এইচ মোবারক
পৃথিবীতে চাওয়ার কোন শেষ নেই, ধন-সম্পদ যত আছে তবু আরও বেশি চাই। আবার রোগ-শোক, বালা-মসিবত থেকে রক্ষা চাই। দোজখ চাই না বেহেশ্ত চাই। মৃত্যু চাই না, বাঁচতে চাই। শুধু চাই আর চাই। এই শত চাওয়ার মধ্যে আমরা ক’জন বলছি, আমি আত্মার শুদ্ধতা চাই? ভোরের নরম সূর্যের মতো অন্তরে স্বচ্ছ কোমল আলো চাই।
নিজেকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে সর্বপ্রথম যা করণীয়, মনের আঙিনায় একটি শুদ্ধ মানসিকতার বীজ বপন করা। শুদ্ধ মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে মানুষকে ক্ষণে ক্ষণে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। প্রতি মুহূর্তে ফিরে ফিরে আসতে হয় বিবেকের ও ন্যায়বোধের কাছে। নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করাতে হয় কামেল গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের চরণে। মানব জীবনের অন্যতম একটি গুণ হল শুদ্ধ মানসিকতা, এর চেয়ে বড় অলংকার আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের মানসিকতা আজ এমন এক জায়গায় গেছে, ইচ্ছা করলেই সেখান থেকে ফিরে নিজের নফস্কে সহজে আয়ত্ত করা অনেক কঠিন। যেমন ধরুণ গৃহপালিত একটা পশুকে ছেড়ে দিয়ে যদি বলা হয়, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে কোথাও যাবে না। সে কি আপনার কথা শুনবে? শুনবে না। তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে হলে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। ঠিক তেমনই নফস্কে আয়ত্ত করতে হলে একজন কামেল মুর্শিদ প্রয়োজন। রশি ছাড়া যেমন কিছু বাঁধা যায় না, তেমনই মুর্শিদ ছাড়া আত্মার পবিত্রতা অর্জন হয় না। এ কাজ একা একা তো কখনই সম্ভব না। সূফীবাদ চর্চার মধ্য দিয়ে, আত্মার রোগের মতো জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আত্মার রোগ নিয়ে মৃত্যু হলে পরপারে গিয়ে কোন ফল হবে না, বিফলে যাবে এই মানব জীবন। তাই জোর দিয়ে বলা যেতে পারে, অবশ্যই আপনি আপনাকে শুদ্ধতার সারিতে দাঁড় করাতে সক্ষম হবেন, যদি আপনি একজন কামেল গুরুর চরণে নিজকে সপে দিতে পারেন। আমাদের মুর্শিদ কেবলা খাজাবাবা কুতুববাগী তেমনই, আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর মনোনীত সত্য তরিকার ধারক ও বাহক, কামেল গুরু (Spiritual Teacher) বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। হাল জমানায় আত্মা বা মনের শুদ্ধতা বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু এর পেছনে হাজারটা কারণও আছে। মুরব্বিরা ছোটদের জন্য নসিহত করেন, ‘মানুষ হও বাছা, বড় হও’। শিশুরা তো নিষ্পাপ, তাদের প্রতি কেন এ ধরনের উপদেশ? হ্যাঁ, এ ‘মূলমন্ত্র’ ছোটবেলা থেকেই চর্চা করতে হয়, তাতে জাগতিক শিক্ষার সাথে সাথে নিজেকে একজন শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে নিতে তার সহজ হয়। শুদ্ধ মানসিকতার বীজ শিশুর অন্তরে রোপন করা না গেলে, সে দায়ভার বাবা-মা কিংবা মুরব্বিদের উপরেই বর্তায়। শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির চর্চা থাকলে, তার দ্বারা সমাজে কোন মন্দ কাজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। শরিয়তি (একাডেমিক) শিক্ষার সাথে সাথে, তার ভিতরে মারেফতের অমূল্য জ্ঞান সঞ্চার হতে থাকবে। তখন সে কোন মন্দ কাজে লিপ্ত হবার আগে, ভাবতে থাকে তার কামেল গুরুর আদেশ-নিষেধের কথা মনে পড়বে, সে আর ওই কাজ থেকে বিরত থাকেন। এ ধরনের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দ্বারা মানবতার সেবা হবে ও দেশের কল্যাণে অগ্রণি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। কামেল গুরুর কাছে বাইয়াত হলে, তিনি আপনার ময়লাযুক্ত আত্মার ভেতর থেকে হীনমন্যতার শেকড়গুলো উপড়ে ফেলে, ফুল চাষের উপকরণ শিখিয়ে দিবেন। তখন আস্তে আস্তে আপনি আপনার মুর্শিদের সাহায্যে, অন্তরকে সুবাসিত করে তুলবেন এবং এর ফলে খুব সহজেই আত্মাকে শুদ্ধতার কাতারে নিয়ে যেতে পারবেন। এ কথার সত্যতার প্রমাণ পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অসংখ্যবার আছে।
ভূমিষ্ঠের পর থেকে বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা নিষ্পাপ থাকি। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিচিত-অপরিচিতজনদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা এবং সামাজিকতার হাজার নিয়মে যখন বাঁধা পড়তে থাকে, তখন নানা রকম কু-প্রবৃত্তির মোহ তৈরি হয়। সেই বিকশিত হবার কালেই ভালো পথে চলার মতো জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হয়। এই নির্দিষ্ট লক্ষ্য সহজে জয় করা সম্ভব না, হাজারও প্রাপ্তি দিয়ে জীবন সাজানো যায়। কিন্তু দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতার কাছে নিজের শুদ্ধ মানসিকতা বিসর্জন করতে বাধ্য হতে হয়। লোভ-লালসা-মোহ ইত্যাদির কারণে, আত্মার যে স্বাভাবিক শুদ্ধতা প্রয়োজন তা বেমালুম ভুলে থাকি। এখানে একটা কথা বলে রাখি, শুধু নামাজ, রোজা করলেই কি আত্মা শুদ্ধ হয়? হয় না। আত্মশুদ্ধির জন্য অবশ্যই একজন কামেল শিক্ষক বা শুদ্ধ-মানুষের ছহবতে থাকতে হবে। ভ্রান্ত মানসিকতার পথ ছেড়ে মুর্শিদের পথে, নিজ নিজ অস্তিত্বের সন্ধান করলে শুদ্ধ মানুষ হওয়া যায়। তখন তার অন্তরে আল্লাহতায়ালার বসতি গড়ে ওঠে, যে বসতি চিরস্থায়ী।