শালিনতার ভিতরেই আধুনিকতা

আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ্ নকশ্‌বন্দি মোজাদ্দেদি

পবিত্র কোরআনের সূরা নূর, আয়াত ৩০-৩১ আল্লাহতা’লা বলেন, “ক্বু ল্ লিল্‌মু ‘মিনীনা ইয়াগুদ্ব্‌দ্বূ মিন্ আব্‌ছোয়া-রিহিম্ অইয়াহ্ফাজূ ফুরূজ্বাহুম্ যা-লিকা আয্কা-লাহুম্ ইন্নাল্লা-হা খবীরুম্ বিমা-ইয়াছ্না্‌ ঊা’ন্। অক্বু ল্  লিল্‌মু  মিনা-তি ইয়াগ্‌দ্বু দ্বনা মিন্ আবছোয়া-রিহিন্না অইয়াহ্‌ফাজ্‌না ফুরূজ্বাহুন্না অলা-ইয়ুব্দীনা যীনাতাহুন্না ইল্লা-মা-জোয়াহার মিন্হা-অল্ইয়াদ্ব্রিব্না বিখুমুরিহিন্না ‘আলা-জ্বু ইয়ূবিহিন্না অলা-ইয়ুব্দীনা যীনাতাহুন্না ইল্লা-লিবু‘ঊলাতিহিন্না আও আ-বা-য়ি হিন্না আও আ-বা-য়ি বু‘ঊলাতিহিন্না আও আব্না-য়িহিন্না আও আব্না-য়ি বু‘ঊ লাতিহিন্না আও ইখ্ওয়া-নিহিন্না আও বানী ইখ্ওয়ানিহিন্না আও বানী আখাওয়া তিহিন্না আও নিসা-য়িহিন্না আও মা-মালাকাত্ আইমা-নুহুন্না আওয়িত্তা-বি‘ঈনা গইরি উলিল্ ইরবাতি মিনার্‌ রিজ্বা-লি আওয়িত্ত্বিফ্‌লি ল্লাযীনা লাম্ ইয়াজ্ হারূ‘আলা-‘আওর-তিন নিসা-য়ি অলা-ইয়াদ্বরির্‌না বিআরজ্বু লিহিন্না লিইয়ু’লামা মা-ইয়ুখ্ফীনা মিন্ যীনাতিহিন্না; অতূবূ ইলা ল্লা-হি জ্বামী‘আন্ আইইয়ুহাল্ মু’মিনূনা লা‘আল্লাকুম্ তুফ্‌লিহুন।”

অর্থ: মুসলমান পুরুষদেরকে নির্দেশ দিন যেন তারা নিজেদের দৃষ্টিসমূহকে কিছুটা নিচু রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য খুবই পবিত্র। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট তাদের কার্যাদির খবর রয়েছে এবং মুসলমান নারীদেরকে নির্দেশ দিন তারা যেন, নিজেদের দৃষ্টিগুলোকে কিছুটা নিচু রাখে এবং নিজেদের সতীত্বকে হেফাযত করে। আর নিজেদের সাজ-সজ্জাকে প্রদর্শন না করে। কিন্তু যতটুকু স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ পায় এবং মাথার কাপড় যেন, আপন গ্রীবা ও বক্ষদেশের প্রতি ঝুলানো থাকে। আর আপন সাজ-সজ্জাকে যেন প্রকাশ না করে। কিন্তু নিজেদের স্বামীর নিকট অথবা আপন পিতা অথবা স্বামীর পিতা অথবা আপন পুত্রগণ অথবা স্বামীর পুত্রগণ অথবা আপন ভাগিনাগণ অথবা স্বধর্মীয় নারীগণ অথবা নিজেদের হাতের মালিকানাধীন দাসীগণ অথবা চাকরের নিকট এ শর্তে যে, তারা যৌন শক্তিসম্পন্ন পুরুষ হবে না। অথবা ওই সব বালক (এর নিকট) যারা নারীদের লজ্জার বস্তুগুলোর সম্বন্ধে অবগত নয় এবং যেন মাটির উপর সজোরে পদক্ষেপণ না করে, যাতে জানা যায় তাদের গোপন সাজ-সজ্জা এবং আল্লাহ্র দিকে তাওবা করো, হে মুসলমানগণ! তোমরা সকলেই, এ আশায় যে, তোমরা সফলতা অর্জন করবে।

পবিত্র কোরআনে সূরা নূর, আয়াত-৬০ আল্লাহ পাক আরোও বলেছেন- “অল্ ক্বওয়া-‘ইদু মিনান্নিসা-য়িল্ লা-তী লা-ইয়ার্‌ জ্বূ না নিকা-হান্ ফালাইসা ‘আলাইহিন্না জ্বু না-হুন্ আইঁ ইয়াদ্বোয়া’না ছিয়া-বা হুন্না গইর মুতাবার্‌রিজ্বা-তিম্ বিযীনাহ্; অআইঁ ইয়াস্তা’ফিফ্না খইরুল্লাহুন্; অল্লা-হু সামী‘উন্ ‘আলীম্।”

অর্থ: যারা বৃদ্ধা ঘরে অবস্থানকারী নারীগণ, যাদের বিবাহের আশা নেই, তাদের উপর কোন পাপ নেই, তাদের বহিরাবরণ খুলে রাখলে তখন যেন সাজ-সজ্জা প্রদর্শন না করে এবং তা থেকেও বিরত থাকা তাদের জন্য আরো অধিক উত্তম; এবং আল্লাহ্ শুনেন, জানেন।

পবিত্র কোরআনে সূরা আহ্‌যাব, আয়াত-৩৩ এখানে আল্লাহ পাক বলেছেন-“অক্বরনা ফী বুইয়ূতিকুন্না অলা-তাবার্‌রজ্ব্‌  না তাবার্‌রুজ্বাল্ জ্বা-হিলিয়্যাতিল্ ঊলা।”

অর্থ: নিজেদের গৃহসমূহে অবস্থান করো এবং বে-পর্দা থেকো না যেমন পূর্ববর্তী জাহেলিয়াতের যুগের পর্দাহীনতা।পূর্ববর্তী জাহেলিয়াতের মাধ্যমে প্রাক-ইসলামী যুগ বুঝানো হয়েছে। ওই যুগে নারীরা স্বগর্বে ঘর থেকে বের হতো, নিজের শোভা ও সৌন্দর্যের বাহার দেখাতো, যাতে পর-পুরুষেরা তাদের দিকে তাকায়। পোশাক-পরিচ্ছদ এমনভাবে পড়তো যে, শরীর ভালোভাবে ঢাকতো না। বর্তমান পৃথিবীতে পূর্বের জাহেলিয়াতি যুগের মতো-ই জলে-স্থলে, আকাশে, বাতাসে বিপদ-আপদ গজব-আজাবের কবলে দিনকে দিন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দিকভ্রান্ত নাবিকের মত প্রতি মুহূর্তেই দিশেহারা হয়ে পড়ছে, মানুষ তার অশান্ত মনের লাগাম কষে ধরে রাখার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। উক্ত আজাব-গজব থেকে বাঁচতে হলে, সমস্ত নারী-পুরুষের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা আপনাদের ঈমান-আকিদা, আখলাক-চরিত্র ঠিক রাখার জন্য নিজেদের দৃষ্টি ও পোশাকের শালিনতা রক্ষা করে চলার চেষ্টা করুন। বর্তমানে মিডিয়ার কারণে সারাপৃথিবী হাতের মুঠোয়, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট অথবা টিভির রিমোটকন্ট্রোল চাপলেই এক দেশে থেকে অন্য দেশের খবরা-খবর সহজেই জানা যায়। দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখা যায় এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির দেখা মেলে। কিন্তু এর ভিতরে রয়েছে অনেক দেশের উগ্র সংস্কৃতি, যা ইসলামের দৃষ্টিতে পুরোপুরি নিষেধ। কিন্তু বিশ্ব সংস্কৃতির রঙ্গিন পর্দা মানুষের চোখের সামনে উন্মুক্ত, সেখানের পোশাক-পরিচ্ছদে থাকে উগ্র মনোভাবের আকর্ষণ। এই আকর্ষণের মোহ নারী-পুরুষ, ছোট বড় সবাইকেই আক্রন্ত করতে পারে। আর এতে আক্রন্ত হয়ে পড়লে মানুষের সুস্থ ও সুন্দর মানসিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে কঠিন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবীর অনেক অদেখা স্থানে না গিয়েও দেখা যায় এ কথা ঠিক। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এই দেখা এবং জানার মধ্যে কতটুকু সামাজিকতা, ভদ্রতা বা শালিনতা রক্ষা পাচ্ছে? এর প্রভাবে সমাজের অগ্রগতির পাশাপাশি কোন ক্ষতি হচ্ছে কি না? এর মাধ্যমে কোনো রকম আত্মিক উন্নতি হচ্ছে কি না? এই বিষয়গুলোও মনে রাখা দরকার।

বিজ্ঞানের প্রযুক্তি বাদ দিয়েও চলা যাবে না। মানুষের জীবন যাত্রার গতি, বুদ্ধির বিকাশ এবং প্রয়োগের ক্ষেত্র উন্নয়ন হয়েছে এর মাধ্যমে। কিন্তু মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের যে ব্যবহার, তার চেয়ে অকল্যাণের মাত্রাটাও খুব কম না। অনৈতিকতার ভারে নৈতিকতা ভুলে যেতে বসেছে মানুষ, বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন উপায়ে আধুনিকতার নামে চলছে নগ্নতা, যে কারণে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লজ্জা-শরম ও মানবিক মূল্যবোধ। একে অন্যের প্রতি আদব-কায়দা, মায়া-মহব্বত, ভক্তি-শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, যেটা কখনোওই কারো কাম্য হতে পারে না। অসংযত হয়ে পড়ছে মানুষের শুভবুদ্ধির খেয়াল-চিন্তাধারা, এ কারণে মানুষের চোখের পর্দা সরে গিয়ে সেখানে স্থান পাচ্ছে অন্যের ক্ষতি করার অসামাজিক কার্য্যকলাপ। অথচ পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বিশদভাবে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহতা’লা সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দিয়ে সৃষ্টি জগত ও মানুষের কল্যাণের জন্য এই অমূল্য মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন পাঠিয়েছেন, আমাদের প্রিয় আখেরী নবী রহমাতাল্লিল আলামিনের মাধ্যমে। নবীজি (সাঃ) আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন, তা সব জাতি, সব ধর্মের জন্যই মহা কল্যাণকর। সেখানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং মাতৃত্বের মায়ার যে সম্মিলন, তার কতটুকু আমরা উপলদ্ধি করতে পারছি নিজেদের জীবনে? কিংবা পবিত্র কোরআনের সঠিক শিক্ষা নিয়ে তা প্রয়োগের তাগিদ দিচ্ছি নিজেদের আত্মিক কল্যাণে? অথচ জীবনের অতি মূল্যবান সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।

অনেক আগে থেকেই ও বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় যে, দরাকারে বা, বিনা দরকারে টিভি ডিশ চ্যানেল ও ইন্টারনেটে ডুবে থাকে ছোট, বড়, যুবক, বুড়া, নারী-পুরুষ সবাই। কারণ ওখানে নিত্য পণ্যের নতুন সমাহার, যা চাই, তা-ই পাই! কিন্তু এই চাওয়া পাওয়ার ফাঁক গলে ফুরিয়ে যাচ্ছে অমূল্য সম্পদ সময়। উবে যাচ্ছে যুব-সমাজ, মরণঘাতী নেশার কবলে মৃত্যুবরণ করছে একেকটি মূল্যবান জীবন, সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে তাদের পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্র। সেই সব পরিবারের বাবা-মা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখা চোখের পানি ফেলছে রাত-দিন। নাবালক শিশু-সহ নানা বয়সের নারী-পুরুষ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, হিংসা-নিন্দা, মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-ফ্যাসাদ দাঙ্গা-হাঙ্গমা পৃথিবীতে লেগেই আছে। সবখানে শুধু আতঙ্ক আর হাহাকার, মানুষের উপর থেকে যেন শান্তি উঠে গেছে, কেউ কারো কথা শুনছে না, সবকিছুতেই কেবল দম্ভ-অহঙ্কার। এ কারণে এক মানুষের উপর থেকে আরেক মানুষের দয়া-মায়া-মমতা, মূল্যবোধ-শ্রদ্ধা-ভক্তি এবং বিশ্বাস সত্যিকার অর্থে কমে গেছে এবং যাচ্ছে। এখন বিজ্ঞানের প্রযুক্তি ও মিডিয়া কি পারে না, হারিয়ে যাওয়া লজ্জা-শরম, সামাজিক মূল্যবোধ, মায়ের মমতা এবং বাবার স্নেহ-ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে? নিশ্চয়ই মিডিয়ার পক্ষেই সম্ভম এ ধরণের গর্হিত কার্যকলাপ থেকে আপামর মানুষদেরকে রক্ষা করার সঠিক পদ্ধতি বা উপায় বেশি বেশি প্রচার করে ভুল পথ থেকে মানুষদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে। অবশ্যই মিডিয়া একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম যেখানে রয়েছে, গণ-মানুষের সমর্থন, তথ্য এবং আনন্দ-বিনোদনের স্থান। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, চিত্ত সুখ আর বিত্ত সুখ কখনোও এক না। মনের সুখের জন্য দরকার আল্লাহতা’লার পক্ষ থেকে রহমতের ছায়াধারা এবং বিত্ত সুখের জন্য দরকার অর্থ, আবার এই অর্থই মানুষের স্ব-ইচ্ছায় ডেকে আনে অনর্থের কঠিন জঞ্জাল।

তাই সম্মানীত পাঠকগণ, অল্প সময়ের জন্য দুনিয়াবী এ সমস্ত পাপের আবর্জনা এবং আখেরে আজাবের আগুন থেকে নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে এবং দেশকে বাঁচতে হলে, প্রথমেই নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। কারণ, অন্তরাত্মাকে পবিত্র না করে মৃত্যু হলে, সে মৃত্যুর কোনই মূল্য নেই। আত্মার এই পরিশুদ্ধতা অর্জন করা একা একা কখনোই সম্ভব না, এর জন্য প্রতিটি মানুষকেই তার (যুগে) সময়ে একজন কামেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতে হয়। কারণ, মহান আল্লাহর অলি-বন্ধু হিসেবে একমাত্র তিনি-ই পারেন, অন্ধকার নষ্ট আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং আঁধার মুছে ইহকাল ও পরকালের পথকে আলোকিত করার শিক্ষা দিতে। পৃথিবীতে দেশ-জাতীয়তা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে, ভাষা-রীতি-নীতি বা সংস্কৃতি আলাদা আলাদা হতে পারে, কিন্তু উগ্রতা বা নগ্নতার বাহার কোনো ব্যক্তি বা দেশ-কালের জন্যই আধুনিকতা হতে পারে না। কারণ, এতে মানুষের মন-সহ কোন কিছুর জন্যেই সুফল বয়ে আনে না। তাই মুসলমানদের অবশ্যই কর্তব্য এ সমস্ত গর্হিত কার্য্যকলাপ থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখে, পবিত্রতার সঙ্গে ঈমানকে রক্ষা করা এবং আল্লাহর ডাকে শক্ত ঈমান নিয়ে পরপারে যাওয়ার জন্যে সব সময় প্রস্তুত থাকা।

(Visited 379 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *