নাগাল থেকে দূরে নয় পিঞ্জিরার দুয়ার

সেহাঙ্গল বিপ্লব

বিশ^কবি লিখেছেন, ‘…দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু’। আমরা যতটুকু দেখি কিংবা এক জীবনে দেখতে পাই, এর বাইরে অদেখা আর অচেনার পরিমাণ কী বা কত? সাধারণ মানুষের জ্ঞানে তা ধারণারও বাইরে। বিশ^নন্দিত বিজ্ঞানী স্যার আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জ্ঞান হলো সমুদ্র, আর আমি একটি বালুকণা কুঁড়িয়েছি মাত্র।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থে নিজেকে বিলীন করে ¯্রষ্টার প্রতি কাতর চিত্তে লিখেছেন, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার পরে’। তিনি এত বড় কবি সর্বজন শ্রদ্ধার পাত্র হবার পরেও তাঁর ভিতর থেকে বিনয়কে পালাতে দেননি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আল্লাহর প্রতি নিগুঢ় ভালোবাসা স্থাপন করে মানুষের জন্য এক রকম আক্ষেপ মিসৃত কণ্ঠে লিখেছেন, ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান?’ আবার ‘তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার মুহাম্মদের নাম’। এদের মতো জ্ঞানী-গুণীদের উক্তিতে বোঝা যায় গড-প্রভু-আল্লাহ, যে যেভাবেই স্মরণ করি না কেন, সবার অন্তর বিকশিত করার জন্য এক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। বৈসয়িক জ্ঞান আর ভোগ-বিলাসীতার কারণে প্রায় মানুষেরই চোখে পর্দা পড়ে যায়। তখন অনেক কিছুই না দেখার ভান করে এরিয়ে থাকে। অথচ আমরা সাধারণ মানুষ সঠিক নিয়মে কতইবা ধর্ম-কর্ম করতে পারি? আর কতখানিই বা করি? জানিই বা কী? জানার তো শেষ থাকে না। তবু আমাদের হামভরা ভাবের কমতি নাই! আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার সাধনাকে অবহেলার চোখে দেখে। তাদের পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান গরিমায় দৃষ্টি যেন টগবগ করে। এক দল মানুষ আছেন, তার স্বীকার করেন যে, প্রত্যেক মানুষের জন্যই একজন কামেল গুরুর সান্নিধ্যে বাইয়াত নিতে হবে। কিন্তু তারা নিজেরা কামেল গুরুর কাছে আসেন না! সংসারের যাবতীয় শরিয়তি কাজ ফেলে শুধু ঘুরে ঘুরে নামাজের দাওয়াত দেন আর মসজিদে ঘুমান। যা অন্যকে বলি কিংবা নিষেধ করি, তা নিজে পালন করি না, এই হলো চরিত্র! এ সব লোকের জন্যই সাধারণ ভালো মানুষ অন্তরে আল্লাহর ভয় নিয়ে গোমরাহীর পথে হারিয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহর জ্ঞান ও রহস্যের সন্ধানে গিয়ে যুগে যুগে মানুষ কঠোর সাধনায় সিদ্ধি লাভের মধ্য দিয়ে সফলকাম হয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ মহান আল্লাহর নির্বাচিত হয়ে, মানুষের অন্ধকার কলবের ঘরে আলো জ¦ালাতে আলোর মশাল নিয়ে এসেছেন। তাঁদের কর্ম ও আদর্শের আলোয় পৃথিবীর নানা প্রান্তরে অগনিত মানুষ হাঁটছেন আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)এর সত্য পথে। আমরা চারপাশে তাকালে এর অসংখ্য প্রমাণ দেখতে পাই। যাঁরা স্বর্গীয় আত্মার সঙ্গে শামিল হয়ে
নিজের আত্মাকে বিলীন করে, সর্বাঙ্গিণ পবিত্র চিত্তে আল্লাহর মহা নিয়ামত লাভ করেছেন। তাঁরা বিপথগামীদের জন্য হেদায়েতের দায়িত্ব নিয়ে আসেন এবং আল্লাহর মেহেরবানিতে সমাজ থেকে কেবল ধর্মীয় গোড়ামী আর অপ-সংস্কৃতিই নয়, মানুষের ভিতরের সব রকম কু-প্রভাব মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে আসছেন। আর যারা এ মহা সত্যকে অস্বীকার করে নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে বিপথে চলেছেন, মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য, খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের এই সত্যপথে আহ্বানের অমিয় বাণী ‘সূফীবাদই শান্তির পথ’ প্রত্যেক মানুষের জন্য প্রকৃত সুন্দর জীবনাদর্শের অন্তরায় হিসেবে দান করছেন। বর্তমান বিশে^ ধর্ম-কর্ম, রীতি-নীতি, আচার-আচরণ নিয়ে নানা রকম মত বিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে। হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। ধর্ম-শৃংখলার নামে গায়ের জোরে অন্যায়ভাবে নি:শ^ করে ছাড়ছে, কিন্তু ইসলাম এমন কাজে কখনো সমর্থন করে না। আর যা-ই এ ধরনের কাজ কখনো আল্লাহকে খুশি করানোর জন্য হতে পারে না।

খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলাজানের প্রেমময় মহব্বতের ছায়াতলে যারা আছি, তারা জানি কেবলাজানের ধর্ম-কর্ম রীতি-নীতি ও আদর্শের কথা। কোনদিন কেবলাজানের মধ্যে কোনপ্রকার হিংসা-লোভ-লালসা দেখি নাই। কখনো কারো সম্পর্কে নিন্দা বা পরচর্চা শুনি নাই। সেই বাল্যকাল থেকেই তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছেন মানুষের সেবায়। আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)এর নির্দেশিত পথেরই একজন সুযোগ্য আহ্বায়ক অর্থাৎ, বিশ^ায়নের এ যুগে তিনিই মানুষের ঈমান ও সম্পদ ধ্বংসের পথ থেকে শান্তি ও কল্যাণের পথে আহ্বান করছেন। খাজাবাবা কুতুববাগী কেবলঅজান বলেনÑ ‘সূফীবাদী দর্শনের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ লাভের একমাত্র সহজ ও সুন্দর উপায়।’ খুব অনুতাপ লাগে যখন বিদ্বেসীরা বিরূপ করে বলেন, ইসলাম ধর্মে সূফীবাদ বলে কিছু নাই!’ অথচ সৃষ্টির মূল নূরে মুহাম্মদী (সঃ) নিজেই ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাবাধার সূফীবাদের ধারক ও বাহক। সূফীবাদের এই গুপ্ত তত্বজ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে সিনার মাধ্যমে বিস্তার হয়ে আসছে। আর তাই ইমামপুত্র হযরত জয়নাল আবেদীনের সিনার সঙ্গে হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) নিজের সিনা মোবারক লাগিয়ে সেই গুপ্ত এলম বা জ্ঞান দান করে গেছেন। ইবনে খালদুন রচিত ‘বিখ্যাত ইতিহাস’ গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘প্রাচীনকালীন মুসলমানরা ও তাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে নবীজি (সঃ)এর সাহাবা, তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়িন, আশরায়ে মোবাশি^রিন তথা আহলে বাইয়াতের অর্ন্তভূক্তরা সূফী মতবাদকে সত্য আর কল্যাণকর মুক্তির পথ বলে বিশ^াস করেন। ত্যাগ ও ধৈর্য্য স্বীকার করে নির্জনে আল্লাহর আরাধনায় নিয়োজিত থাকাই হলো এ মতবাদের মূল নীতি। যে নীতি বোধের আদর্শ ও কর্মধারাই ‘সূফীবাদ’ নামে পরিচিত। সাহাবাগণ ও প্রথম যুগের মুসলমানরা এ নীতি সমর্থন করতেন।’

তাহলে এ কথা সহজ জ্ঞানেই বোঝা যায়, এ নীতিরই ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকবে কাল-কিয়ামত পর্যন্ত। কারণ একটি গাছের মূল শিকড়ের পতন হলে যেমন, সে গাছ বাঁচে না, তেমনই ইসলামের মূল শিকড়ের জ্ঞান হলো আধ্যাত্মিকতা অর্থাৎ, মহান আল্লাহ এবং সৃষ্টি তত্বের যা কিছু গোপন এর সবই সূফীবাদের মধ্যে নিহিত। যারা সূফীবাদের এ আত্ম-দর্শনের বিরোধিতা করেন, প্রকৃত অর্থে তারা ইসলাম ধর্মকেই অস্বীকার করছেন। নিশ্চয়ই তাদের নীতি ও নৈতিকতার স্খলন ঘটেছে। অথচ তারা সেটা বুঝতেও পারছেন না! অন্তরে আল্লাহ এবং রাসুল (সঃ)এর প্রেমাঙ্কিত আলো না থাকলে দিনের সূর্যকেও অন্ধকার দেখবে তারা। তাতে সে অক্সর্ফোড লাইব্রেরির সকল জ্ঞান হজম করলেও লাভ হবে না। সূফীবাদের শিক্ষার আলোই চিরসত্য আলো, যে আলোর পথের যাত্রীরা অন্তরে আলো সন্ধান করেন এবং তারা সেই আলোর সন্ধান পেয়ে থাকেন।

ইন্টারনেট এর এই যুগে আমরা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ভালো-মন্দ, আপন-পর ভুলে যাচ্ছি! দেখেও দেখি না! বুঝেও বুঝতে চেষ্টা করি না। কিছুটা বিশ্বাস থাকলেও মনের ভিতর অবিশ্বাসের ঘোড়া এদিক সেদিক ছুঁটতে থাকে, তখন দুর্বল বিশ্বাস পরি মরি করে দূরে যায়। তাই দিলের মুখে স্মরণ করে বলি, বুঝতে হলে খুঁজতে হয়, খুঁজতে গেলে ডুবতে হয়, ডুবলে ডুবে যেতে হবে মন পিঞ্জিরায়, সে পিঞ্জিরার বন্ধ দুয়ার নাগাল থেকে দূরে নয়, যে স্থানে রয়েছেন এক আল্লাহতায়ালা জ্যোর্তিময়। প্রিয়পাঠক সত্যি বলছি, অগনিত আশেকান ও জাকেরান ভাই-বোনদের মাথার তাজ, চোখের মণি, হৃদয়ের ধন, সুপথের দিশারী কামেল মুর্শিদ খাজাবাবা কুতুববাগীর দেখা না পেতাম যদি, এ অতি নগন্য লেখকের জীবন সত্যিই অর্থহীন হয়ে যেতো।

(Visited 304 times, 1 visits today)
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *