরশে আজিম পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। আল্লাহর প্রেম মানুষের অন্তরকে পার্থিব জগতের প্রতি উদাস বা বিমুখ করে পরকালের প্রতি নিমগ্ন করে তোলে। প্রেমের স্বাদ আশ্চর্যরকম এক অদৃশ্য বস্তু। মুর্শিদ প্রেমের মাধ্যমে একটি মুহূর্তে যতখানি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা সম্ভব, প্রেমহীন শতশত বছরের কঠোর সাধনা, রিয়াযত, মোশাহেদায় তা সম্ভব হয় না। এই প্রেমের রাস্তায় চলতে গিয়ে যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে তার জন্য আমাদের দেওয়া কোনো অজু-গোসলের প্রয়োজন হয় না। কারণ তার মৃত্যু শহীদের মর্যাদা লাভ করে। প্রেমের জগৎ সব বিচার ও যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে।