মানুষের জীবদ্ধশায় কামেল মুর্শিদের প্রয়োজনীয়তা

মৌলানা শামশুল আলম আজমী

মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা, জ্ঞানের প্রাচুর্য, বংশ মর্যাদা ও শক্তি সামর্থ এগুলোই শুধু মানুষের ঈমান ও আক্বীদার গ্যারান্টি হতে পারে না। কামেল মোকাম্মেল পীরের সান্নিধ্য ছাড়া ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা ক্ষীণ। পীরে কামেলের তাওয়াজ্জু ও রূহানী নজর দ্বারা মুরিদের ঈমান আক্বিদা রক্ষা করার জন্য শয়তানের মোকাবিলা সহজতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হয়। হুজ্জতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রহ.) পীর ও মুর্শিদের গুরুত্ব বর্ণনা করে ‘আইয়ুহাল ওয়ালাদু’ নামক পুস্তিকায় বলেনÑ ‘মুরিদের পথ প্রদর্শন ও শিক্ষার জন্য একজন মুর্শিদে কামিল এর প্রয়োজন হয়। যিনি মুরিদের অন্তর থেকে মন্দ চরিত্রের মূলোৎপাটন করে সৎচরিত্রের বীজ বপন করেন। একজন প্রকৃত পীরের দীক্ষাকে কৃষকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। একজন কৃষক তার ক্ষেত থেকে যেমন অবাঞ্ছিত চারা ও আগাছা উপড়ে ফেলেন। যাতে করে ফসল যথাযথভাবে অর্জিত হয়।’ অনুরূপ মুর্শিদে কামিল তাঁর সত্য তরিকার নিয়মে সরল শিক্ষা পদ্ধতিতে তাঁর মুরিদকে দীক্ষার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়া’লার সান্নিধ্য গ্রহণে যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মহানবী (সঃ) সাহাবায়ে কেরামকে, ছাহাবীগণ- তাবেঈনদেরকে- তাঁরা, তাবে তাবেঈনদেরকে। এভাবেই আদি যুগ-যুগান্তর ধরে এখন পর্যন্ত ওই পদ্ধতিই অনুসৃত হচ্ছে, কালকেয়ামত পর্যন্ত চলতেই থাকবে, শরিয়ত এবং মারেফতের এই ধারক ও বাহক প্রক্রিয়া।

মুর্শিদে কামিলের মর্যাদা : শেখ আবদুল গনি নাবলুসীÑ ‘আলহাদিকাতুন নাদিয়াহ’তে হযরত দাতাগঞ্জ বখশ হাজভিরী লাহুরী (রহ.) ‘কাশফুল মাহজুব’ এ মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) ‘মিরকাতুল মাফাতীহ-এ এবং আলা হযরত মুজাদ্দিদে মিল্লাত (রহ.) ফতোয়ায়ে রেজভিয়াতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘আশ শাইখু ফী ক্বওমিহী কান নাবিয়ি ফী উম্মতিহি’। অর্থাৎ মুর্শিদ তথা পীরের মর্যাদা তাঁর মুরিদ তথা সগোত্রে এমন বিবেচিত হওয়া চাই, যেমন উম্মতের কাছে দয়াল নবীজির মর্যাদা। তেমনই মুর্শিদের প্রতি মুরিদের ভক্তি, বিশ্বাস, ভালোবাসা ও মর্যাদা থাকা উচিত। যিনি হবেন শেষ নিদানের প্রত্যক্ষ উসিলা। তাই তাঁর প্রতিটি আদেশ নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়, তবেই মুরিদের জন্য নাজাত এবং চির শান্তির পথ সুগম হয়।
মুরিদ এর বৈশিষ্ট্য : পীর যদি নবীজির স্থলাভিষিক্ত হন, তাহলে, মুরিদগণের সঙ্গে উম্মতের তুলনা অযৌক্তিক হবে না! তাই বলতে হয় যে, মহা নবী (সঃ)-এর সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামদের যেমন নিবিড় সম্পর্ক ছিল, মুরিদ তার পীরের সঙ্গে তেমনই সম্পর্ক রাখবে। বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা সাপেক্ষে হওয়া সত্বেও সংক্ষেপে বলতে গেলে, নিজের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু পীরের জন্য উৎসর্গ করা। পীরের সান্নিধ্যকে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি মনে করা। পীরের আদেশ নির্দেশ মেনে চলা। মুরিদের ওপর পীরের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা ও জীবনের সব ক্ষেত্রে পীরকে অনুসরণ করে মহান আল্লাহ ও রাসুল (সঃ) এর সন্তুষ্টি অর্জন করাই মুরিদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।

পীরের জন্য নূন্যতম যোগ্যতা : ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তরিকতের ধারাবহিকতা মূলত; মহা নবী (সঃ) পর্যন্ত একজন মুসলমানকে পৌঁছে দেয়ার স্বীকৃত ও অনুমোদিত কর্ম পদ্ধতি। এ কাজে দায়িত্ব পালনকারীগণ পীর তথা শাইখ উপাধিতে উপনীত হন। তার মনোনীত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি খলিফা এবং অনুসরণকারীগণ মুরিদ। এই দায়িত্বে যিনি নিয়জিত থাকেন তিনিই তাসাউফ ও তরিকতের পরিভাষায় পীর তথা শাইখ নামে পরিচিতি লাভ করেন। এ মহান কাজের দায়িত্ব পালনের জন্য নূন্যতম কিছু যোগ্যতা থাকা অপরিহার্য। অযোগ্য ব্যক্তিকে মহান গুরুত্বপূর্ণ এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে বা এ পদে আসীন হলে প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। আ’লা হযরত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ্ আহমদ রেজা খান ব্রেলভী (রহ.) তাঁর রচিত বিশ্ব বরেণ্য ফতোয়ার কিতাব ফতোয়া এ রেজভীয়াতে পীরের জন্য নূন্যতম চারটি শর্ত বর্ণনা করেছেন। এ চারটি শর্তের মধ্যে একটির অভাব হলে তিনি ইসলামী শরিয়ত মতে পীর হিসেবে বিবেচিত হবেন না। শর্তসমূহ নিম্নে বর্ণিত হলো।

সঠিক ধারাবাহিকতা : দায়িত্বপ্রাপ্ত পীর-মুর্শিদ থেকে আরম্ভ করে তাঁর পূর্ববর্তী পীর ও মুর্শিদগণের ধারাবাহিকতা সঠিক পদ্ধতিতে মহা নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) পর্যন্ত যথাযথভাবে পোঁছানো। এ ধারাবাহিকতার কোন স্তরে কোন ব্যক্তি বাদ পড়লে, অযোগ্য বলে বিবেচিত হলে, বাতিল স্বীকৃত হলে অথবা অন্য কোন গ্রহণ যোগ্য আপত্তি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পীর বলা যাবে না। তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করাও শরিয়ত সম্মত হবে না। এ কারণে তরিকতপন্থীদের কাছে তাদের সিলসিলার ‘শাজরা’ তথা পীরের ধারাবাহিক বর্ণনা সম্বলিত দলিল গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়।
সুন্নি আক্বিদায় বিশ্বাসী হওয়া : পীর হওয়ার জন্য নূন্যতম যোগ্যতার দ্বিতীয় শর্ত হলো, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদায় বিশ্বাসী হতে হবে। সঠিক আক্বিদা যদি পীরের না থাকে তাহলে তিনি মুরিদদের আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম তো হবেনই না, পক্ষান্তরে শয়তানী তথা তাগুতী পথে পরিচালিত করবে নিজের মুরিদ ও ভক্তদের। এ জন্যই বলা হয়েছেÑ ‘ইযা কানাল গুরাবু দলিলা কওমিন-চা ইয়াহদীহিমইলা বাইতিল খালায়ী’। অর্থাৎ কাক যদি কোন জাতির পথ প্রদর্শক হয় তাদেরকে অবশ্যই আবর্জনার দিকে পথ প্রদর্শন করবে।’ তাছাড়া সঠিক আক্বিদায় বিশ্বাস স্থাপন করে আত্মার দুর্বলতা দূর করে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার ব্রত নিয়েই একজন মুসলমান একজন কামিল পীরের সন্ধান করেন। পীর নিজে যদি ভ্রান্ত আক্বিদায় বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে তিনি কীভাবে নিজের মুরিদকে হেদায়েত করে আলোকিত পথের সন্ধান দেবেন? আলা হযরতের মতে ভ্রান্ত আক্বিদায় বিশ্বাসীর হাতে বাইয়াত হওয়া তো দূরের কথা কোন ভ্রান্ত আক্বিদার লোকের কাছে লেখাপড়া করা, তাকে সালাম কালাম করা তার সঙ্গে আত্মীয়তা করা এবং তাদের কাছে যাতায়াত করাও হারাম।

আলেম হওয়া : পীরের নূন্যতম যোগ্যতার তৃতীয় শর্ত হলো, তাঁকে একজন পরিপূর্ণ আলেম হতে হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে, একজন পীর হওয়ার জন্য সর্ব নিম্ন ইসলামী লিয়াকত তথা শিক্ষাগত যোগ্যতা হলো নিজের জীবনে দৈনন্দিন যেসব জ্ঞানের প্রয়োজন এবং ফিকাহ শাস্ত্রের জ্ঞান থাকতে হবে। হালাল, হারাম, মাকরূহ, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, ও মুবাহ বিষয়ে পরিপর্ণ ওয়াকিবহাল হতে হবে। আকাঈদে আহলে সুন্নতের বিস্তারিত জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। কুফরী, ভ্রান্তি বনাম ইসলাম ও হেদায়েত এর জ্ঞান থাকতে হবে। এ কথা দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, কোন মূর্খ বা শুধু শরিয়তের জ্ঞানে জ্ঞানী এমন ব্যক্তি কখনোই পীর হতে পারবে না। ফারসীতে একটা কথা আছেÑ ‘খোফতারা খোফতা কয় কুনদ বেদার’। অর্থাৎ একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি অন্য আরেকজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে কীভাবে জাগাবে? যে নিজেই মূর্খ, যার কাছে শরিয়তের জ্ঞান নেই, তরিকতের বিষয়ে যে কিছুই জানে না তার পক্ষে একজন মুসলমানের হেদায়েত ও দীক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ কীভাবে সম্ভব?

প্রকাশ্য ফাসেক না হওয়া : ইসলামী শরিয়তের বিবেচনায় যেসমস্ত কাজ-কর্ম গুনাহ তথা পাপ হিসেবে স্বীকৃত, সেসব কাজে প্রকাশ্যে যিনি লিপ্ত হন তিনি পীর হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। পাপকে ঘৃনা করা এবং পুণ্যকে সম্মান করা মুসলমানের কর্তব্য। পক্ষান্তরে কামেল পীরকে সম্মান প্রদর্শন করাও মুরিদের কর্তব্য।
গুণাবলী : উপরোল্লিখিত প্রধান চারটি শর্ত একজন পীরের নূন্যতম যোগ্যতার জন্য বর্ণিত হলেও প্রকৃত পক্ষে মুর্শিদে কামিলের জন্য যেসব গুণাবলী থঅকা প্রয়োজন, তা বর্ণনা করতে গিয়ে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রহ.) উল্লেখ করেনÑ একজন পীর মানে তিনি নবী (সঃ)-এর স্থালাভিষিক। তাঁর জন্য প্রথম গুণ হলো তিনি আলেমে শরিয়ত হবেন। কিন্তু এখঅনে মনে রাখতে হবে যে, সব আলেম পীরে কামেল হতে পারেন না। পীরে কামেল যিনি হবেন তিনি আলেম হওয়ার পাশাপশি নিম্ন লিখিত গুণে গুণান্বিত হতে হবে।

(১) পার্থিব ইজ্জত সম্মান ও পদ মর্যাদার চাহিদা না থাকা। (২) নিজে এমন পীরের মুরিদ হবেন যিনি বাতেনী নূরে আলোকিত। (৩) তার সিলসিলা মহা নবী (সঃ) পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। (৪) তিনি সবসময় সৎকাজে অভ্যস্থ হবেন। (৫) তাঁকে আধ্যাত্মিক সাধনায় অভ্যস্থ থাকতে হবে। (৬) পানাহার কম করবেন। (৭) কম ঘুমাবেন। (৮) কম কথা বলবেন। (৯) অধিক নফল ইবাদত করবেন। (১০) অধিকাংশ সময় রোজা রাখবেন। (১১) মুক্তহস্তে অধিক পরিমাণে দান খয়রাতে অভ্যস্থ হবেন। (১২) নিজের কামেল পীরের অনুসরণে থাকবেন। (১৩) শোকর, ছবর, তাওয়াক্কুল, দানশীলতা, দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস, স্বস্তি, সহনশীলতা, বিনয়ী, প্রজ্ঞা, সততা, অঙ্গিকার রক্ষা, লজ্জা বোধ, আত্ম সম্মানবোধ ইত্যাদি গুনে গুণী হবেন।
পীর যখন উল্লেখিত গুনে গুণান্বিত হন তখন তিনি সকল নূরের মূল উৎস নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নূরের প্রতিবিম্ব আকারে আত্ম প্রকাশ করতে পারেন। এমন নূরানী প্রতীকের বাইয়াত গ্রহণ করলেই কেবল মুরীদের মধ্যে সেই নূর প্রতিফলিত হয়। মুরিদও প্রকৃত নূরের সান্নিধ্যে আসায় তার জীবন আলোকিত করতে পারেন। আর তখনই একজন মুরিদ মন্জিলে মকছুদে পৌঁছাতে সক্ষম হন। পীর ও মুরিদ উভয়ই আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর প্রিয় বলে বিবেচিত হন।

উল্লেখিত সকল গুণাবলীর চেয়ে আরো কোটি কোটি গুণের অধিকারী আমার প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগী (মা:জি:আ:) কেবলাজান। তাই বিশেষ করে সারাবিশ্বের সম্মানিত আলেম সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, আপনারা একবার হলেও খাজাবাবা কুতুববাগীর দরবার শরীফে (৩৪ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা।) এসে তাঁর নূরানী, ইমামী, রূহানী ও ইরফানী চেহারা মোবারক দর্শন করুন। এই দর্শনে আপনার চক্ষু, মন, শরীর শীতল হবে। তখন বুঝতে পারবেন আমার এই ক্ষুদ্র লেখার সত্যতা।

লেখক : মৌলানা শামশুল আলম আজমী, কক্সবাজার

(Visited 859 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *