সূফীবাদ কী ?

তাসাউফরে সাধারণ অর্থ- সৃষ্টিকে ভুলে স্রষ্টার প্রমে নিমগ্ন থাকা। আবার কেহ কেহ বলইয়াছেন, তাসাউফ (সূফীবাদ) ‘সাফা’ শব্দ হইত উৎপন্ন হইয়াছে। উহার অর্থ পবত্রিতা। কারণ এই মতবাদ বিশ্বাস কারীগণ ধারণা করেন, মানুষের অন্তর কে পবিত্র করিতে হয়, তাহা তাসাউফরে মাধ্যম্যা সম্ভব। আবার অনেকে বলিয়াছেন, তাসাউফ শব্দটি ‘সওফ’ শব্দ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। কারণ সূফীগণ অতি সাধারণ ভাব বিনা আড়ম্বরে জীবন যাপন করিয়া থাকেন। ‘সওফ’ শব্দের ধাতুগত অর্থ হইল ‘পশম’। সূফীগণ অতি সাধারণ এক রকম পশম নর্মিতি বস্ত্র পরধিয়ে হিসাবে ব্যাবহার করিতেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন ঐ মতবাদের সমর্থক ছিলেন। কেহ কেহ বলেন- তাসাউফ শব্দটি ‘সুফফা’ শব্দ হইতে আসিয়াছে রাসূল পাক (দঃ) এর মসজিদে নববীর সম্মুখস্থ বারান্দায়, আহলে সুফফাগণ দুনিয়া ত্যাগী অবস্থায় সর্বদা তসবীহ তাহলীল ও মোরাকাবা মুশাহেদায় মশগুল থাকিতেন। তাহাদের দ্বারাই (রাসূল পাঁকের পরবর্তী সময়) সূফী দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং আস্তে আস্তে সূফীমত প্রকাশ হইতে থাকে। যদি ধরা হয় যে ‘সুফফা’ শব্দ হইতে ‘সূফী’ শব্দ উৎপত্তি হইয়াছে তবুও অর্থের কোন রকম ব্যতক্রিম হয় না, কারণ তাহাতে ‘সুফফা’ শব্দরে অর্থ হয় বারান্দা। আর আহ্‌লে সূফফাগণ হইল বারান্দার অধিবাসী।

মোরাকাবা অর্থ ধ্যান, গভীর চিন্তা। সূফী বা সাধু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত বিশেষ এক তন্ময়তা বা সমাহিত অবস্থা। সব ধর্মের নিগুঢ় ব্যবস্থাপত্র হচ্ছে মোরাকাবা। হযরত মোহাম্মদ (দঃ) ১৫ বছর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান বা মোরাকাবা করিয়াছেন। মক্কার অদূরে পর্বতটি অবস্থিত। ভূমি হতে হেরা গুহায় উঠতে ও ফিরে আসতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। অনকে কষ্টে পায় হেটে হেরা গুহায় উঠতে হয়। তবুও নবীজি নিয়মিত ঐ গুহায় গিয়ে যে আমলটি করিয়াছেন তা হলো মোরাকাবা। কারণ তখনও আল্লাহর পক্ষ হইতে নামাজ আসে নাই। এসেছে দ্বিতীয় হিজরিতে অর্থাৎ নবুয়াত প্রাপ্তির ১২তম বছরে। আল্লাহর সামনে দাঁড়াইবার শর্ত হলো, আত্নিক পরিশুদ্ধতা অর্জন। তাইতো নবীজি (দঃ) ১৫ বছর হেরা পর্বতে ধ্যান সাধনা করে হৃদয়ের কপাট খুলেছিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহী লাভ করেছিলেন। তনিই সাহাবাদেরকে ১২ বছর মোরাকাবার শিক্ষা বা প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন। প্রথমে তাদেরকে এ শিক্ষা দিয়ে অন্তরে আলোকিত করার কৌশল শিখাইয়াছিলেন। সে আলোকিত অন্তরে সাহাবাগণ আল্লাহ পাকের সত্তাকে অবলোকণ করিয়াছেন। হযরত আলী (রাঃ) বলিয়াছেন, “লাম আ’-বুদ রাব্বা লাম আ-রা-হু” আমি এমন মাওলার ইবাদত করিনা, যাকে আমি দেখিনা। হযরত ওমর (রাঃ) বলিয়াছেন, “রা’য়া ক্বালবী রাব্বী বিনূরী-রাব্বী” আল্লাহর নূরের দ্বারা আমার অন্তকরণ আল্লাহর দর্শন লাভ করিয়াছে (ছেররুল আসরার)।

