এইচ মোবারক
মানব জীবনে সূফী-সাধকদের প্রয়োজনীয়তা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অবশ্যই সূফী-সাধকগণ গভীর পা-িত্যের অধিকারী এবং বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। সূফী-সাধকগণ অসাধারণ জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও মানবপ্রেমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের সূফীবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে হেদায়েতের পথ দেখিয়ে থাকেন। বর্তমানে যে ক’জন সূফী-সাধক ইসলাম ও সূফীবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, তাদের মধ্যে আমার পীরকেবলাজান খাজাবাবা কুতুববাগী অন্যতম এক মহাগুরু। মুর্শিদকেবলা সূফীবাদের আধ্যাত্মিক তত্বজ্ঞানের দ্বারা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনে এনেদিয়েছেন লক্ষণীয় পরিবর্তন। ইসলামের মহা-সত্যের প্রতি মানুষকে আহ্বান করছেন প্রেম ও শান্তিময় বাণীর মাধ্যমে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সূফী মতবাদ উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করছে। মানব প্রেম তথা মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করাই সূফীবাদের মূল আদর্শ। কুতুববাগী কেবলাজানের উত্তম আদর্শময় জীবন এবং সূফীবাদের প্রেমময় মধুর বাণী প্রচার করে দেশ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
সৃষ্টিকে ভুলে স্রষ্টার প্রতি প্রেমাসক্তি অর্জন করাই সূফীবাদের এক অর্থ। সূফীবাদের এমন প্রেমাদর্শ দ্বারা সকলের মধ্যে মহব্বত ও রহমতের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন খাজাবাবা কুতুববাগী পীরকেবলাজান। যারা লৌকিক মরমীবাদ, সূফীতত্বসহ অন্যান্য ভক্তিবাদে বিশ্বাস করে না, তারাও আজ অনেকেই কেবলাজানের ভালোবাসার নৌকায় সহযাত্রী হয়েছেন। সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনেও সূফীদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যেমন নদী ও সমুদ্র পথে যাতায়াতের সময় চালক বা মাঝিমাল্লারা-সহ যাত্রী সাধারণেরাও তাদের নিজ নিজ পীর-মুর্শিদের নামটি অতি আদবের সঙ্গে স্মরণ করে যাত্রা শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, শহরে-বন্দরে দেখা যায় বিভিন্ন যানবাহনের গায়ে পীর-আউলিয়াদের নাম লেখা থাকে। আবার লৌকিক ধারায় দেখা যায় বিভিন্ন মুর্শিদী-মারেফতী, গাজীকালু-চম্পাবতীসহ হৃদয়কাড়া অসংখ্য মরমী কাব্য-সাহিত্য রচিত হয়েছে পীর-মুর্শিদকে কেন্দ্র করেই। এভাবেই বাংলার মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক জীবনের নানা ক্ষেত্রে সূফীবাদের প্রভাব অক্ষুন্ন রয়েছে।
ইসলামী বিধি-বিধান পরিপূর্ণরূপে পালন করার মাধ্যমে অন্তরে মহাসত্যের যে উপলব্ধি উন্মোচিত হয়, তা থেকেই অর্জন হয় অনাদি অনন্তের সত্যজ্ঞান। অন্য কথায়, স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান হলো মারেফত। মারেফতই হলো আসল বা খাঁটি মূলধন। আল্লাহর জাত (সত্তা) ও সিফাত (গুণাবলি) সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত হওয়াই মারেফত। তাসাউফের পরিভাষায় মারেফত হলো- আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় জানা, আল্লাহর জ্ঞানের জগতে সন্তরণ করা; আল্লাহর নূরের জ্যোতিতে সৃষ্টিকে দর্শন করা। তাই আত্মজ্ঞান ও সত্য জ্ঞানই হলো মারেফত। মারেফত হলো তাসাউফের চূড়ান্ত লক্ষ্য; মানব জীবনের পরম অবস্থা। এই ধরনের চির সত্য শিক্ষাসমূহ দিয়ে থাকেন আমার মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান। মানুষের কলবে যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা না থাকত, তাহলে মানুষ নিশ্চয়ই মালাকুতের আসমানকে দেখতে পেত। এ কথার মর্মার্থ এই যে, মানুষের কলব বা অন্তর হল এমন এক পাত্র, যা কেবল আল্লাহর মারেফতের জ্ঞানে পূর্ণ হওয়া এবং আল্লাহর পরিচয় জানা-শোনার জন্য সৃষ্টি। আর শয়তানের কাজ হল সেই অন্তরের পবিত্রতা নষ্ট করে সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা। এই শয়তানকে চিরতরে উচ্ছেদ করার মাধ্যমেই সত্যিকার জ্ঞান-মারেফাত অর্জন করা সম্ভব। মানুষের নফস হল শয়তানের আখড়া যেখানে কামনা-বাসনা হল শয়তানের খোরাক। যতক্ষণ এ খোরাক সেখানে থাকবে শয়তানও সেখানে আঠার মতো লেগে থাকবে। কিন্তু মুমিন বান্দা যখন একজন সত্য গুরুর আশ্রয় নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ইবাদতে রত হয়, তখন শয়তান পালাতে থাকে। রমজান মাসে আমাদের উচিত শয়তানের কলাকৌশল ও কারসাজি চিহ্নিত করে সেখানে ইবাদতের কামান দাগানো। কিন্তু মুখে বললেই সব পানির মতো সহজ হয়ে যায় না। গুরুদীক্ষা ব্যতিত শক্তিশালী শয়তানের সঙ্গে মোকাবিলা করা কোন মতেই সম্ভব নয়। যদি সেখানে নাফসানি চিন্তা-ভাবনা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ধান্ধাবাজি স্থান করে, তাহলে এ পাত্র হয়ে পড়বে আঁধার ও অজ্ঞতায় ঢাকা। এমন পাত্রে ঐশী জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং আল্লাহর মারেফাত স্থান পেতে পারে না। যদি এ রুহানি সত্তা বা কলব অন্ধকার ও অজ্ঞতামুক্ত হয়, তাহলে সেখানে জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও মারেফাত জায়গা করে নেবে এবং মানুষ তখন দুনিয়া ও আখেরাতের রহস্যাবলী অবলোকন করতে সক্ষম হবে। আল্লাহতায়ালা একমাত্র মানুষকেই জ্ঞান অর্জনের শ্রেষ্ঠতম যোগ্যতা দান করেছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেয়া হয়নি। অন্যদের মাঝে যা আছে সবই তাদের প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য এর বাহিরে তাদের যাওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু মানুষ আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধি বা খলিফা হওয়ার কারণে, তাকে এই মহাসম্পদ ও যোগ্যতা দান করা হয়েছে। মানুষ আসলে রুহানি সত্তা। যে মাটির অবয়ব নিয়ে দুনিয়ায় এসেছি কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জনের জন্য, এ মাটির দেহ নিয়ে এ দুনিয়াতেই নিজের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে হবে। যাতে আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া রুহের বিকাশ অর্জন করে পরিপূর্ণ রুহানি মানুষ হতে পারি। তবে তা কোন মতেই সম্ভব নয়; যদি না আমরা কোন কামেল গুরুর চরণে উপস্থিত হতে না পারি। তাই সৎ সাহসের সঙ্গে বলছি সূফীবাদের একজন সত্যগুরু বা পীর-মুর্শিদ যে কোন মানুষের পুরো জীবনকে পাল্টে দিতে পারেন তাঁর ঐশী তাওয়াজ্জহর শক্তি দিয়ে, এ ক্ষেত্রে খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
লেখক : সাংবাদিক ও খাদেম, কুতুববাগ দরবার শরীফ