মুর্শিদের হুকুম মুরিদের উন্নতির সোপান

মো: শাখাওয়াত হোসেন

পথহারা মানুষকে সঠিক পথে তুলে আনার জন্য, আল্লাহতায়া’লা পৃথিবীতে যুগে যুগে নবী রাসুলদেরকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা মহা শান্তিময় সত্যবাণীর আলোকে মিথ্যা দূর করে, মানুষের মধ্যে প্রেম আর সুশৃংখল সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সবাই জানি হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু সর্বশেষ নবী, নবীকূল শিরোমণি রাহমাতাল্লিল আলামিন, হযরত মুহাম্মদ (স:)-এর শুভাগমনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি করা হয়েছে নবুয়তির দরোজা। রাসুল (স:) বলেছেন, আনা খাতামূন নাবীইয়্যিন।’ অর্থাৎ : আমিই শেষ নবী, আমার পরে আর কোন নবীর আগমন হবে না।

এখন প্রশ্ন হলো নবুয়তির দরোজা বন্ধ হয়ে গেল, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহতায়া’লার সঠিক পথে চলার দিশা দিবেন কে, বা কারা? মহান স্রষ্টাকে ভুলে সৃষ্টির মোহে মশগুল থাকা পথভ্রষ্ট মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে কে ডেকে আনবেন, আল্লাহ-রাসুলের সত্য ইসলামের অমিয় শান্তির ছায়ায়? আল্লাহতায়া’লা নবুয়তির দরোজা বন্ধ করলেও অলি-আউলিয়াদের উপর তাঁর গুণাবলির দিব্যদৃষ্টি সর্বদা জারি রেখেছেন। অলি-আউলিয়াগণই কেয়ামত পর্যন্ত পবিত্র কোরআনের দুইরকম শিক্ষা জাহেরী ও বাতেনী, এই শিক্ষার কল্যাণকর পথে তাঁরা আহ্বান করবেন। এই আলামত যাঁদের মধ্যে পুরোপুরি বিদ্যমান, তাঁরাই হলেন জমানার পথপ্রদর্শক, সত্যপথের সন্ধানদাতা। আল্লাহতায়া’লা পৃথিবীতে চল্লিশ প্রকারের অলি-বন্ধু পাঠিয়ে থাকেন এবং তাঁদেরকে ভিন্ন ভিন্ন্ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দান করেন।

এই অলিগণের মধ্যে হাদি শ্রেণির অলিদের কাজ সংস্কার করা। মানুষকে আল্লাহতায়া’লার পথে আনা এবং আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তাঁরা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নিয়ম-নীতি, আদেশ ও নির্দেশিত শিক্ষা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে সত্যিকারের মানুষ হতে সাহায্য করেন। যাঁদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন শুধু তাঁরাই হাদি শ্রেণীর অলির দেখা পাবেন। অনেকে আছেন যাঁরা হয়তো না জেনে, না বুঝে নায়েবে নবী, অলি-আল্লাহ-পীর-ফকিরদের ব্যাপারে ভুল ধারণা করেন। তাই তো তাঁদের প্রতি পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়া’লা বলেছেনÑ ‘ওয়ামাই ইউদলিল্ ফালান তাজিদা লাহু আলিয়্যাম মুরশীদা।’ অর্থাৎ যারা পদভ্রষ্ট, তারা কখনও ম্ুির্শদ বা পীর পাবে না। সুতরাং পবিত্র কোরআনের বর্ণনা মতেÑ যাদের ভাগ্য ভালো, শুধু তারাই কামেল মুর্শিদের কৃপা-দৃষ্টি পাবেন। মুর্শিদের শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে, তাঁর নির্দেশিত পথে নিজের জীবনকে পরিচালনা করতে পারলে, আত্মাকে পবিত্র করা যায় এবং আত্মাকে পবিত্র করতে পারলেই আল্লাহ ও রাসুল (স:)এর দেখা মিলে।

আমি গোনাহ্গারের মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী ক্বেবলাজান হুজুরের সন্ধান পাওয়ার আগে, নিজের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা ছিল। যেগুলো ক্বেবলাজানের দরবারে আসার পরে বুঝতে পেরেছি এবং ভুলগুলো সংশোধনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। রাসুল (স:) বলেছেনÑ আস্ শায়েখু ফি কাওমিহী কান নাবীই ফি উম্মাতি।’ অর্থাৎ তোমাদের কওমে যে সাহেবে দাওয়াত পাও, তাঁকে আমি নবী তুল্য মনে কর। অর্থাৎ রাসুলের জমানায় তাঁর সাহাবিরা যেমন করে রাসুল (স:)-এর কথা মান্য করেছেন, ভালোবেসেছেন। তেমনি তোমরাও তোমাদের মুর্শিদ বা পীরের আদেশ-নিষেধ মান্য কর এবং ভালোবাসো। কামেল মুর্শিদের হুকুমের মধ্যেই রয়েছে মুরিদের রহমত-বরকত। যদিও তরিকতের বাহিরে থেকে কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা তা বুঝতে পারি না।

সম্মানিত পাঠক, এখানে আমি একটি বাস্তব ঘটনার উদাহরণ দিলে, আমার এই লেখার যে শিরোনাম তার মর্ম কথা খুব সহজে বুঝতে পারবেন। আর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভার এখন আপনাদের হাতে। আমাদের এক জাকের ভাই ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ ভালো আলাপ পরিচয় আছে। তিনি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। হঠাৎ চাকরি চলে যায়। তাঁর স্ত্রীকে চট্টগ্রামে শ্বশুর বাড়িতে রেখে তিনি দরবার শরীফে আসলেন এবং ক্বেবলাজানের কাছে দরবার শরীফে অবস্থানের অনুমতি চাইলেন। ক্বেবলাজান তাঁকে অবস্থানের অনুমতি দিয়ে দরবারে খেদমতে থাকতে বললেন। তখন দরবার শরীফে মহাপবিত্র ওরছ ও বিশ্বজাকের ইজতেমা ২০১৪ এর পুরোদমে আয়োজন চলছে। তিনি আমাদের সঙ্গে মনপ্রাণ দিয়ে খেদমত করতে লাগলেন।

১৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার ওরছ শরীফ শেষ হলো। জাকেরকর্মী ভাইজানেরা অনেকে বাবাজানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাড়িঘরে গেছেন কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল ইসলাম ভাই গেলেন না। এর বেশ কয়েকদিন পর হঠাৎ এক রাতে নয়টা সাড়ে নয়টা বাজে, তখন বাবাজান তাঁকে ডেকে বললেন, বাবা, আপনাকে ছুটি দিলাম। এক্ষুনি আপনি বাড়ি চলে যান। ক্বেবলাজানের হুকুম পেয়ে তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন এবং মনে মনে চিন্তা করলেন, আমার নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে, তাই বাবাজান আমাকে দরবার শরীফ থেকে এই মুহূর্তে বাড়ি চলে যেতে বললেন। ঘটনার সময় আমি গুনাহ্গার সেখানে উপস্থিত ছিলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পীরের হুকুম মাথায় নিয়ে তিনি ওই রাতেই সরাসরি চট্টগ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়ি চলে গেলেন।

বাড়িতে ঢোকার আগেই বাহিরে দেখতে পেলেন অনেক লোকজন। কিছুই বুঝতে পারলেন না ব্যাপার কি। বাড়ির ভিতরে ঢুকে বুঝলেন কারো বিয়ের আয়োজন চলছে। তাঁকে দেখে সবাই জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোত্থেকে এসেছো? স্ত্রীর বড় ভাই বললো, আমার বোনকে কোন বেকার ছেলের কাছে আর দিব না। তাই বিয়ে দিচ্ছি। তুমি চলে যাও। নিজের স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছে দেখে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! উপস্থিত মেহমান ও লোকজনের জটলা তৈরি হল। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আসলেন। তাঁদের কাছে ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার ভাইজান বললেন, আমার স্ত্রী যদি আমার সঙ্গে থাকতে না চায়, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। তাঁর স্ত্রীকে ডাকা হল, তিনি বললেন, আমার অমতে অন্যত্র বিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার ভাইজান বললেনÑ আমি শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে কয়েক লাখ টাকা পাই। সেই টাকা আত্মসাৎ করার জন্যেই জোর করে আমার স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই ঘটনার সত্যতা জানার পর ওই পরিবারের কাছ থেকে তাঁর পাওনা টাকা আদায় করে স্ত্রীকে সঙ্গে দিয়ে দিলেন। তিনি ওখান থেকে নিজের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে গেলেন এবং ওই টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। বর্তমানে মুর্শিদ ক্বেবলাজান খাজাবাবা কুতুববাগীর দোয়ার বরকতে তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে আছেন। মোবাইল ফোনে তাঁর মুখে এই ঘটনা শুনে আমি বুঝতে পারলাম, ক্বেবলাজান হুজুর কেনো সেদিন তাঁকে হঠাৎ ছুটি দিয়েছিলেন। শ্বশুর বাড়ি পৌঁছাতে যদি আর মাত্র কয়েক ঘন্টা দেরি হতো, তাহলে কত বড় একটা অঘটন ঘটে যেতে বসেছিল।

ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল ইসলাম ভাইজানের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন সত্য ঘটনার মধ্য দিয়েও বুঝা যায় যে, সুফিদের প্রতিটি নির্দেশের মধ্যেই মুরিদের জাহেরি ও বাতেনি উন্নতির ইঙ্গিত নিহিত থাকে। আল্লাহ তাঁর অলি-বন্ধুদেরকে পবিত্র কোরআনের দুই প্রকার এল্মে জাহের (প্রকাশ্য) ও বাতেন (গোপন) দান করেছেন। যার মাধ্যমে তাঁরা হন দিব্যজ্ঞানী। দিব্যদৃষ্টি দিয়ে তাঁরা মানুষের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেখতে পান এবং সবকিছুর বিষয়ে অসীম জ্ঞান রাখেন। তাঁর মুরিদ-সন্তানদের শরিয়ত ও মারেফতের শিক্ষায় শিক্ষিত করে সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ মানুষে পরিণত করেন।

(Visited 612 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *