সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জন করতে হয়

আবুল খায়ের অনিক

সবচেয়ে বড় সত্য হল সাধনার মাধ্যমে নিজেকে চেনা। অন্তর থেকে আমিত্বকে দূূর করে সৃষ্টিলোকের অনুসন্ধাই হচ্ছে সাধনা। নিজেকে চেনা জানার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য জানা যায়। সবাই জানি আল্লাহ প্রকাশ্য নয়, তবে তিনি সর্ব অবস্থায়, সর্ব স্থানে বিরাজমান। এই বিরাজমান স্রষ্টাকে চেনা-জানার উপায় হল ধ্যান সাধনা। আপন সৃষ্টিলোকে জ্ঞানের বীজ লুকায়িত আছে, তা লালন পালনের মাধ্যমে এই তত্ত্ব মেলে। এই সাধনা ছাড়া সূফী দরবেশ হওয়া যায় না । যেমন খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), গাওসুল আজম বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.), বাহউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.), মোজাদ্দেদ আল-ফেসানি (রহ.)-সহ সকল সাধকগণ নিজকে চেনার জন্য সারাজীবন রিয়াজত-সাধনারত ছিলেন। আমার মহান মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের চলমান জীবনেও দেখা যায় যে, তিনি জীবনের সুুদীর্ঘ ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে সাধনা করে যাচ্ছেন নিজেকে চেনা, সৃষ্টিলোকের রহস্য অনুসন্ধান ও মানব মুক্তির পন্থা খুঁজতে।

আমরা সবাই জানি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে হেরা গুহায় দীর্ঘ ১৫ বছর ধ্যান-সাধনা করেছেন। অত:পর তিনি মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। একাকি নির্জনতায় ধ্যান-সাধনারত অবস্থায় ওহীর  মাধ্যমে পবিত্র কোরআন নাযিল হয়। এই জগতে কোন আল্লাহর অলি-বন্ধু নিজকে চেনার সাধনা পূর্ণ না করা পর্যন্ত, সে পূর্ণাঙ্গ অলি হতে পারে নাই। এমন কি আল্লাহর দর্শনও মেলে নাই। যেমন হযরত বু-আলী শাহ্কলন্দর বলেছিলেন, ‘আমার মাজারে এসে, আমার কথা মত মোরাকাবা কর মাত্র একশত বিশ দিন, তারপর দেখ সত্যের দর্শন পাও কি না। যদি না পাও তবে দুই হাতে দুটি পাথর আমার মাজারে ছুড়ে মেরে বলিও কলন্দর মিথ্যুক। এই একশত বিশ দিনের সাধনায় তুমি কামেল হতে পারবে না সত্য। কিন্তু কামেলের কিছু কামেলিয়াতের রহস্য বুঝতে পারবে’।

মোরাকাবা বা ধ্যান-সাধনার বিষয়টি মানুষের পশুত্ব স্বভাবের পরিবর্তন ঘটায়। স্বভাবের ভালো দিকগুলো উন্মোচিত করে। যেমন করে ঝিনুকের খোলস খুললে মুক্তা মেলে। যতক্ষণ আপনি চোখ বুঝে কাল্বের দিকে খেয়াল করে আপন গুরুর শেখানো ‘ফাছ আন ফাছ’ অর্থাৎ আল্লাহর জিকির জারি করবেন, তখন স্বীয় চিত্তের পরিবর্তন সাধিত হবে। করাত দিয়ে কাঠ কেটে ফেললে এটি বিভক্ত হয়ে যায়, তেমনিভাবে জিকিরের মাধ্যমে অন্তরের ময়লা দূরীভূত হয়। এই ময়লা বলতে গৃহস্থলির আবর্জনা নয়, এ হচ্ছে মানুষের কু-রিপু অথবা খারাপ দিকগুলো। আল্লাহর নামে ডুবে থাকার জন্য জগতের অনেক মহা-সাধকগণ মানুষকে মোরাকাবার দীক্ষা দিয়েছেন। খাজাবাবা শাহ্ চন্দ্রপুরী (রহ.) বলেছেনÑ ‘মানুষ যতক্ষণ আল্লাহর নামের জিকিরে কাল্বে ডুবে থাকবে, সে ততক্ষণ সকল প্রকার পাপ থেকে দূরে থাকবে। কেননা অভিশপ্ত দুনিয়ায় গুনাহ থেকে একমাত্র বেঁচে থাকার উপায় হচ্ছে আপন রবের জিকিরে জিহ্বাকে সিক্ত রাখা’। কিন্তু কারো কারো অভিশপ্ত কারণে সে মুখ দিয়ে পরচর্চা বা পর নিন্দা করছে । সে কি জানে না গীবত করার শাস্তি হচ্ছে আপন মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়ার সমতুল্য পাপ। হাত পা নাক চোখ কান কোন অঙ্গই বসে নেইÑ সবগুলো গুনাহ্ করছে, কেন করছে? কেননা তাদের অন্তর বিশুদ্ধতা অর্জন করতে পারছে না। তৃষ্ণার খোরাক যেমন পানি, তেমনি আশেকের খোরাক মাশুক আর আত্মার খোরাক পরমাত্মা। কিন্তু এই জ্ঞান যে সবার মস্তিষ্কে ঢোকে না। নামি দামি বই মুখস্ত করে মস্তিষ্কের চাষ করলে মাওলানা, ক্বারি, ইসলামি চিন্তাবিদ হওয়া যায় সত্য। এমনকি দুই চারটা স্বর্ণ পদকও পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মার মধ্যে অবস্থিত সীনার এলেম মুখস্ত করে পাওয়া যায় না। আবার জোর করেও অর্জন করা সম্ভব নয়। এটা পীরের খাসলতে খাসলত ধরে অর্জন করতে হয়, আর যদি গুরু শিষ্যের মধ্যে কোনপ্রকার সন্দেহ থাকে, তবে কখনোই আত্মশুদ্ধি করে সীনার এলেম লাভ করা সম্ভব নয়। আর এ জ্ঞান যেন তেন জ্ঞান নয়, তরিকার ইমাম মোজাদ্দেদ আল ফেসানী (রহ.) বলেছেনÑ ‘আমার এই তরিকার মারেফতের জ্ঞান নবুয়তের তাক হতে গৃহীত, সকলের জন্য এই জ্ঞান উপনিত হয় না’ (মাকতুবাত শরিফ, পৃ:৫১, ১ম খ- ৩য় ভাগ)। যদি মারেফতের জ্ঞানের বই বাজারে পাওয়া যেত, তবে মানুষ বই কিনেও শেষ করতে পারতো না। কেননা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেনÑ ‘যদি সমগ্র পৃথিবীর গাছপালাকে লেখার কলম আর সমুদ্রের পানিকে কালি বানিয়ে আমার গুণাবলী প্রকাশ করা হয়, তবে লিখে শেষ করা যাবে না’। যেখানে কোরআনে এত বড় মারেফতের ঈঙ্গিত দেয়া হয়েছে, সেখানে মানুষ কিভাবে এই ধ্যান-সাধনা হতে নিজেকে দূরে রাখার চিন্তা করছে? এক্ষেত্রে আমাদের ধ্যান ধারণার কিছুটা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। হাদিসে মহানবী (সঃ) বলেনÑ ‘প্রত্যেক মানুষের সাথে একজন করে শয়তান দেয়া হয়েছে পরীক্ষা স্বরূপ। তার কাজ হচ্ছে মানুষকে বোকা বানিয়ে খারাপ কাজে লিপ্ত করা’। আমরা বেকার থাকতে পারি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে যে শয়তান আছে তারা তাদের ডিউটি ফেলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে না। তারা আমাকে ও আপনাকে সূক্ষ্ম কূ-বুদ্ধি দিয়ে গুনাহে লিপ্ত করবে, মানুষকে নিষ্পাপ বা পাপহীন থাকতে দিবে না। কিন্তু জগতের কেউই শিশুর মতো পবিত্র না হলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই নিজেকে চেনা ও জানার মাধ্যমে আপন পরিচয় মেলে। যেটা আমার খাজাবাবা কুতুববাগী বলেনÑ ‘যে চেনে তার নফ্সকে সে চেনে তার রবকে’। আত্ম মুক্তি সম্পর্কে মসনবীতে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে ঘটনাটি এমন, এক বণিক শখ করে ময়না পাখি পুষতো, পাখিটি পর্যাপ্ত খাবার পেত, কিন্তু স্বাধীন হবার তিব্র ইচ্ছায় সব সময় খাচার মধ্যে ছটফট করতো, মন খারাপ করে গান গাইতো। বণিক ব্যবসার উদ্দেশে বাহিরে যাওয়ার আগে সাধের পাখিটিকে জিজ্ঞাসা করল তোমার জন্য কি আনবো? ময়না পাখিটি বললো আমার মতো যাদেরকে তুমি পাবে, তাদেরকে বলবে আমি কি চাই? বণিক চলে গেল ব্যবসার উদ্দেশে। আর ফিরে আসার সময় গাছে ময়না পাখি দেখে তার নিজের পাখিটার কথা মনে পরলো, তখন গাছে থাকা পাখিটার কাছে নিজের ময়নার কথা খুলে বললো। কথা শোনার পর গাছের পাখি অচেতন হয়ে মাটিতে শুয়ে পরলো। বিষয়টি দেখে বণিক আশ্চর্য হয়ে গেল। বাড়িতে আসার পর ঘটনাটি ময়নাকে বলার পর সেও অচেতন হয়ে পড়ে রইলো। বণিক এই দৃশ্য দেখে শোকে কাতর হয়ে খাঁচা খুলে দিল । অমনি ফুরুৎ করে উড়ে গেল। ময়না তখন বললো বোকা বণিক আমি যাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম, তারাই তোমায় শিখিয়ে দিয়েছে কিভাবে আমার মুক্তি মিলবে। তাই গুরুর কাছে এসে আত্মশুদ্ধির সাথে সাথে আত্মারও মুক্তি মেলে।

সাধনার জগতে প্রবেশ করতে হলে আরও একটি কাজ হল ‘আমি’ কথাটির পরিবর্তন। তরিকার নিয়ম অনুযায়ী বাবাজান কেবলা শিখিয়েছেন আমি থেকে আমিত্ব সৃষ্টি হয়। তাই যত দ্রুত পারা যায় আমিত্ব ছাড়েন। কেননা আমিত্বের সাথে মধুত্বের মিল নেই বলে, খোদাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা একেবারেই শূণ্য। প্রকৃত পক্ষে আমিত্ব নিয়ে দেহরাজ্যে চলে যত যুদ্ধ। কারণ দেহ ক্ষেত্রই হচ্ছে প্রকৃত যুদ্ধ ক্ষেত্র। ইতিহাসে যত যুদ্ধের নাম শোনা যায় তার প্রধান কারণ ছিল লোভ ও হিংসা। নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চলে দেশজুড়ে ধ্বংসাত্বক কাজ, তাই কখনো কারো প্রকৃত বিজয় আসে না। আর দেহ ক্ষেত্রে মোহ-মায়া, অহংকার আমিত্ব দূর করার জন্য সাধকগণ দিন-রাত নিজের সাথে যুদ্ধ করছে। এটাই হচ্ছে সাধনার মূলমন্ত্র। কোন একদিন এক সাধকের নিকট তার ভক্ত এসে বললো ‘হে গুরু আমি সুখ চাই’। তিনি সুন্দর উত্তরে বললেন, সুখি হতে চাইলে ‘আমি’ ও ‘চাই’ শব্দ দুটি বাদ দিতে পারলে জগতে শ্রেষ্ঠ সুখি হতে পারবে। ‘আমি’ শব্দে আছে আমিত্ব আর ‘চাই’ শব্দে আছে মোহ। কিন্তু দেহরাজ্যে আমিত্ব বলে কোন কথা নেই। ‘আমি’ কথাটি কেবল স্রষ্টার মুখেই মানায়। তাই সূফী-দরবেশরা নিজেকে চেনা-জানা ও আমিত্ব ত্যাগের জন্য যুগ যুগ সাধনা করেছেন। নিজের মধ্যে সৃষ্টিকে ভুলে স্রষ্টাকে চেনার গোপন রহস্য অনুসন্ধান করেছেন। কেননা আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন- ‘আফি আন ফুসিকুম আফালা তুফছিরুন’। অর্থ: ‘হে বান্দা তুমি আমাকে খোঁজ না তাই পাওনা, আমি তালাশি বান্দার দিলের জানালা দিয়ে দেখা দিয়ে থাকি’। আত্মশুদ্ধি এলেই কু-নফসের মরণ ঘটে। নফসের মরণ ঘটলেই মানুষ মরার আগে মরে যায়। কেননা মানুষের মরণ একবারই হয়। মানব মুক্তিতে মানবের মনে প্রেম জাগে। মানব প্রেম জাগলেই অন্তরে খোদাপ্রাপ্তির অভিলাষ জাগে মনে। এ জগতে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যত ধর্ম রয়েছে সবারই প্রার্থনা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সকল ধর্মের নির্যাসে যে বিষয়টি এক, তা হল মানব প্রেম। প্রেমের পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যায় স্রষ্টার দরবারে। আশেক, মাশুককে খুঁজতে থাকে স্রষ্টার সকল মাখলুকাতে। তখন অনুভব করতে থাকে জগতের মোহ-মায়া সবই আপেক্ষিক, নশ্বর। এ সমস্ত মায়া ভুলে, ডুবে যায় মহান মাওলার প্রেমে। দর্শন দাও। দর্শন চাই। দিতেই হবে। হে মাবুদ মাওলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই প্রেমে মত্ত হয়ে নিজের সৌন্দর্য দেখার জন্য সমস্ত সৃষ্টি সৃজন করলেন এবং তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার জন্য মানবের মনে প্রবেশ করলেন। আল্লাহতায়ালা প্রেম ছাড়া কিছুই চান না, প্রেম হলেই কাজ হল। আর এমতাবস্থায় আশেক-মাশুক চলে যায় মহান মাওলার দিদারে। আর এই দর্শনই-তো সূফীবাদ শেখায়। সূফীবাদ বোঝা-বুঝির বিষয়, জানা-জানির বিষয়। তাই ধ্যান খেয়ালের সাধনা আপাতত অনেকের দৃষ্টিতে মূল্যহীন হলেও সূফীবাদের শিক্ষাই হল মানব মুক্তির একমাত্র পথ।

(Visited 3,817 times, 1 visits today)
Share