নবীজি মদিনায় হিজরতের পরে মসজিদে নববীর বারান্দায় সাহাবাদের জন্য ধ্যান বা মোরাকাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। সাহাবাদের এই সম্প্রদায়কে ‘আসহাবে সুফফা’ বা ‘সূফী’ নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে নবীজির রওজার উত্তর পার্শ্বে কিছু জায়গা পাকা ও উচু মাচা করে রাখা হয়েছে। এখন সেখানে লাইব্রেরী করা হয়েছে। এখানে বসে হজ্ব ও ওমরায় আসা নবীর আশেকরা কোরআন পাঠ, নফল নামাজ, ধ্যান বা মোরাকাবা, দরুদ ও মিলাদ শরীফ পড়ে থাকেন। কাশফ্‌ধারী সাধকগন আসহাবে সূফফার জন্য নির্ধারিত মেঝেতে বসে মোরাকাবায় নবীজির দিদার লাভ করে ধন্য হয়ে থাকেন। মোরাকাবার শিক্ষার বিষয়টি শরয়িতের আমলের মধ্যে দেখা যায় না। এই শিক্ষা কেবল খাঁটি পীর বা আউলিয়া কেরামদের দরবারে প্রচলিত আছে। নবীজি সাহাবাদেরকে ৪টি বিদ্যা শিক্ষা দিতেন – শরিয়ত, তরকিত, হাককিত ও মারেফত। মারেফত বা তাসাউফ চর্চার মধ্যে মোরাকাবার গুরুত্ব অপরিসীম। তরিকত মোরাকাবা ছাড়া সাধনার স্তর অতিক্রম করার কোন বিধান নাই। মোরাকাবার মাধ্যমে মোর্শেদের দিলে, দিল মিশিয়ে আপন হৃদয়ে ফায়েজ ধারণ করতে হয়। মোরাকাবা করলে হৃদয়ের কালিমা বিদুরিত হয়, হৃদয় আলোকিত হয়। মোরাকাবার নিয়ম হল প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে ও রাত্রির তৃতীয় অংশে(রহমতরে সময়) জেগে বা অন্য যে কোন সময় আপন মোর্শদেরে কদম ধরে সাধনা করা।

নিজের জীবনরে ভুল, বেয়াদবী ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রথমে মোর্শেদ ও পরে নবীজির উসিলা ধরে মহান আল্লাহর নিকট হাজির হয়ে কাকুতি মিনতি করে প্রাথনা করতে হয়। অতঃপর আল্লাহর জাত পাক হতে রাসূল (দঃ) এর সিনা মোবারক হয়ে এবং আপন মোর্শদেরে দিল মোবারক হয়ে বিভিন্ন ওয়াক্তে ফায়েজ নিজ দিলে এসে পড়ে এতে দিলের সমস্ত খারাপ স্বভাব দূর হয়ে যায় ও দিল পবিত্র হয়। এভাবে অধকিকাল মোরাকাবা করলে দিলের চোখ খুলে যায়। আর ঐ চোখেই কেবল মো’মেন বান্দার নামাযের মেরাজ হয়ে থাকে। মোরাকাবা বা আল্লাহর ধ্যান-এ নিমগ্ন হওয়ার জন্য আল্লাহর বন্ধুর বায়াত গ্রহন করে দিক নির্দেশনা ও ফায়েজ হাসিল করা অবশ্যই কর্তব্য। মোরাকাবা হল নফল ইবাদত। নফল ইবাদত হল আল্লাহর নকৈট্য লাভের উত্তম পন্থা। তাই মোরাকাবা সাধকের জীবনে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হযরত রাসূল (দঃ) বলেছেন ১ ঘন্টা সময় মোরাকাবা করা হাজার বছরের ইবাদত করার চেয়ে উত্তম। নবীজি অনত্র বলেছেন, কিছু সময় মোরাকাবা করা ৬০ বছর ইবাদতের চেয়ে উত্তম। সাহাবায় কেরামগণ প্রথমে মোরাকাবা করেছেন। পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে পর্যায় ক্রমে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত নির্দেশিত হয়েছে। তবে আজ আমাদেরকে সব গুলো একই সঙ্গে আমল করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম নেয়ামত হচ্ছে নামাজ। নামাজ পড়লে দিল নরম হয়। আল্লাহর সমিপে ও নবীর কদমে দোয়া ও মোনাজাত করলে মোমেন বান্দার চোখ ভরে পানি পড়ে। মোরাকাবা অন্তরের কালিমাকে পরিস্কার করে দেয়।

শরিয়ত হলো ইসলামের সমূহ আচার আচরণ বা কর্মসূচী। আর মারফেত হলো সইে আচার আচরণ বাস্তবায়নের ফল, অর্থাৎ আত্বিক উপলব্ধি। যারা শরয়িত ও মারেফত উভয় পালন করে তারাই হলেন রাসূল (দঃ) এর উত্তরাধিকারি এবং সিরাতুল মোস্তাকমি পথ যাত্রী। আত্মশুদ্ধরি জন্য খাঁটি পীর মোর্শদেরে সহবত নেওয়া ফরজ। পবিত্র কোরআন-এ এরশাদ হয়েছে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আল্লাহর রাসূলকে মান্যকর এবং সাদেকীনদের(অলী-আল্লাহর) সঙ্গ লাভ কর। মারেফত ছাড়া বাতেনী রাস্তার অনুসন্ধানী হওয়া যায় না। সুতরাং মোরাকাবার মাধ্যমেই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে নিগুঢ় ভেদ ও রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব।

উপসংহার
সূফীবাদ-ই একমাত্র নিষ্ঠার শক্ষিা দেয়, বিনয়ের শিক্ষা দেয়, আদবের শিক্ষা দেয়, সূফীবাদ-এ আসলে মানুষ হিংসা বিদ্বেষ ভুলে যায়। তারা ভাবুক ও প্রেমা হয়। তারা আল্লাহ্ মুখী হয়, অন্যের দোষ তালাশ করার আগে নিজের দোষ তালাশ করে, মা ও বাবার খেদমত করে। ওস্তাদ ও গুরুজনকে ভক্তি ও তাজমি করে বে-নামাজী নামাজ পড়ে, বে-রোজাদার রোজা রাখে, বে-জিকিরিুল্লাহ, জিকির করে, তারা মানব সেবা করে, ভূখা মানুষকে খানা খাওয়ায়, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করে, তাই সকল মানুষকে এই সূফীবাদের সুশীতল ছায়াতলে আসার জন্য আহবান জানাচ্ছি।

(Visited 1,514 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *