সেহাঙ্গল বিপ্লব আল মোজাদ্দেদি
যারা তরিকতের নাম কিংবা এ বিষয়ে কোন কথা শুনলে কখনো না বুঝেই হয়তো বিরক্ত প্রকাশ করেন। আবার এমন মানুষও কম নয় যারা ধৈর্য নিয়ে শুনেন এবং অতি আগ্রহের সঙ্গে জানতে চান, তাদের জন্য বলছি, নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার সিলসিলা শুরু হয়েছে দুই-জাহানের বাদশা আকায়ে নামদার সারওয়ারে কায়েনাত মোফাখ্খারে মউজুদাদ তাজিদারে মদিনা হযরত আহাম্মদ মোস্তবা মোহাম্মদ মোস্তফা হুজুরে পুরনূর (সঃ) থেকে। আমরা জানি তিনিই শেষ নবী তাই কাল কিয়ামত পর্যন্ত সকল সৃষ্টির জন্য রাহমাতাল্লিল আলামিন রূপে পৃথিবীতে আর্বিভুত হয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ)এর পবিত্র ওফাতের পর মহান আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম যাঁর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন তিনি চার খলিফাসহ খোলাফায়ে রাশেদ্বীনদেরও প্রধান আমীরুল মোমেনিন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। একেবারে বাল্যকাল থেকেই তিনি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর খুব প্রিয়সঙ্গী ছিলেন। তাঁর খিলাফত বা শাসনকাল ছিলো দুই বছরের কিছু সময় বেশি। এত অল্প সময় শাসন করলেও বাইজান্টানদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার এবং তাদের জুলুম অন্যায়কে প্রতিহত করার অভিযানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সফলতা অর্জন করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ)কে সাহাবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গণ্য করা হয়। ইসলাম ধর্মে প্রথম খলিফা হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে হযরত আবু বকরের নাম চিরকাল সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন থাকবে। এবং তিনি ওফাতের (ইন্তেকাল) আগ মুহূর্তেও তাঁর প্রাপ্য ভাতা থেকে সরকারী কোষাগারে কর পরিশোধ করেছিলেন। তিনি বাইতুল মাল নামক সরকারি কোষাগারের প্রতিষ্ঠাতা যা আজও বিদ্যমান। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সর্বকালেই বিশ্বাসী ও সত্যবাদীদের অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন, থাকবেন। ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, রাসুল (সঃ)-এর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে যাঁর পরিচিতি সর্বাধিক তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। আইয়ামে জাহিলিয়াত যুগের অন্ধকার পৃথিবীতে এক শ্রেষ্ঠ নূরের প্রদীপ মহানবী রাসুল (সঃ) এর পবিত্র জন্ম। এর দুই বছর তিনমাস পরেই জন্মগ্রহণ করেন আমীরুল মোমেনিন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। বিশ্ববাসীর কাছে রাসুল (সঃ) এর দেওয়া উপাধি ‘সিদ্দিকে আকবর’, ‘আবু বকর’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বাসী হিসেবে পরিচিতি বেশী হলেও, অনেকের কাছেই হয়ত অজ্ঞাত তাঁর প্রকৃত নাম ‘আবদুল্লাহ’। আবু বকর (রাঃ) পিতামাতার অত্যান্ত স্নেহভাজন সন্তান ছিলেন। সদ্ব্যবহার, অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণ-মাধুর্য, ব্যবসায়ীক সততা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার জন্য সমগ্র মক্কা নগরীতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি বজায় ছিল। তিনি যে সুখ্যাতি লাভ করেন, তা তাঁর ব্যবসায়ীক পিতা হযরত কোহাফের খ্যাতিকে ম্লান করে দিয়েছিল। কুরাইশ সর্দারগণ পর্যন্ত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে সম্মানের চোখে দেখতেন। এবং যেকোন গোত্রীয় ও সামাজিক কার্যকলাপে আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর উপস্থিতি অপরিহার্য বলে গণ্য হতো। সেই জাহেলিয়াত যুগে সকলেই কম বেশী পাপাচারে লিপ্ত থাকলেও, আল্লাহতায়ালার বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত যেসব পুণ্যাত্মা ঐসব পাপাচারকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতেন, আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) তাঁদের অন্যতম। একই বংশ ও প্রতিবেশী হিসেবে নবুয়্যতের বহু আগে থেকেই রাসুল (সঃ)-এর সঙ্গে, তাঁর মধুরমত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁদের বন্ধুত্ব এত গভীর ছিল যে, ব্যবসার বা অন্য কোন কাজে মক্কার বাইরে গেলেও তারা একসঙ্গে যেতেন। আল্লাহতায়ালা যেন মানিকজোড় করেই পাঠিয়েছেন দুজনকে! রাসুল (সঃ)-এর দ্বারা প্রবর্তিত নকশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রথম খেলাফত হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) থেকে শুরু হয়ে, বর্তমানে ছত্রিশতম (৩৬) খেলাফতপ্রাপ্ত হলেন এ জামানার মোজাদ্দিদ লক্ষ-কোটি আশেকান-জাকেরানের দিশারী খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান। এতে কোনপ্রকার দ্বিধার অবকাশ নাই। কেবলাজান প্রায়শ বলেন, ‘বাবারা, একা আর বোকা সমান।’ এ বেদবাক্য প্রথম যেদিন শুনলাম সেদিন থেকেই সত্যতা প্রমাণ পেয়ে আসছি, আসলে তো তাই! মনের ভাব প্রকাশের জন্যেও কাউকে লাগে, যে কিছুটা হলেও বুঝবেন তাঁর ইচ্ছা বা অনুভূতি। কেবলাজানের অমূল্য এ উক্তির গুরুত্ব অনুভব করলেই বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহতায়ালঅ আখেরী নবীর মতো জ্ঞানী ও ব্যক্তিত্ববান করে আর কাউকে না পাঠালেও, অন্তত তাঁকে বোঝা ও নি:স্বার্থ ভালোবাসার একজন করে হযরত আবু বকরকে পাঠিয়েছেন। এবং তাও ঠিক একই সময়ে যাতে করে দুজন এক সঙ্গে বেড়ে উঠতে পারেন, এবং একে অন্যের সকল স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে কাল কিয়ামত পর্যন্ত, আল্লাহর আইন ও রাসুলুল্লাহ (সঃ)এর সত্য তরিকা চলমান থকে। মহান আল্লাহর কাজ ও পরিকল্পনায় কোনোই ভুল নাই।
ইসলামের আগমনের শুরুতেই আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে রাসুল (সঃ) বলেন, ‘আমি যার কাছেই ইসলাম পেশ করেছি, সে-ই ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নিজে নিজে বিবেচনা করেছে, একটু চিন্তিত হয়েছে কিংবা আমার নবুয়াতের প্রমাণ চেয়েছে। কিন্তু আবু বকরকে ইসলাম পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নি:সংকোচে ইসলাম গ্রহণ করেছে।’ ইসলাম গ্রহণ করে তিনি দাওয়াতি কাজে নেমে পড়েন। তাঁর দাওয়াতে একে একে হযরত উসমান (রাঃ), হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ), হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ), হযরত আবদুর রাহমান ইবনে আউফ (রাঃ)-সহ আরো বিখ্যাত অনেক সাহাবি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয় মক্কার নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও ঈমানের ঘোষণা দিয়ে তিনি প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করতেন এবং পবিত্র কোরআন পাঠ করতেন। ঈমান এনে মুশরিকদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হওয়া গোলামদের মুক্ত করার জন্য তাঁর অর্থ-সম্পদ অঢেল খচর করতেন। কিন্তু তাঁর পিতা হযরত কোহাফা এ কাজ মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, ‘এ সমস্ত মামুলী গোলাম কিনে কিনে টাকা পয়সা নষ্ট করে কী লাভ?’ উত্তরে হযরত আবু বকর বলতেন, ‘আব্বাজান! এই ব্যবসার লাভ আপনার বোধগম্য হবে না।’
মিরাজের ঘটনা শুনে তখন অনেকে তা অবিশ্বাস করল। কাফেররা হাসি-তামাশা করতো। মিরাজের কথা রাসুল (সঃ)-এর মুখে শোনার আগেই রাস্তায় আবু জেহেল মিরাজ নিয়ে ব্যঙ্গ করছিল, তখন আবু বকর (রাঃ) শুনে বললেন, ‘যদি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এমনটা বলে থাকেন তবে তিনি সত্য বলেছেন। আমি তাঁর কথার প্রতিটি অক্ষরের সত্যতা স্বীকার করি। শুধু তাই নয় এর চেয়েও দূরের কোন পথ অতিক্রম করা আর আসমানি সংবাদ আসার সত্যতা আমি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি।’ এ খবর শুনে রাসুল (সঃ) আবু বকরকে ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মক্কার মুসলিমরা যখন দলে দলে হিজরত করছিলেন তখন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসুল (সঃ) এর কাছে হিজরতের অনুমতি চাইলেন। রাসুল (সঃ) তাকে বললেন, ‘তুমি তাড়াহুড়া করো না। আল্লাহ হয়তো তোমার জন্য একজন সহযাত্রী জুটিয়ে দিবেন।’ একথা শুনে আবু বকর ভাবলেন, রাসুল (সঃ) হয়তো নিজের কথাই বলেছেন। তাই তিনি দুইটা উট কিনে যত্ন সহকারে লালনপালন করতে থাকেন যাতে হিজরতের সময় কাজে লাগে। উম্মুল মুনিনীন মা আয়শা (রাঃ)-এর বর্র্ণনা থেকে পাওয় যায় একদিন রাসুল (সঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর বাড়িতে আসেন এবং এসে জানালেন, তাঁকে হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি কি সঙ্গে যেতে পারব?’ রাসুল (সঃ) বললেন,‘হ্যাঁ যেতে পারবে।’ হযরত মা আয়শা বলেন, ‘সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যে এত কাঁদতে পারে। আমি আমার পিতাকে সেদিন কাঁদতে দেখেছি।’ রাসুল (সঃ) মদিনার পথে যাত্রা করলেন। সঙ্গী আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)।
হযরত উমার (রাঃ) এর আমলে একবার এক মাজলিশে আলোচনা হচ্ছিল কে সেরা, আবু বকর (রাঃ) নাকি উমার (রাঃ)? উমার (রাঃ) বলেছিলেন, ‘যদি আমার সারা জীবনের নেকআমল আবু বকর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সঃ)এর সঙ্গে কাটানোর এক মুহূর্ত সমান হতো তাহলে কতই যে ভালো হতো।’ রাসুল (সঃ) এর প্রতি আবু বকরের ভালোবাসা পৃথিবীর সকল ভালোবাসাকেই যেন হার মানায়। ওফাতের পর সর্বসম্মতিক্রমে হযরত আবু বকর (রাঃ) খলিফা নির্বাচিত করেন। খলিফা হিসেবে তার প্রথম ভাষণে তিনি বলেন, হে জনমন্ডলী! আমাকে আপনাদের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম নই। যা-ই হোক, আমি ভালো কাজ করলে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। আর অন্যায় পথ অবলম্বন করলে আপনারা আমাকে সংশোধন করে দিবেন। মনে রাখবেন, সততা একটি আমানতস্বরূপ আর মিথ্যা তার খিয়ানত। ইনশাআল্লহ ! আপনাদের মধ্যে দুর্বলজন আমার কাছে সবল বলে বিবেচিত হবে, যতক্ষণ না আমি তার ন্যায্য অধিকার তাকে প্রদান করতে না পারি। আর আপনাদের স্ববলও আমার কাছে দুর্বল বলে বিবেচিত হবে, যতক্ষণ না আমি তার কাছ থেকে অপরের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে না পারি। হে জনসাধারণ! জেহাদকে অবহেলা করবেনা। (মূলত: এ জিহাদ হলো নিজের নফসের সঙ্গে আপোষ না করা), আল্লাহর জন্য জেহাদ থেকে যে জাতি বিরত থাকে, আল্লাহপাক সেই জাতিকে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্তু করে দেন। এবং তাদের ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটে। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর শাসনকালে কিছু মানুষ যাকাত দিতে অস্বীকার করে, এবং আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর কাছে বিভিন্ন অজুহাত আর দাবী-দাওয়া পেশ করল। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার বুকে এমন ক্ষমতা কারো নেই যে, ইসলামের আহকামের এক ধূলিকণা পরিমাণও পরিবর্তন- পরিবর্ধন করতে পারে। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বহু ধন সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সমস্ত কিছু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছিলেন।
আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) আল্লাহর এমন একজন বান্দা, যিনি দুনিয়ায় থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হন। তাঁর সুক্ষ্মাতি সুক্ষ্ম বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানও ছিল অপরিসীম, যে জ্ঞানের দ্বারা খুব সহজেই বুঝতে পারতেন মহানবী (সঃ)-এর সমস্ত কথা বা ইশারা-ইঙ্গিত। তাক্বওয়া আর ঈমানের মাপকাটিতে আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন অনন্য। আবার সেই মানুষই ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ছিলেন বজ্রকঠোর। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সরাসরি উত্তরসূরি হওয়ার কারণে তাঁকে ‘খলিফাতুর রাসুল’ বলা হয়। এবং তাঁর পবিত্র হাত ধরেই নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার চির শান্তির নিশান জাগ্রত হয়ে আছে, আখেরাত পর্যন্ত জাগ্রতই থাকবে।
আজ আমরা যারা এই মহান তরিকতের বাইয়াত গ্রহণ করতে পেরেছি, তারা নি:সন্দেহে অতি ভাগ্যবান। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তরিকার আমল ও মুর্শিদের আদেশ অনুসরণ করে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করার তাওফিক দান করেন, আমিন।