আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নক্শবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী
বিশাল মোঘল সাম্রাজ্যের শতকরা পচাঁনব্বইজন ছিল হিন্দু। তাহারা সবাই ছিল বাদশাহর পক্ষে। এ ছাড়া দুনিয়াদার আলেম-ভন্ড-সূফীকুল, শিয়া প্রভৃতি গোষ্ঠিও বাদশাহর হাতকে শক্তিশালী করিয়াছে। জৈন-পারসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদেরও ছিল বাদশাহের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। সুতরাং বাদশাহ নির্বিঘ্নে ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া যাইতে লাগিলেন। সমগ্র হিন্দুস্থানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী শায়েখ আহমেদ ফারুকী শেরহিন্দি (রহ.), তাঁহার মুজাদ্দিদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ় সংকল্প লইয়া সংস্কারের কার্যে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। বেদাত ও কুফরীর যাঁতাকলে পিষ্ট ইসলামের ভয়াবহ দুরবস্থা দেখিয়া তাঁহার (ফারুকী) রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল।
তাই প্রথমে তিনি বাদশাহর এসলাহ প্রয়োজন মনে করলেন। বাদশাহর এসলাহর পূর্বে তার আমীর-ওমরাহগণের এসলাহর কার্যে নিয়োজিত হলেন। খান খানান, খানে আজম, সৈয়দ ছদরে জাহান, মোর্তজা খান, মহব্বত খান প্রমুখ ওমরাহ পূর্ব হইতেই হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর মুরিদ ছিলেন। তিনি তাঁহাদের দ্বারা বাদশাহ আকবরকে এইসব কুফরী কার্যকলাপ হইতে তওবা করিবার জন্য আহ্বান জানাইলেন। মুর্শিদের কথামত ওমরাহগণও বাদশাহ আকবরকে নানাভাবে বোঝাইতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইলো না। শিরক-কুফরীর প্রভাবে তাহার অন্তর পাষাণ হইয়া গিয়াছে। হেদায়েতের নূর সেখানে প্রবেশ করিতে পারিল না। বাদশাহ স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল রহিলেন।
একদিন বাদশাহ একটি অশুভ স্বপ্ন দেখিলেন। স্বপ্ন তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন ব্যাখ্যাবিদ ও জ্যোতিষীগণকে তিনি স্বপ্নটির বিষয়বস্তু জানাইলেন এবং উহার অর্থ জানিতে চাহিলেন। তাহারা বাদশাহকে জানাইলেন, এই স্বপ্নের অর্থ হইতেছে যে, বাদশাহর পতন অতি সন্নিকটে। বাদশাহ স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনিয়া ভীত ও চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। তিনি দমিয়া গেলেন। নতুন করিয়া ফরমান জারী করা হইল যে, পূর্বে দ্বীন-ই-এলাহী পালনের ব্যাপারে যে বাধ্য-বাঁধকতা আরোপ করা হইত, এখন হইতে উহা থাকিবে না। যাহারা সেজদা করিতে উচ্ছুক নয়, তাহাদিগকে বাদশাহর তরফ হইতে সেজদা করিবার জন্য জবরদস্তি করা হইবে না।
কিছুদিন পর বাদশাহ আকবর এক উৎসবের আয়োজন করিলেন। উৎসবের দুইটি দরবার নির্মিত হইল। একটি নাম রাখা হইল আকবরী দরবার এবং অপরটির নাম রাখা হইল মোহাম্মদী দরবার। আকবরী দরবার প্রস্তত করা হইল বহু অর্থ দিয়ে। চোখ ঝলসানো আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হইল। সুসজ্জিত মনোরম মঞ্চ নির্মিত হইল। নিমন্ত্রিত অতিথিদের উপবেশনের জন্য প্রস্তত করা হইল জৌলুসময় গালিচা। পুষ্পের সৌরভ, আতরের সুঘ্রাণে আকবরী দরবার পরিণত হইল ছোট-খাট শাদ্দাদের বেহেশতে। শাহীখানার ব্যবস্থা করা হইল। অপরদিকে মোহাম্মদী দরবারের অবস্থা ছিল বড়ই করুণ, ছিন্ন তাবু, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ফরাস দিয়া নির্মিত হইল এই দরবার। খাবারের ব্যবস্থা করা হইল নিকৃষ্ট মানের। আলোকসজ্জার ব্যবস্থা নাই। নিতান্ত মামুলী সাধারণভাবে নির্মিত এই দরবারটিকে আকবরী দরবারের নিকট জীর্ণ-শীর্ণ কুড়েঘর মনে হইতে লাগিল। এইরূপ করার মূলে বাদশাহ আকবরের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মানুষ দেখুক ও জানুক ইসলামের কার্যকারিতা বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, জীর্ণ-শীর্ণ এই ধর্ম বর্তমান যুগে অচল। দ্বীন-ই-এলাহী শান শওকতময় ও যুগোপযোগী ধর্ম। এখন আর কাহারও এ বিষয়ে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। মনে-প্রাণে সবারই নতুন ধর্মে দাখিল হওয়া উচিত।
উৎসবের দিন আসিল। নির্দিষ্ট সময়ে বাদশাহ আকবর তাহার পারিষদবর্গ, আমির ওমরাহ ও বিশিষ্ট অতিথিগণকে সঙ্গে লইয়া মহাসমারোহে তাবুতে প্রবেশ করিলেন। লোভী দুনিয়াদার লোকেরাও তাহার অনুসরণ করিল। আনন্দে উল্লাসে মুখরিত হইয়া উঠিল আকবরী দরবার। এমন সময় হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) তাহার মুরিদানসহ সেখানে আগমন করিলেন। তাহার বুঝিতে বাকি রইল না, কী উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন এবং কেন-ই বা এই দুই দরবারের সাজ-সজ্জার মধ্যে এইরূপ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। মুসলমানদের অপদস্থ ও কোনঠাসা করা ছাড়া এইসব অর্থহীন কার্যকলাপের আর যে কোনই উদ্দেশ্য নাই, তা তাঁহার অবিদিত রহিল না। কিন্তু মানসম্মান-ইজ্জত নিজের অর্জিত সম্পদ নয়। ইহা আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামত।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) তাঁর মুরিদান ও কিছু দরিদ্র মুসলমানসহ মোহাম্মদী দরবারে প্রবেশ করিলেন। আহারের সময় হইল। এমন সময় হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) তাঁর এক মুরিদের হাতে লাঠি দিয়া বলিলেন, যাও এই লাঠি দিয়া তুমি মোহাম্মদী দরবারের চতুর্দিকে একটি বৃত্তাকার দাগ দিয়া আস। উক্ত মুরিদ তাহার কথা মত লাঠি দিয়া দরবারের চর্তুদিকে বৃত্তাকার দাগ দিয়া ফিরিয়া আসিলেন, তিনি তাহার হাতে এক মুষ্টি ধূলি দিলেন এবং বলিলেন, এইবার বাহিরে গিয়া এই ধূলি আকবরী দরবারের দিকে ছুঁড়িয়া মার। মুরিদ আকবরী দরবারের দিকে ধূলি ছুঁড়িয়া মারিলেন। মুহূর্তের মধ্যে প্রলয়কান্ড ঘটিয়া গেল। ভয়ঙ্কর তুফান শুরু হইয়া আকবরী দরবারকে ঘিরিয়া ফেলিল। দরবারে মহা ধুমধাম চলিতেছিল। হঠাৎ তুফান দেখিয়া সবাই ভয় পাইয়া গেল। কী করিবে বুঝিয়া উঠিবার আগেই তাবু উড়িয়া গেল। আসবাবপত্র, সাজ-সজ্জা, খাদ্যসামগ্রী সমস্তই তছনছ হইয়া গেল। নিমন্ত্রিত অতিথিগণ একে অন্যের উপরে গড়াইয়া পড়িয়া ধস্তাধস্তি শুরু করিল। তুফানে তাবুর খুটিগুলি উপড়িয়া উঠিল এবং তাহাদের আঘাত করিতে শুরু করিল। একটি খুটি উপড়ে গিয়া বাদশাহর মস্তকে পর পর সাতটি আঘাত করিল। পাশে মোহাম্মদী দরবার। আল্লাহপাকের কী অপার মহিমা! মোহাম্মদী দরবারে তুফান এতটুকুও স্পর্শ করিল না। দরবারের সবাই হজরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর এই কারামত দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাহারা সবাই আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করিলেন।
মস্তকে সাতটি আঘাত খাইয়া বাদশাহ শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। তিনি শয্যা হইতে আর উঠিতে পারিলেন না। আঘাত বড়ই মারাত্মক হইয়াছিল। কয়েকদিন পরেই বাদশাহ মৃত্যুবরণ করিলেন। সুদীর্ঘ ৫০ বৎসর রাজত্ব করিবার পর বাদশাহ আকবর মৃত্যুবরণ করিলেন। দিল্লির মসনদে সমাসীন হইলেন পুত্র জাহাঙ্গীর। কিন্তু আকবর তাহার জীবদ্দশায় হুকুমতের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং রাজ্যব্যাপী দ্বীন-ই-এলাহীর ভ্রান্ত ধর্মীয় মতবাদের যে প্রভাব রাখিয়া গিয়াছিলেন, বাদশাহ জাহাঙ্গীর তা হইতে মুক্ত হইতে পারিলেন না। মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) মোঘল সাম্রাজ্যের হুকুমাত হইতে এই শয়তানী শক্তি নির্মূল করিবার জন্য দন্ডায়মান হইলেন। বাদশাহ বদল করিলে কাজ হইবে না। বাদশাহর এসলাহ্ করিতে হইবে। তাহার জন্য সর্বপ্রথমে এসলাহ্ করিতে হইবে হুকুমতের আমির ওমরাহগণের। কারণ, তাহাদের এসলাহ্ ব্যতিরেকে বাদশাহর এসলাহ্ স্থায়ী হইবে না। হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) তাই ইসলামী আইন-কানুন আক্বিদার প্রতি উৎসাহিত করিবার জন্য খানে আজম, লালাবেগ, খান জাহান, কলীজ খান, শায়েখ ফরিদ প্রমুখ দরবারীদের সহিত যোগাযোগ করিলেন। ক্রমে ক্রমে আবদুর রহিম খান খানান, খান জাহান, সদরে জাহান, খানে আজম, খাজা জাহান, মীর্জা দারাব, কলিজ খান, নবাব শায়েখ ফরিদ, হাকিম ফাতহুল্লাহ, শায়েখ আবদুল ওয়াহহাব, সেকান্দার খান লোদী, খেজের খান লোদী, জব্বারী খান, মীর্জা বদিউজ্জামান, সৈয়দ মাহমুদ, সৈয়দ আহমদ প্রমুখ ব্যক্তি মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.)-এর দলভুক্ত হইলেন। তিনি তাহাদের নিকট নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব, বেলায়েত, নবুয়ত, সুন্নতের অনুসরণ, কলবের সুস্থতা, নফসে আম্মারার স্বভাব ও তার অনিষ্ট হইতে মুক্ত হইবার উপায় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করাইয়া তাহাদিগকে এসলাহ্ করিলেন। ফলে হুকুমাতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হইতে বেদাত ও বেদাতসুলভ মনোভাব দুরীভূত হইল। মনে-প্রাণে এই দল হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর নির্দেশে বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে ইসলামের প্রতি উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমীর ওমরাহগণের মুখে সত্য পথের সন্ধান পাইয়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিলেন।
হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) সেনাবাহিনীর মধ্যেও ইসলাম প্রচারের ব্যবস্থা করিলেন। সেনাবাহিনী হুকুমাতের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অংশে এসলাহ্ হওয়াও জরুরী। তিনি শায়েখ বদিউদ্দিন (রহ.)-কে সেনাবাহিনীর মধ্যে সুন্নত ওয়াল জামাতের আক্বিদা বিশ্বাস, নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রভৃতি বিষয় প্রচারের জন্য নিযুক্ত করিলেন। উদ্দেশ্য সফল হইল। ক্রমে ক্রমে সেনাবাহিনীর এক বিপুল অংশ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর ভক্ত হইয়া উঠিল এবং অনেকেই তাঁর মুরিদ হইলেন।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর সংস্কারকার্য পূর্ণোদ্যমে চলিতে লাগিল। দ্বীনের মধ্যে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির যত রকম উৎস ছিল, প্রতিটির মুখেই তিনি শক্ত বাধ দিতে লাগিলেন। ছোট-বড়, সূক্ষ্ম-স্থুল সর্বপ্রকার বেদাত তিনি তাঁর মুজাদ্দিদসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচক্ষণতার সাহায্যে উদ্ধার করিলেন। নিপূণ চিকিৎসকের মতো সেইসব ব্যাধির প্রতিষেধক প্রয়োগ করিলেন। বিভিন্ন কৌশলে হেকমতের আলোকে তিনি সর্বপ্রকার বেদাত ও তাহাদের অনিষ্টসমূহ এমনভাবে প্রকাশ করিতে লাগিলেন, যাহাতে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ না বুঝিবার কোন কারণ অবশিষ্ট রহিল না।
শুধু হিন্দুস্তানেই নয়, হিন্দুস্তানের বাহিরে মা’অরা উন্নাহার, বদখশান খোরাসান, তুরা প্রভৃতি স্থানেও তিনি খলিফা নিযুক্ত করিলেন। সমস্ত খলিফাগণই ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী এবং বিচক্ষণ। তাহারা দ্বিতীয় হাজার বৎসরের মুজাদ্দিদ-এর সংসর্গের ফজিলতে এক একটি রত্নে পরিণত হইয়াছিলেন এবং ইসলাম প্রচারের জন্যে নিজের জীবনকে কোরবান করিয়াছিলেন। হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর মকতুবসমূহ বিভিন্ন খলিফাগণের নিকট পৌঁছিতে লাগিল এবং তাহারা দ্বীন ইসলামের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরিয়া পুঞ্জিভূত কুফরী আক্বিদাসমূহ ধ্বংস করিয়া সেই স্থলে সত্য ইসলামের নূর প্রজ্জলিত করিতে লাগিলেন।
দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদজনিত ফেৎনা, জাহেলা শ্রেণির মুসলামনগণের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির কুফরী রসুমাত, এর কোন কিছুই হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর দৃষ্টি এড়াইতে পারিল না। বাদশাহ জাহাঙ্গীর এই খবর পাইয়া মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে তাহার দরবারে উপস্থিত হইবার আমন্ত্রণপত্র পাঠাইলেন।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) আমন্ত্রণপত্র পাইলেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁহাকে দরবারে উপস্থিত হইবার জন্য আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন। বাদশাহর আমন্ত্রণ মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) পূর্বেই তাঁর বাতেনী কাশ্ফ দ্বারা অবগত হইয়া ছিলেন, বাদশাহ ও তাহার দরবারীগণের একাংশ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাহারা তাঁকে কতল করিতে চায়। সামনে বিপদ এবং এই বিপদ আল্লাহপাকের ইচ্ছা অনুযায়ী সম্পাদিত হইবে। ইহার মধ্যে যে অনেক হেকমত, অনেক রহস্য। আপাতদৃষ্টিতে বিপদ মনে হইলেও ইহার মধ্যে নিহিত রহিয়াছে প্রকৃত বিজয়। আল্লাহপাক সর্ববিষয়ে অধিক জ্ঞানী। তিনি মোমিনদের প্রতি বড়ই দয়াবান।
হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) তাঁর পাঁচজন বিশিষ্ট খলিফাসহ শাহী দরবার অভিমুখে রওয়ানা হইলেন। রাজধানীতে পৌঁছিয়া তিনি উজির আসফ খান-এর নিকট তাঁর আগমণ সংবাদ প্রেরণ করিলেন। আসফ খান তাহার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিবার সুযোগ পাইল। সে চিন্তা করিয়া ঠিক করিল, যে সময়ে বাদশাহর মেজাজ সাধারণত: উগ্র থাকে, সেই সময় হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর সহিত তাহার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিতে হইবে, যাহাতে অতি সহজেই সামান্য কোন বিষয় লইয়া দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। তাহা-ই হইল। বাদশাহ সিংহাসনে উপবিষ্ট। বিভিন্ন কারণে মেজাজ তাহার উগ্র। এমন সময় দরবারে প্রবেশ করিলেন হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) কিন্তু দরবারে প্রবেশ করিয়া সেজদা তো দূরের কথা, বাদশাহকে তিনি সালামও জানাইলেন না। বাদশাহ ক্ষিপ্ত হইলেন। প্রশ্ন করিলেন, আপনি দরবারের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন নাই। হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) বলিলেন, কী রূপে?
আপনি সেজদা করেন নাই, সালামও দেন নাই।
আপনার দরবারে সালাম দিবার প্রথা নাই। সে কারণে সালাম প্রদান হইতে বিরত রহিয়াছি। আর সেজদা তো একমাত্র আল্লাহর জন্য।
ইহা তাজিমি সেজদা।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) দৃঢ় তেজোদীপ্ত স্বরে বলিলেন, আমার মাথা মানুষের সামনে নত হয় না। বাদশাহ অপ্রতিভ হইলেন। কী আশ্চর্য সাহস এই ফকিরের! হইবে না কেন? আমিরুল মোমিনীন হযরত ওমর ফারুক (রহ.)-এর রক্ত যে তাঁর প্রতিটি শিরায় প্রবাহমান। বাদশাহ ক্ষণকাল অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) এর প্রতি। ঈমানের তেজ আর ফকিরের সৌন্দর্য দেখিয়া তাহার অন্তর মুগ্ধ হইয়া গেল। তিনি ক্ষিপ্ততা পরিহার করিয়া সাধারণভাবে বলিলেন, বেশ আপনার জন্য পূর্ণাঙ্গ সেজদার হুকুম উঠাইয়া লওয়া হইল। আপনি শির সামান্য নত করিলেই আমি সন্তুষ্ট হইব।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর সমস্ত অবয়বে ফারুকী দৃঢ়তা। পূর্বের ন্যায় এবারও তিনি দৃঢ়স্বরে বলিলেন, অসম্ভব।
বাদশাহর শাহী মর্যাদায় প্রবল আঘাত লাগিল। এই বিশাল হিন্দুস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি তিনি। তাঁহার সামান্য অঙুলী হেলনে এই রাজ্যে দিন-রাত্রিতে পরিণত হয়, রাত্রি হয় দিন। আর ইহাকে আদেশ নয়, ইহাকে তো সামান্য আবদারও বলা যাইতে পারে। কিন্তু তাহারও কোন মূল্য রহিল না। মোঘল দাম্ভিকতা বাদশাহকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তিনি প্রবল রোষভরে হুকুম দিলেন, ইহাকে মস্তক জোর করিয়া নত করাইয়া দাও।
অনেক লোক বাদশাহর হুকুম প্রতিপালনে আগাইয়া আসিল। তাহারা অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর মস্তক এতটুকুও অবনত করাইতে পারিল না। এই দৃশ্য দেখিয়া বাদশাহর ক্রোধ আরও বাড়িয়া গেল। দরবারীগণ পরামর্শ দিলেন, কতল করিবার হুকুম দিন জাঁহাপনা। এইরূপ ঔদ্বত্য কিছুতেই বরদাশত করা যায় না। বাদশাহ কোন হুকুম দিলেন না। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, ইহাকে কয়েদ করিয়া গোয়ালিয়র কেল্লায় প্রেরণ করা হউক।
আল্লাহপাকের নবী (আ.) ও রাসুলগণ বিস্ময়কর সৃষ্টি। যুগে যুগে তাঁরা ভ্রান্ত মানবকে পথের দিশা দেখাইতে গিয়া কতইনা দু:খ-কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। বিভ্রান্ত মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ কামনায় তাঁরা প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেন, অথচ তাহারাই তাঁহাদিগকে ভুল বুঝিয়া অথবা হিংসা বিদ্বেষের বশবর্তী হইয়া বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার করিতে থাকেন।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) উলুল আজম পয়গম্বরগণের কামালতবিশিষ্ট মুজাদ্দিদ। তাই তাঁর চরিত্র নবীসুলভ। গোয়ালিয়র কেল্লায় বন্দি হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে বদদোয়া করিলেন না। বরং আল্লাহপাকের ইচ্ছার প্রতি পরিপূর্ণরূপে সন্তুষ্টি রহিলেন। হযরত ইউসুফ (আ.)ও কারাবরণ করিয়াছিলেন। হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) তাঁহার সুন্নত প্রতিপালনের তৌফিক পাইয়া আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করিলেন।
নতুন পরিবেশ, অদ্ভুত পরিবেশ। এখানে শুধু বন্দি আর বন্দি। শত শত চোর, ডাকাত ও অন্যান্য সামাজিক দুস্কৃতকারীরা তাহাদের অপরাধের দায়ে এই খানে বন্দি জীবন কাটাইতেছেন। কী উচ্ছৃঙ্খল তাহাদের জীবন! শয়তানের চক্রান্তে পড়িয়া তাহারা বিভ্রান্তির অগ্নিতে পুড়িয়া পুড়িয়া মরিতেছে। পথ দেখাইবার কেহ নাই, ভালো কথা বলিবার কেহ নাই, সান্তনা দিবার কেহ নাই। মানবতার এই চরম অধঃপতন দেখিয়া হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর অন্তর কাঁদিয়া উঠিল। তিনি সমাজের চোখে এইসব ঘৃণিত ব্যক্তিদের এসলাহ্ করিবার কার্যে হাত দিলেন। ইহা তো তাঁরই কাজ। বন্দিদের বেশির ভাগই ছিল কাফের। হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) তাহাদেরকে ইসলামের নূরের সন্ধান দিলেন। পুষ্পের সৌরভ কখনও চাপা থাকে না। মুজাদ্দিদ কুসুম ও সৌরভ ছড়াইতে লাগিলেন। সত্যের সৌরভে বন্দিগণের অন্তর ভরিয়া গেল। ক্রমে ক্রমে তাহারা ইসলামের সুবাসিত হাওয়ায় প্রাণ ভরিয়া নিঃশ্বাস লইতে শুরু করিল। বন্দিশালা পরিণত হইল ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রে।
হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর কারাবরণের সংবাদ ধীরে ধীরে সমস্ত খলিফা, মুরিদান ও ভক্তগণের নিকট পৌঁছিতে লাগিল। প্রিয় মুর্শিদের এই কষ্ট দেখিয়া সবারই অন্তরে ক্ষোভের আগুন জ্বলিয়া উঠিল। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বাদশাহর সহিত যোগাযোগ করিয়া মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিলেন। খলিফাগণের মধ্যে কেহ কেহ বদদোয়া করিবার এজাজত চাহিয়া তাঁর নিকট পত্র লিখিলেন। কিন্তু হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) কিছুতেই এজাজত দিলেন না। তাঁর ছোট সাহেবজাদা হযরত মোহাম্মদ মাসুম (রহ.), মীর মোহাম্মদ নোমান (রহ.), শায়েখ বদিউদ্দিন (রহ.) প্রমুখ খলিফাগণকে তিনি বিভিন্নভাবে এই কারাবরণের প্রকৃত রহস্য উম্মোচন করিয়া সারগর্ভ নসিহতের মাধ্যমে প্রত্যেককেই, আল্লাহপাকের ইচ্ছার প্রতি পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট থাকিবার নিদের্শ দিলেন। হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর কারাজীবনের কার্যকলাপের সংবাদ বাদশাহর নিকট পৌঁছিতে লাগিল। তিনি শুনিলেন, হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) কারাগারের অপরাধী কাফেরগণকে মুসলমান বানাইতেছেন। তাঁর খলিফাগণকে তিনি কোন প্রকার বদদোয়া করিতে কঠোরভাবে নিষেধ করিয়াছেন। এমনকি কারাজীবনের বিন্দু পরিমাণ প্রতিক্রিয়াও তাঁর উপর পড়ে নাই। বরং ইহাকে আল্লাহপাকের ইচ্ছা মনে করিয়া খুশি হইয়াছেন। বাদশাহ তাহার শেরহিন্দের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবার হুকুম দিয়াছেন। তাহা সত্ত্বেও তিনি পুত্রপরিজনদের প্রতি এই কারণে অসন্তুষ্ট হইতে নিষেধ করিয়াছেন। তিনি নাকি বলিয়াছেন, এই সমস্ত অস্থায়ী বস্তুর মূল্য এমন কিছু নয়, যাহার জন্য হৃদয় বিচলিত হইতে পারে। বাদশাহ ভাবিলেন, এই মানুষটি কী? প্রতিশোধ গ্রহণের তাহার ওপর বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা নাই। অথচ ইচ্ছা করিলেই তিনি এখন রাজ্যময় লক্ষ লক্ষ মুরিদানের সাহায্যে বিরাট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিতে পারেন। বাদশাহ বিস্মিত হইলেন। তবে কি আসফ খানের দলের লোকজনের আশঙ্কা মিথ্যা? হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) সত্যিই তাহার অমঙ্গল কামনা করেন নাই? বাদশাহ ভাবিতে লাগিলেন, তবে কি তিনি অন্যায় করিয়াছেন? আল্লাহর ফকিরকে অন্যায়ভাবে কয়েদ করিয়াছেন? এবং তাহাদিকে পরাজিত করাও সহজ হইবে। কিন্তু বাদশাহ এই সিন্ধান্তে রাজী হইলেন না। কারণ, তাহা হইলে বিদ্রোহীগণ আরও বেশি ক্ষিপ্ত হইয়া যাইবে এবং সাম্রাজ্যব্যাপী চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিবে। ইহাতে পরিস্থিতি হয়তো নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইবে। তাই সর্বপ্রথম মহব্বত খানের দলকে পরাভূত করিবার পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত করিতে হইবে। শায়েখ আহমদকে কতলের বিষয়ে পরে চিন্তা করা যাইবে। বাদশাহ নিজে সেনাপতি সাজিলেন। বিশাল সেনাবাহিনী সহকারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হইলেন।
সাম্রাজ্যব্যাপী বিদ্রোহের আগুন জ্বলিয়া উঠিতেছে। দীর্ঘদিন ধরিয়া এই বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলিতেছিল। যে সকল আমীরগণকে বাদশাহ আসফ খানের চক্রান্তে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তার ভার দিয়া পাঠাইয়া দিলেন, তারা হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর কারাবরণের সংবাদ শুনিয়া অস্থির হইয়া গেলেন। প্রিয় মুর্শিদের প্রতি এই অত্যাচারের সংবাদে তাহাদের অন্তরে ক্ষোভের অনল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। তাহারা পরস্পর চিঠিপত্র আদান প্রদানের মাধ্যমে এই গুরুতর সমস্যা সমাধানের উপায় সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিলেন। শেষ পযর্ন্ত তারা সিদ্ধান্তে আসিলেন যে, বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিতে হইবে। কারণ, বাদশাহ ও তার দল হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে কয়েদ করিবার ষড়যন্ত্র পূর্বে করিয়াছিল এবং এই কাজ যাহাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, তাই তাহাদেরকে রাজধানী হইতে বিভিন্ন প্রদেশে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। বিদ্রোহ করা ছাড়া এখন আর কোন উপায় নাই, শাহী প্রাসাদে জঘন্য চক্রান্ত চলিতেছে। সেই চক্রান্ত সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করিয়া দিতে হইবে। এই সিদ্ধান্তের পর যুদ্ধের প্রস্তুতি চলিতে লাগিল। বিভিন্ন স্থান হইতে সৈন্য আসিয়া কাবুলে সমবেত হইতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে এই সমাবেশ বিশাল সেনাবাহিনীতে পরিণত হইল। এই সেনাবাহিনীর সেনাপতি হইলেন মহব্বত খান। মহব্বত খান খোৎবা হইতে বাদশাহর নাম বাদ দিবার নির্দেশ দিলেন এবং মুদ্রা হইতেও বাদশার নাম উঠাইয়া দিলেন। অতঃপর যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। তারপর তিনি তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়া রাজধানীর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। বিশাল মুজাহিদীবাহিনী আগাইয়া চলিয়াছে। সবারই মুখে সত্যের দীপ্তি জ্বল-জ্বল করিতেছে। অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর যুদ্ধ। মোঘল বাদশাহর অহঙ্কার ধূলায় মিশাইয়া দিতে হইবে। প্রিয় মুর্শিদের প্রতি অত্যাচারের সমুচিত শিক্ষা দিতে হইবে।
ঝীলাম নদীর তীর। উভয় বাহিনী সামনা-সামনি দাঁড়াইল। একদিকে শাহী বাহিনী, সেনাপতি স্বয়ং বাদশাহ। অপরদিকে বিদ্রোহী বাহিনী, সেনাপতি হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর সাচ্চা মুরিদ মহব্বত খান। যুদ্ধ শুরু হইল। শাহী বাহিনী বিদ্রোহী বাহিনীকে আক্রমণ করিল। বাদশাহ বীরবিক্রমে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন মহব্বত খানের উপর। মহ্ববত খান প্রতি আক্রমণ না করিয়া কৌশলমূলক পলায়ন করিলেন। বাদশাহ তাঁহার পশ্চাতে ধাবিত হইলেন। শাহী বাহিনীর মধ্যে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর অনেক ভক্ত ছিলেন। বাদশাহর তা জানা ছিল না। তিনি যখন নিজ বাহিনী থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন, তখন মহব্বত খান উভয় বাহিনীর মুজাদ্দিদভক্তদের সহায়তায় সহজেই বাদশাহকে ঘিরিয়া ফেলিলেন এবং বন্দি করিলেন। শাহী বাহিনী পরাজিত হইল। বাদশাহ বন্দি হইলেন। মহব্বত খানের সমস্ত সৈন্যদের মনে বিজয়ের আনন্দ। সবারই মনে আশা, এইবার দিল্লীর মসনদে তাহারা হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-কে উপবেশন করাইবেন। মহব্বত খানের অন্তরেও সেই আশা। তিনি হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর নির্দেশের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। তিনদিন কাটিয়া গেল। অবশেষে হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর নির্দেশ আসিল, ফেৎনা ফ্যাসাদ বন্ধ করুন। বিশৃঙ্খলা আমার কাম্য নয়। পূর্বের মত বাদশাহর অনুগত হইয়া চলুন।
মহব্বত খানের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। কোন বাধা নাই, বিপত্তি নাই। দিল্লীর মসনদ শূন্য। ইচ্ছা করিলেই উহাতে আরোহণ করা যায়। কিন্তু কী করা যাইবে প্রিয় মুর্শিদের হুকুম। মহব্বত খান তাঁর ইচ্ছাকেই শিরোধার্য করিয়া লইলেন। তিনি তো তাঁহার গোলাম ব্যতীত কিছু নহে। প্রেমাস্পদের ইচ্ছানুযায়ী কার্য করাই প্রেমিকের কাজ। তিনি তো মুজাদ্দিদ কুসুমের আশেক ছাড়া আর কিছুই নহে।
যে জন যাহার প্রেমে হয়েছে বিলীন
সে জন নিশ্চয় হইবে তাহার অধীন।
মহব্বত খান বাদশাহকে মুক্ত করে দিলেন এবং প্রিয় মুর্শিদের নির্দেশ তাকে জানাইয়া দিয়া, পূর্বের মত শাহী আনুগত্যের সহিত কর্তব্য সম্পাদন করিয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। শুধু তাজিমি সেজদা করিলেন না। নতুন বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা লইয়া বাদশাহ জাহাঙ্গীর রাজধানীতে ফিরিয়া আসিলেন। পরাজিত হইয়াও তিনি জয়লাভ করিলেন। বন্দি হইয়াও সসম্মানে মুক্তি পাইলেন। এ কেমন বিস্ময়!
সম্প্রতি বাদশাহ যেন কেমন হইয়া গিয়াছেন। যুদ্ধে তিনি কি সত্যিই জয়লাভ করিয়াছেন? ইহা কি জয় না পরাজয়? প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া তিনি যাঁহাকে বন্দি করিয়া রাখিয়াছেন, তিনি তাঁহাকে এক দিনও বন্দি থাকিতে দিলেন না। কি-ই বা তাঁহার অপরাধ ছিল? আদব কি মানবতা অপেক্ষা বড়? প্রতিটি ঘটনায় যিনি প্রমাণ করিয়াছেন, দুনিয়ায় কোনপ্রকার শান-শওকতের বিন্দু পরিমাণ মোহ তাঁর নাই। সেই নির্লোভ নির্মোহ আল্লাহর ফকিরকে বন্দি করিবার কী অধিকার তাহার আছে? তিনি যাঁহাকে কষ্ট দিয়াছেন সেই আল্লাহর ফকির বরাবরই তাহার কল্যাণ কামনা করিয়াছেন। তিনি যাঁহাকে গৃহচ্যুত করিয়াছেন সেই আল্লাহর ফকির তাহার হৃত সিংহাসন নির্দ্বিধায় ফেরৎ দিয়াছেন। পরাজয়, তাহারই শোচনীয় পরাজয় হইয়াছে। বাদশাহর মোঘল দাম্ভিকতা চুর্ণবিচুর্ণ হইয়া গেল। বিশাল হিন্দুস্থানের বাদশাহ হইয়াও হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর অন্তর কত বিশাল। প্রকৃতপক্ষে ফকিরগণই বাদশাহ। বাদশাহর অন্তরে অনুতাপের অনল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। শাহাজাদা শাহজাহান বহুদিন হইতে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর মুক্তির জন্য সুপারিশ করিতেছিলেন। বাদশাহও এবার ভাবিলেন, হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে মুক্তি দিতে হইবে। সত্য বুঝিতে অনেক বিলম্ব হইয়াছে, আর নয়। বাদশাহ হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে মুক্তির আদেশ প্রদান করিলেন এবং তাঁহাকে শাহী দরবারে তশরীফ আনিবার জন্য আমন্ত্রণ জানাইলেন। হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) মুক্তি হইলেন কিন্তু বাদশাহর সহিত সাক্ষাতের পূর্বে তিনি সাতটি শর্ত প্রদান করিলেন। তিনি জানাইলেন, শর্তগুলি মানিয়া লইলে তিনি বাদশাহর সহিত সাক্ষাৎ করিতে প্রস্তুত আছেন।
শর্তসমূহ :
১. দরবার হইতে তাজিমি সেজদার প্রচলন উঠাইয়া দিতে হইবে।
২. ভগ্ন ও বিরান মসজিদসমূহ আবাদ করিতে হইবে।
৩. গরু জবেহ করিবার উপর যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে, তাহা রহিত করিতে হইবে।
৪. ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য বিভিন্ন স্থানে কাজী, মুফতি নিয়োগ করিতে হইবে।
৫. জিজিয়া কর পূনরায় প্রবর্তন করিতে হইবে।
৬. সকলপ্রকার বেদাত কার্যকলাপ বন্ধ করিয়া দিতে হইবে।
৭. রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হইবে।
বাদশাহ সমস্ত শর্ত নির্দ্বিধায় মানিয়া লইলেন। শর্তসমূহ বাস্তবায়িত করিবার জন্য শাহী ফরমান জারী করা হইল। তাজিমি সেজদা বন্ধ হইল। গরু জবেহ-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আর রহিল না। জিজিয়া কর পূন:প্রবর্তিত হইল। সকল প্রকার বেদাত কার্যকলাপ কঠোর হস্তে দমন করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইল। শরিয়তভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য, স্থানে স্থানে কাজী নিয়োগ করা হইল। শহর ও গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপনের ব্যবস্থা করা হইল। বাদশাহ নিজের আম দরবারের সম্মুখে একটি মসজিদ নির্মাণ করাইলেন। হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.) বাদশাহর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য রাজধানীতে আসিলেন। বাদশাহ মহা সমাদরের সহিত সসম্মানে তাঁহাকে দরবারে লইয়া গেলেন। বাদশাহ তাঁহার নিকট নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়া মাফ চাহিলেন। অতপর হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর পবিত্র হস্তে বাইয়াত গ্রহণ করিলেন।