আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী
মুজাদ্দিদ উপাধি লাভ : ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদ আলফেসানী হযরত শায়খ আহমদ শেরহিন্দী (রহ.) স্বীয় মুর্শিদ হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ (রহ.)-এর নিকট থেকে নকশবন্দিয়া তরিকার খাস নেসবত লাভ করার পর, তাঁর নির্দেশে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিপূর্বেই তাঁর সুখ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পেয়ে চারদিক থেকে দলে দলে লোক তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে বাইয়াত হতে থাকে। এই সময় একদিন তিনি স্বীয় হুজরার মধ্যে ফজরের নামাজের পর মোরাকাবায় মশগুল আছেন। এমন সময় হযরত রসুলেপাক (সঃ) রূহানীভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশতা এবং আউলিয়া ও গাউস কুতুবদের সঙ্গে নিয়া সেখানে তাশরীফ আনেন এবং নিজ হাতে তাঁকে একটি অমূল্য খিলআত (অর্থাৎ, স্বীয় প্রতিনিধিত্বের প্রতীকস্বরূপ এক বিশেষ পোশাক) পরিয়ে দেন এবং বলেন, ‘শায়খ আহমদ মুজাদ্দিদের প্রতীকস্বরূপ আমি তোমাকে এই ‘খিলআত’ পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের জন্য তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। আমার উম্মতের দ্বীন-দুনিয়া তথা ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার ওপর ন্যস্ত করা হল’। এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল মাসে শুক্রবার ফজরের নামাজের সময় সংঘটিত হয়। আম্বিয়াগণ সাধারণত যে বয়সে পয়গম্বরী লাভ করতেন, সেই বয়সে। অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়সেই হযরত শায়খ আহমদ শেরহিন্দী (রহ.) ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিতে ভূষিত হন। এই ঘটনার দ্বারা এ কথাই প্রমাণ হয় যে, নবীসুলভ দায়িত্বের বোঝা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁরই উপর সোপর্দ করেন।
মুজাদ্দিদ কাকে বলে : মুজাদ্দিদ আরবী শব্দ। এর অর্থ সংস্কারক। মানুষ যখন ধর্মবিমুখ হয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ও শয়তানের পায়রবী শুরু করে, জাতীয় ও নৈতিক জীবন যখন হয় কলুষিত, তখন তাদের হেদায়েত করার প্রয়োজনে তথা গোমরাহীর অতল থেকে তাদেরকে টেনে তুলে, সত্য ও আদর্শের রাজপথে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে, আল্লাহতায়ালা বিশেষ দায়িত্ব সহকারে তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এটাই চিরন্তন রীতি। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে নবী রসুলদের আবির্ভাব হয়েছে। তাঁরা সবাই পথহারা বিভ্রান্ত মানুষদেরকে সত্য পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। নবুয়তের ধারা যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন নবীচরিত্রের যাবতীয় গুণাবলীর অধিকার দিয়ে নায়েবে নবীদের উপর সেই মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়।
সত্য-দ্বীনের অনুসারী হক্কানি আলেম-ওলামা কামেল-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদ দরবেশগণ সকলেই নবীর নায়েব রূপে মানব জাতিকে হেদায়েত করেন। কিন্তু ‘মুজাদ্দিদ’ পদটি অন্য সমস্ত উপাধি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ। কাউকে মুজাদ্দিদরূপে বরণ করার অর্থই হল, এলেম ও আখলাক উভয় ক্ষেত্রে তাঁরা অনন্য-সাধারণ মহত্ত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। ধর্মের সংস্কারসাধন মূলত: নবীদের কাজ এবং এই কাজ কেবলমাত্র তাঁরাই করতে পারেন, যাঁরা আখলাককে নবীর বা নবীচরিত্রের জীবন্ত প্রতীক এবং দ্বীনের সংস্কার বা ধর্মের প্রকৃত রূপায়নের কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার মত পরিপূর্র্ণ যোগ্যতার অধিকারী। যে কোন ব্যক্তি নিজের চেষ্টা ও সাধনা বলে বড় আলেম বা কামেল হতে পারেন এবং দলীয় লোকদের সমর্থন-পুষ্ট হয়ে কোন বড় পদের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু নবুয়ত যেমন স্বীয় চেষ্টা ও সাধনা বা দলীয় সমর্থন দ্বারা লাভ করা সম্ভব হয়নি, অনুরূপভাবে ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিও লাভ করা সম্ভব নয়। নবুয়ত যেমন আল্লাহতায়ালার একটি বিশেষ দায়িত্ব প্রদান, তেমনই ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধি প্রদানও তাঁর আর একটি বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহতায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন, তিনিই কেবল এই মহান পদের অধিকারী হতে পারেন। কারও পক্ষে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই পদে উন্নীত হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই সাধারণ হাদী বা পথপ্রদর্শক আর ‘মুজাদ্দিদ’ এক কথা নয়। বরং উভয় পদবীর মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান নিহিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের আবির্ভাব সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে ‘বেসাত’ শব্দ প্রয়োগ করেছেন, যার অর্থ ‘প্রেরণ’।
যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন,
‘হু-আল্লাজি বা’য়াছা ফিল উম্মিইনা রাসূলাম মিনহুম’।
অর্থ : তিনি সেই মহান স্রষ্টা, যিনি নিরক্ষর লোকদের নিকট তাদের মধ্য থেকেই একজন রসুলকে প্রেরণ করেছেন।
‘অ-মাকুন্না মুয়াজ্জিবিনা হাত্তা ইয়াব আছা রাসূলা’।
অর্থ : আমি কখনও আযাব দিই না, যতক্ষণ না আমি তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করি।
‘বা-আছনা ইলাইহিম রাসূলা’।
অর্থ : আমি তাদের নিকট রসুল প্রেরণ করেছিলাম’।
এখানে একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, ইসলামের পরিভাষা অনুযায়ী ‘বেসাত’ শব্দটি দেখলেই বোঝা যায়, এখানে কোন নবীর আবির্ভাব সর্ম্পকে বলা হয়েছে। অতএব, এই শব্দটি নবুয়তের জন্য খাস বা নির্দিষ্ট। এত্বদীয় হাদিস শরীফে ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধির ক্ষেত্রেও ‘বেসাত’ শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে।
যেমন, হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন,
‘ইন্নাল্লাহা ইয়াব-য়া’ছু লিহা-জিহিল উম্মাতি আলা-রা’ছিন কুল্লা মিয়াতি ছানাতিম মিন মাই-ইউজাদ্দিদু-লাহা আমরি দিনিহা’
অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা এই উম্মতের হেদায়েতের জন্য প্রতি শতাব্দীতে এমন এক মহান পুরুষকে প্রেরণ করেন, যিনি তার যুগে দ্বীনের সংস্কারক হবেন।
‘বেসাত’ শব্দটি নবুয়তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ উপরোক্ত হাদিসে মুজাদ্দিদ সম্পর্কেও এই একই পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে। অতএব, একথা সুস্পষ্ট যে, নবুয়ত ও মুজাদ্দিদিয়াত এই উভয় পদের মনোনয়ন একমাত্র আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। তফাৎ এতোটুকুই যে, নবুয়ত হলো আসল বা মূল বৃক্ষ আর মুজাদ্দিদিয়াত হলো এর প্রতিবিম্ব বা ছায়া। নবীর প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত, কোরআনের ভাষায় যাকে ওহী বলা হয়েছে, তা চূড়ান্ত ও ধ্রুব সত্য, আর মুজাদ্দিদের ইলহাম ও তার নিকটবর্তী সত্য এবং নবীর ইলহামের পরিপন্থী না হলে তা-ও ধ্রুব সত্য।
‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিটি যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা হযরত শায়খ আহমদ শেরহিন্দী (রহ.)-এর নিজের একটি উক্তি থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, আমার ওপর মুজাদ্দিদিয়াত বা সংস্কারকের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। শুধু পীর-মুরিদি করার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়নি। মুরিদগণকে মারেফতের তালিম বা শিক্ষা দেওয়া আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। যে মহান দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে, তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা এবং আমার কর্মক্ষেত্রও সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। আমার ওপর অপির্ত কার্যের তুলনায় মুরিদানকে তরিকতের তালিম দেওয়া এবং সাধারণ মানুুষকে কামেলিয়াতের দরজায় পৌছানো, রাস্তা থেকে কুড়ানো তুচ্ছ জিনিসের মতোই।