মুুর্শিদ কেবালার সান্নিধ্যে আত্মিক উপলব্ধি

নাসির আহমেদ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি

সূফীবাদে মুর্শিদ বা পরম গুরু এক অতীপ্রিয় জগতের অতুলণীয় মানব। সেই পরম গুরুর সান্নিধ্যে এলে বদলে যায় জীবনের চির চেনা দৃশ্যপট। মুর্শিদের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলতে পারলে বদলে যায় জীবনযাপনেরও অনেক রীতিনীতি। কামেল মুর্শিদ বা মহান গুরুর শাহাদাত আঙ্গুলির স্পর্শ কল্বে লাগামাত্র সচেতন মানুষের আরেক জনম ঘটে। সেই জনম অতীন্দ্রিয় জগৎ ভ্রমণের দুয়ার খুলে দেয়। কুতুববাগ দরবারের মহান আধ্যাত্মিক সাধক আমার মুর্শিদ খাজাবাবা আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী কেবলাজানের সান্নিধ্যে এসে, আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। একজন কামেল পীর বা মুর্শিদ যে জীবনযাপন করেন, তার প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যেই রয়েছে শিক্ষণীয় মহামূল্যবান রতœ, যা অনুসরণ করে যে কেউ আদর্শে, সততায়, মহত্বে, উদারতায়, বিনয়ে, ক্ষমায়, সর্বোপরি নিজের ভেতরের সমস্ত অহঙ্কার জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে সত্যিকারের মানবপ্রেমী হয়ে উঠতে পারে। তরিকতের যে শিক্ষা সেই শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান কথা হচ্ছে অহঙ্কার মুক্ত মানুষ হওয়া। সে কারণেই আমাদের মহান মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজান আদবের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যার মধ্যে আদব নেই, তার মধ্যে মানবিক গুণাবলী বিকশিত হতে পারে না। আর যার মধ্যে মানবিক গুণাবলী থাকে না সে কখনো পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না।

কুতুববাগ দরবারে এসে আমরা ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই অনেক কিছু অর্জন করেছি। কেউ বা কঠিন বিমারি থেকে খাজাবাবার দোয়া ও খাস তাওজ্জুহ পেয়ে মুক্তি পেয়েছি, কেউ বা বিপদ-আপদসহ নানারকম সঙ্কট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কেউ বা ঋণগ্রস্থ হয়ে এসেছিলেন, ঋণমুক্তি হয়ে জীবন চলার পথে সাফল্য অর্জন করেছেন। কিন্তু এইসব জাগতিক অর্জন নিয়ে কোন কথা বলতে এ নিবন্ধ লিখতে বসিনি। আমার বক্তব্য হল এই যে, খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের সান্নিধ্যে এসে আমাদের অনেকের জীবনে অন্যরকম পরিবর্তন এসেছে, যা শুধু উপলব্ধির বিষয়। ফুল যেমন চোখে দেখা যায় কিন্তু এর গন্ধ দেখা যায় না, তা চোখে দেখার জিনিসও না, শুধু উপলব্ধির জিনিস। উপলব্ধি তখনই হবে, যখন ঘ্রাণশক্তি নেয়ার ক্ষমতা থাকবে। যার ঘ্রাণশক্তি নেই, সে ফুলের উদ্যানে সারাক্ষণ ঘোরাফেরা করলেও ফুলের ঘ্রাণ পাবে না। তেমনই কেউ যদি খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, আর যদি তার মহামূল্যবান নসিহত-বাণী বা শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ না করেন, তা হলে তার অবস্থা হবে, ওই ফুলের উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো গন্ধকালা মানুষের মতোই। সে কোনদিনই মহৎ জীবনের ঘ্রাণ পাবে না।

গত প্রায় ১৭ বছরে বিচিত্র সব মানুষকে খাজাবাবার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতে দেখেছি। লাখ লাখ জাকের-মুরিদ খাজাবাবার কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু আমরা কজন তাঁর চরিত্রের সেইসব গুণ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি? যা আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইতস্তত হবো। কারণ, আমরা খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের মতো শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারিনি। আমরা নফস্ শয়তানের মোহ-মায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি। আমরা অনেকেই আত্ম অহমিকা ত্যাগ করতে পারিনি। অন্যের হক দখল করা, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্য মানুষকে কষ্ট দেয়ার মতো কু-প্রবৃত্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারিনি। কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসার পশুকে বন্দি করতে পারিনি। দড়ি ছেরা মাতাল ষাড়ের মতো ষড়রিপু আমাদের সমস্ত মানবিক গুণাবলী গ্রাস করে ফেলছে প্রতিনিয়ত।

খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের কাছে এসে দুনিয়াবি লাভ ক্ষতির হিসাব না কষে, যে স্বল্প সংখ্যক জাকের-মুরিদ ভাইবোন তাঁর মহান শিক্ষা অন্তরে ধারণ করতে পেরেছেন, তারাই শুদ্ধ মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছেন। খাজাবাবার শিক্ষা হচ্ছে শরিয়তের ছোট-বড় সকল আদেশ-নিষেধ সুষ্ঠুভাবে পালন করা, তবেই মারেফতের পথ সহজ হয়ে যাবে। এখানে এসেই জেনেছি, আমি যা জানি, তা এই মহা-বিশ্বের মহাপ্রভুর জ্ঞানের কাছে কিছুই না। আরও বহু কিছুু জানার বাকি। এই ছোট চক্ষু দিয়ে যত দূর দেখা যায়, তা-ই দেখা নয়। চোখ বন্ধ করলে যে সায়ের বা ভ্রমণ করা সম্ভব, তা আর কোনভাবে সম্ভব নয়। নিজেকে তুচ্ছ জানলে, যেমন আমি কিছুই জানিনা এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেই জ্ঞানের শূণ্য অন্তরে কিছু ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব। খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের কাছেই শিখতে পেরেছি যে, অল্প খাওয়া, অল্প ঘুমানো আর এবাদতেই সুস্থতা। হুজুরি দিলে কীভাবে নামাজ আদায় হয়, তা খাজাবাবার কাছে বাইয়াত না নিলে কোন দিনও জানা সম্ভব হতো কিনা জানি না। ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার যে মানবিক গুণÑ যা ছিল আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনের নিত্যসঙ্গী, সেই মানবিক গুণ আমাদের মহান মুর্শিদ কুতুববাগী কেবলাজানের মধ্যেই দৃশ্যমান। তিনি বৈষয়িক সম্পদ কি দিয়েছেন তা বলতে চাই নাÑ শুধু আত্মিক উন্নয়ন এবং নফসের কু-মন্ত্রণা থেকে বাঁচার যে শিক্ষা আমরা তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত লাভ করছি, তার কোন তুলনা নেই। অনাহারি মানুষ পেলে তাকে বা তাদেরকে খাবার দেওয়া, বস্ত্রের অভাব যার তাকে বস্ত্র দেওয়া, রুগ্ন মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া, সর্বোপরি ‘মানব সেবাই পরম ধর্ম’ এবং ‘সূফীবাদই শান্তির পথ।’ এই মহান শিক্ষা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। আমরা অনেকেই এক সাথে এসেছিলাম, যারা ছিলাম অনেকেই বে-নামাজি, কুুতুববাগ দরবারে এসে নামাজি হয়েছি। হুজুরি দিলে নামাজ আদায়ের শিক্ষা পেয়েছি। জিকির-আসকার এবং নিয়মিত ফরজ, সুন্নত, নফল আদায় করার যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, তা আমাদের অনেকেরই জীবন চিত্র পাল্টে দিয়েছে। আশাকরি যারা এই তরিকায় আসবেন তারা পরিপূর্ণ বিশ্বাসে, পরিপূর্ণ সমর্পনের মধ্য দিয়ে তরিকার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি এবং ইহকাল ও পরকালের প্রকৃত মঙ্গল অর্জন করবেন। আল্লাহ্ আমাদেও সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি, খাদেম কুতুববাগ দরবার শরীফ

(Visited 159 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *