(রাওয়াহু বোখারি ও মুসলিম)
আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী
তাসাউফের প্রথম স্তর হলো তওবা। জীবনের সমস্ত পাপ হতে তওবা করে একজন কামেল মোর্শেদ বা সৎ গুরুর হাতে হাত দিয়ে তাসাউফে প্রবেশ করতে হয়। পাপ করে অনুশোচনা করে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনার নাম হলো তওবা। তওবা দুই প্রকার। জাহেরি তওবা ও বাতেনি তওবা। বাতেনি তওবা হলো, পাপ কাজ না করার অঙ্গীকার। আর জাহেরি তওবা হলো, নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পাপ কাজ হতে দূরে রাখা। বাতেনি তওবাটাই আসল তওবা। কারণ, মন থেকে তওবার নিয়ত না করলে তা কোনোদিনও বাস্তবায়ন হবে না। মন আগে মসজিদের দিকে যায়। তারপর মানুষ মসজিদে যায়। মন আগে নামাজের দিকে যায়। তারপর মানুষ নামাজ পড়ে। মন আগে অজু করার দিকে যায়। তারপর মানুষ অজু করে। তাই বাতেনি তওবা না করলে কোনোদিনই জাহেরি তওবা বাস্তবায়ন হবে না। বাতেনি তওবা যার যতবেশি শক্তিশালী, সে ততবেশি কাজে অগ্রশীল। আল্লাহ বলেন, ‘তূবূ ইলাল্লাহি তাওবাতান নাসূহা।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত-৮) অর্থ : তোমরা খাস তওবা করো। (নাসুহার মতো) তওবা সম্পর্কে নাসুহার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। নাসুহা একজন পুরুষ লোক ছিল। কিন্তু সে মেয়ে সেজে বাদশাহর মেয়েকে গোসলের কাজে নিয়োজিত ছিল। বাদশাহর মেয়েকে নিজ হাতে গোসল করাইতো। বাদশাহ, রাজকন্যা এমনকি রাজদরবারে কেউই জানতো না যে, নাসুহা একজন পুরুষ লোক। সবাই তাকে মেয়ে লোক হিসেবে জানতো। একদিন বাদশাহর মেয়ের গলার অলংকার হারিয়ে গেছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্ত দাস-দাসীদেরকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। আর মাত্র একটি লোক বাকি আছে। তাকে তল্লাশি করার পর নাসুহাকে তল্লাশি করা হবে। নাসুহা এখন গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। হায় রে, আমাকে যদি তল্লাশি করা হয়, তাহলে আমি যে পুরুষ, তা প্রমাণ হয়ে যাবে বা প্রকাশ হয়ে যাবে। রাজকন্যাকে একজন পুরুষ গোসল করিয়েছে, এ অপরাধে আমার মৃত্যুদন্ড হবে। এ কথা ভেবে নাসুহা হত্যার ভয়ে জীবনের ভয়ে মহান আল্লাহর কাছে মনে মনে খালেস তওবা করতে লাগলো। মাবুদ আমি একজন পুরুষ হয়ে বাদশাহর মেয়েকে গোসল করার দায়িত্ব নিয়ে যে পাপ করেছি, জীবনে আমি আর কোনোদিনও এ পাপ কাজ করবো না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। নাসুহার তওবা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে গেল। তাকে তল্লাশি করবে এমন সময় একটি পাখি গলার অলংকারটি এনে রাজকন্যার সামনে ফেলে দিল। নাসুহাকে আর তল্লাশি করা হলো না। সেই দিন হতে নাসুহা জঙ্গলে যেয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হলো এবং আল্লাহর অলিতে পরিণত হয়ে গেল। (সূত্র : ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা)
তওবা দুই প্রকার। তওবায়ে আম। তওবায়ে খাস। অর্থাৎ সাধারণ তওবা এবং বিশেষ তওবা।
তওবায়ে আম : পাপ হতে পুণ্যের দিক, কু-কাজ হতে সৎ কাজের দিকে, জাহান্নাম হতে বেহেশতের দিকে অগ্রসর হওয়া এবং শারীরিক শান্তি ও আরামের প্রতি খেয়াল না করে আল্লাহর জিকির-আজকার এবং ইবাদত-বন্দেগিতে কঠোর পরিশ্রম করাকে তওবায়ে আম বলে।
তওবায়ে খাস : পুণ্যবান ব্যক্তির তওবা হাসিল বা কবুল হওয়ার পর আরেফবিল্লাহর দরজার দিকে এবং দৈহিক সুখ-শান্তি হতে রুহানিয়াতের দিকে অগ্রসর হওয়াকে তওবায়ে খাস বলা হয়। তওবায়ে খাস একজন কামেল মোর্শেদ বা অলির নিকট করতে হয়। তওবায়ে খাস সমর্থ্য হলে কামেল মোর্শেদ কিছু আধ্যাত্মিক সাধনা দেয়। যার কারণে সাধক অতি দ্রুত গতিতে লক্ষ্যবস্তুর দিকে অতিক্রম করে।
তওবার তিনটি স্তর আছে।
প্রথমত : যে ব্যক্তি অপরাধ এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করা থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করে, সে হলো তায়েব। এটা তওবার প্রাথমিক স্তর এবং সাধারণ লোকের তওবা।
দ্বিতীয়ত : যে ব্যক্তি ছগিরা গোনাহ এবং অন্যায় চিন্তা ও কল্পনা হতে বিরত থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসেন, তিনি হলেন আনীব।
তৃতীয়ত : যে ব্যক্তি স্বীয় সত্তা ও অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে আল্লাহতে বিলীন হয়ে যান, তিনি হলেন আওওয়াব।
হজরত যুন্নুন মিশরি (রহ.) বলেন,
‘তাওবাতুল আওয়ামি মিনায যুনূবি ওয়া তাওবাতুল খাওয়াসসি মিনাল গাফলাতি।’
অর্থ : সাধারণ লোকের তওবা পাপ করা হতে বিরত থাকা এবং বিশিষ্ট লোকের তওবা অলসতা হতে দূরে থাকা।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তওবা কবুল করেন। এ সম্পর্কে সহিহ বোখারি ও মুসলিম শরীফে হজরত আবু সায়ীদ খুদরি (রঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) এরশাদ করেছেন,
‘আন আলামা আহলিল আরদি ফাদাল্লা আলা রাহিবিন ফাআতাহু ফাকালা ইন্নাহু কাতালা তিসআতাও ওয়া তিসঈনা নাফসান ফাহাল লাহু মিন তাওবাতিন? ফাকালা লা। ফাকাতালাহু ফাকামালাবিহ মিয়াতুন ছুম্মা সাআলা আন আলামা আহলিল আরদি ফাদাল্লা আলা রাজুলিন আলিমিন ফাকালা ইন্নাহু কাতালা মিআতা নাফসিন। ফাহাল লাহু মিন তাওবাতিন? ফাকালা নাআম ওয়া মান ইয়াহুলু বায়নাহু ওয়া বাইনা তাওবাতি? ইনতালিক ইলা আরদি। কাযা ওয়া কাযা ফাইন্না বিহা উনাসান য়াবুদুনাল্লাহা তায়ালা ফা‘বুদিল্লাহা মা‘আহুম। ওয়ালা তারজি ইলা আরদিকা ফাইন্না আরদু সাওইন ফানতালাকা হাত্তা ইযা নাসাফাত তারিকু আত্হাুল মাউতু। ফায়াখতাসামাত ফিহী মালাইকাতুর রাহমাতি ওয়া মালাইকাতুল আযাবি। ফাকালাত মালাইকাতুর রাহমাতি, জাআ তাইবান মুকবিলান বিকালবিহি ইলাল্লাহি তায়ালা। ওয়া কালাত মালাইকাতুল আযাবি, ইন্নাহু লাম য়ামাল খাইরান কাত্তু, ফাআতাহু মালাকুন ফি ছুরাতি দামিয়্যিন ফাজাআলাহু বাইনাহু আয় হাকামান ফাকালা কিসু মা বাইনাল আরদাইনি ফাইলা আয়্যাতিহিমা কানা আদনা ফাহুয়া লাহু, ফাকাসু ফাওয়াজাদুহু আদনিয়াল আরদিল লাতি আরাদা ফাকাবাদাতহু মালাইকাতুর রাহমাতি। -মুত্তাফাকুন আলাইহি।’
বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। পরে সে তওবা করার উদ্দেশ্যে কোনো একজন আল্লাহওয়ালার সন্ধানে বের হলো। পথিমধ্যে সে লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, এ যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম কে? লোকেরা তাকে বললো, অমুক রাহেব। যিনি খৃষ্ট ধর্মযাজক বা ফাদার এ যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম। সে মতে রাহেবের নিকট গমন করে সে আরজ করলো, আমি ৯৯টি খুন করেছি। আমার তওবা কবুল হবে কি? রাহেব জবাব দিলেন, তোমার তওবা কবুল হবে না। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিত হয়ে সে রাহেবকেও হত্যা করে ফেললো। এবার তার হাতে মানব হত্যার সংখ্যা একশত পূর্ণ হলো। কিছু দিন পরে লোকটির মনে আবার অনুশোচনা জাগলো। এবার সে একজন মারেফতধারী আলেমের নিকট গেল এবং তার জীবনের সমস্ত পাপের কথা খুলে বললো। আলেম তাকে সান্তনা দিয়ে বললো, তুমি যদি আল্লাহর দরবারে তওবা করো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিবেন। লোকটি খুশি হয়ে বললো, ঠিক আছে। আমি তওবা করবো। আমাকে কী করতে হবে আপনি বলে দিন।
আলেম বললেন, তুমি পাশের গ্রামে চলে যাও। সেখানে একজন দরবেশ থাকেন। তুমি তার নিকট গিয়ে তওবা করো। লোকটি সেই দরবেশের বাড়ির দিকে রওনা দিল। কিন্তু পথিমধ্যে হজরত আজরাইল (আঃ) তার রুহ কবজ করে নিয়ে গেলেন। এখন তার রুহ বেহেশতে যাবে না দোজখে যাবে, এই নিয়ে দুই দল ফেরেশতা বিবাদ করতে লাগলো। আজরাইল ফেরেশতা বলতে লাগলো, এই ব্যক্তি সারাজীবন পাপ করেছে এবং এক শত মানুষ খুন করেছে, তাই একে দোজখে নেওয়া হবে। পক্ষান্তরে বেহেশতের ফেরেশতারা বলতে লাগলো, এ ব্যক্তি তওবা করার জন্য দরবেশের নিকট যাচ্ছিল। তাই সে বেহেশতি। এভাবে ফেরেশতারা ঝগড়া করতে লাগলো। এক ফেরেশতা এসে বললো, তোমরা রাস্তা মাপো। এ ব্যক্তি যেখানে ইন্তেকাল করেছে, সেখান হতে নিজের বাড়ি দূরে, না দরবেশের বাড়ি দূরে। যদি দরবেশের বাড়ি দূরে হয়, তাহলে সে জাহান্নামি। আর যদি দরবেশের বাড়ি নিকটে হয়, তাহলে সে জান্নাতি। প্রকৃতপক্ষে লোকটি যে স্থানে ইন্তেকাল করেছে, সেখান হতে দরবেশের বাড়ি অনেক দূরে। মহান আল্লাহ অনেক দয়ালু। একদল ফেরেশতাকে হুকুম করলেন, তোমরা লোকটির বাড়ির দিকের রাস্তা লম্বা করে দাও। ফেরেশতারা তাই করলো। এখন রাস্তা মেপে দেখা গেল, লোকটি যেখানে ইন্তেকাল করেছে, সেখান হতে দরবেশের বাড়ি নিকটে বা কাছে। শেষে ফয়সালা হলো, এই লোকটি আল্লাহর পথে বেশি অগ্রসর হয়েছে। তাই তাকে জান্নাতে নেওয়া হোক। (সূত্র : ইসলাহে নফস ও ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা)
হে সম্মানিত পাঠকগণ! আপনারা চিন্তা করে দেখুন, কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস ও ফেকাহ শাস্ত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেল, বোখারি ও মুসলিম শরীফে আবু সায়ীদ খুদরি (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) এরশাদ করেন, বনি ইসরাইলের একজন পাপী ও একশত মানুষের খুনি সে খালেস তওবার নিয়ত করে কামেল মোর্শেদ বা গুরু দরবেশের উদ্দেশে অগ্রসর হয়ে রওনা দেওয়ার পথে ইন্তেকাল করলেন। আল্লাহতায়ালা তাকে তওবার নিয়তে অগ্রসর হওয়ার কারণে ক্ষমা করে দিলেন। (রাওয়াহু বোখারি ও মুসলিম)। এখন আপনারা ভেবে দেখুন যে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কামেল মোর্শেদ বা গুরুর কাছে যেয়ে খালেস তওবা করার দরকার আছে কি না।