বিশ্বজনীন ভালোবাসায় সিক্ত ফার্সী ভাষার মহামূল্য গ্র্রন্থ মসনবী শরীফের লেখক ও আধ্যাত্মিকতার মহান সাধক, বিশ্বসাহিত্যের প্রভাবশালী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী, তাঁর জন্ম ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বলখ নগরের স্বনামধন্য প-িত বাহ্াউদ্দীন ওয়ালীদের ঘরে। শৈশব থেকেই রুমীর মধ্যে অনন্যতা প্রকাশ পেতে থাকে। ছোটবেলায় তিনি ইরানের নিশাপুরে বরেণ্য সূফী-সাধক হযরত ফরিদউদ্দীন আত্তারের সাক্ষাৎ ও আর্শীবাদপ্রাপ্ত হন। হযরত আত্তার তাঁকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ‘এই বালকটি মানুষের অন্তরে ভালোবাসার দ্বার উন্মোচন করবে।’ জ্ঞান তাপস রুমী (রঃ) তরুণ বয়সেই নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের সন্ধানে ব্যাকুল ছিলেন। এ জন্যে তাঁকে স্রষ্টার সান্নিধ্য প্রত্যাশী কবি বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ¯্রষ্টা প্রেমের বিরহ তাঁর লেখায় রূপকার্থে ফুটে উঠেছে বারবার। রুমীর স্বর্ণালী অধ্যায় রচিত হয় ১২৪৪ সালে তাঁর পীর হযরত শামস্ তিবরিজীর সান্নিধ্য প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে, তখন তিনি পারস্যের খ্যাতিমান আলেম-প-িত হিসেবে পরিচিত এবং পারস্যরাজ দরবারেও তাঁর সম্মান উঁচুতে। এমনই এক সময় হযরত শামস্ তিবরিজীর সঙ্গে মাওলানা রুমীর দেখা হয়। কিন্তু তখনও রুমীর মধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কিছুই ছিলো না। এ অবস্থায় আল্লাহর ফকির হযরত শামস্ তিবরিজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন, এবং এ সময়ে তাঁর চিন্তা-চেতনা ও আত্মার উন্নয়নে বিশাল এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটান। যে পরিবর্তন ও আত্মিক জ্ঞানোপলব্ধি তাঁর সারাজীবনের শরিয়তি শিক্ষার মধ্যে ছিটাফোটাও পাননি। পরবর্তীতে তাঁর রচিত ‘হৃদয়ের আয়নায়’ ও ‘দিওয়ানে শামস তিবরিজ’ কাব্যগ্রন্থে পীরভক্তি, আত্মসমর্পণ, আপন মুর্শিদের প্রতি ফানা এসব রূপকের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার উচ্চ স্তরের বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করেছেন। মাওলানা রুমীর দর্শনে আমিত্বকে জয় করার ধারণা ও প্রমাণ নানাভাবে ফুটে উঠেছে এভাবে, তিনি বলেনÑ মানুষের নফস বা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিজেকে কামেল মুর্শিদের কদমে সমর্পণ করতে হবে। এবং তবেই হৃদয়ের দ্বার উন্মোচিত হয়ে পরম ¯্রষ্টার সান্নিধ্য উপলব্ধি ঘটে। আল্লাহতায়ালার ফকির হযরত শাম্স তিবরিজীর প্রেমে ফানা হয়ে, সাধক-কবির হৃদয়ে সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করেছেন বিভিন্ন কাব্যিক ছন্দের গতিময়তায়। সেখান থেকেই মূল ফার্সী ভাষায় রচিত কবিতার বাংলা অনুবাদ মাসিক আত্মার আলো-এর পাঠক ভাইবোনদের জন্য তুলে ধরা হলো।
তুমিই আনন্দ
হে আল্লাহ, আমাদের কলুষিত চক্ষুগোলকের দৃষ্টি
ঝাপসা, প্রায়ান্ধ; স্ফীত আমাদের মোহান্ধ পাপের বোঝা
পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি ছড়ানো তোমার যতো সৃষ্টি
সবখানেই লুকিয়ে তুমি, আমাদের শুধু নিরন্তর খোঁজা।
সূর্যালোকের চেয়েও অধিক প্রোজ্জ্বল, জ্বলে আছো তুমি
এবং আমাদের চেতন সত্ত্বার অস্তিত্বের জীবন্ত বারুদ
তোমার স্পর্শেই বিকশিত হয় আদিগন্ত মনোভূমি
বিস্ফোরণের মতোই তোমার নামের কল্যাণী দরূদ
আমাদের ঘুমন্ত নদীগুলোকে করে তোলে স্ফীত।
তোমার অস্তিত্ব লুকোনো রয়েছে অতি সুকৌশলে
তোমার তাবৎ উপহার প্রকাশ্য এবং অবারিত।
আমরা তো কেবল তৃৃৃষ্ণার্ত পাথর সমুদ্রতটে দলে দলে
তুমিই রহমতের জলধারা, ভেজাও নিয়ত আমাদের
তুমি প্রবহমান বাতাস, আমরা তো ধূলিকণামাত্র
সকলেই দেখে নড়াচড়া, ওড়াওড়ি, ধুলিঝড়ের
অদেখা বায়ুর মতো প্রবাহিত তুমি অহোরাত্রি।
তুমিই অদৃশ্য বসন্তের বায়ু, আমি দিগন্তের সবুজ বনানী
তুমি অন্তর্নিহিত শক্তি, আমি তো কেবল অসার হাত ও পা
তুমি উপস্থিত বলেই নড়ে ওঠে আমাদের হস্ত-পদখানি
আমি তো শুধুই কণ্ঠস্বর, তোমার জ্ঞানই অস্তিত্বে রোপা
আমাদের এই হাঁটাচলা বিশ্বাসেরই নিরন্তর প্রতিভূ
অনন্ত স্বাক্ষর সন্দেহাতীত তোমার অমোঘ অস্তিত্বের
আমি তো কেবলই এক প্রায়ান্ধ প্রদীপ, নিভু-নিভু
তোমার স্পর্শেই জ্বলে উঠি নিয়ত, ঘোষণা করি বিজয়ের।
মাথার ওপর অহরহ বাসা বাঁধে সময়ের ধূলিকণা
মেঘের জেলাবী খুলে আকাশ দেখায় কী নিখুঁত তার পেট
তোমার এ দাস কি করে লিখবে বলো গুণের বর্ণনা?
আমার এ আত্মা হোক তোমার পায়ের নিচে বিছানো কার্পেট।
সুধী পাঠক, ইসলামের আধ্যাত্মবাদ যুগে যুগে দেশে দেশে বিপুলভাবে চর্চা হয়ে আসছে, এ ভাব ধারা নতুন নয়। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের মুসলিম দেশগুলোতে সূফীবাদের চর্চা ও প্রসার ইর্শ্বণীয় পর্যায়ে থাকলেও, উপমহাদেশে এর অগ্রযাত্র তুলনামূলক শিথিল। একটা সময় এ দেশেও সূফীবাদের প্রতি সকল মানুষের শ্রদ্ধা ও আগ্রহের কমতি ছিলো না, কিন্তু পুঁজিবাদের আগ্রাসনে কিছু বিতর্কীপন্থির কুশিক্ষা ও ধর্মান্ধতার কবলে পড়ে, মহান আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর সত্য পথের সন্ধান থেকে, সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করিয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুনাফা লুটেছে। সূফীবাদ মানুষে মানুষে শ্রেণি বৈষম্য বিশ্বাস করে না, অথচ পুঁজিবাদী ওই গোষ্ঠী বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে আধ্যাত্মবাদের চেতনাকে তীব্র সমালোচনায় লিপ্ত রয়েছে। সূফীবাদের তথা আধ্যাত্মবাদের মহা জ্ঞানী হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ)-এর কবিতায় দেখতে পেলাম, কামেল পীর-মুর্শিদের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মেলবন্ধন, যা বর্তমান সময়ে প্রত্যেক মানুষের জন্যই জানা ও মেনে চলা জরুরী।
গ্রন্থনা : সেহাঙ্গল বিপ্লব আল মোজাদ্দেদি