আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী
একদা হযরত শায়েখ আহমদ (রহ.) নির্জন কক্ষে উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় রসুলুল্লাহ (সঃ) তশরিফ আনিলেন। সঙ্গে সমস্ত আম্বিয়া (আঃ) অসংখ্য ফেরেশতা ও আউলিয়ায়ে কেরামগণ আসিলেন। রসুলুল্লাহ (সঃ) তাঁহার পবিত্র হাতে হযরত শায়েখ আহমদ (রহ.)-কে একটি অমূল্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পোশাক পরাইয়া দিয়া বলিলেন, শায়েখ আহমদ, মোজাদ্দেদ-এর প্রতীক স্বরূপ এই বিশেষ খিলআত তোমাকে পরাইয়া দেওয়া হইল। এখন হইতে তুমি মোজাদ্দেদ আলফেসানী অর্থাৎ, দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক। আমার উম্মতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ হইতে তোমার উপর অর্পিত হইল’।
সাধারণত: পয়গম্বর (আঃ)গণ চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। হযরত শায়েখ আহমদ (রহ.)-এর বয়স যখন চল্লিশ বছর হইয়াছে, তখন তিনি ‘মোজাদ্দেদে আলফেসানি’ এর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। হযরত গাউসে আজম মহিউদ্দিন আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) পাঁচ’শ বছর পূর্বে মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.)-এর আগমন সংবাদ জানিতে পারিয়া, তাহার খেরকা মোবারক খাস কামালতে পরিপূর্ণ করতেন। নিজ সাহেবজাদা ও খলিফা হযরত তাজুদ্দিন আব্দুর রাজ্জাক (রহ.)-কে প্রদান করিয়া, অসিয়ত করিয়া গিয়াছিলেন যে, মোজাদ্দেদে আলফেসানী শায়েখ আহমদের আবির্ভাব ঘটিলে যেন এই খেরকা তাহার নিকট হাওলা করিয়া দেওয়া হয়। উক্ত খেরকা শরীফ আমানত স্বরূপ ক্রমাগতভাবে তাহার খলিফাগণের মাধ্যমে সর্বশেষ হযরত শাহ্ সেকেন্দার কায়থলী (রহ.)-এর নিকট আসিয়া পৌঁছিল। তিনি ছিলেন বংশের শেষ খলিফা এবং মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)-এর সমসাময়িক, তাহাকে একদিন স্বপ্নে দেখিলেন, তাহার দাদা কাদেরিয়া তরিকার বিখ্যাত বুযুর্গ হযরত শাহ কামাল কায়থলী (রহ.) তাহাকে বলিতেছেন, গাউসে আজম (রহ.)-এর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)-কে খেরকা শরীফখানি হাওলা করিয়া দাও। হযরত শাহ সেকেন্দার (রহ.) ভাবিলেন ঘরের নিয়ামত ঘরেই শোভা পায়। তাই তিনি খেরকা শরীফ প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহ বোধ করিলেন না। কিছুদিন পরে পুনরায় হযরত শাহ কামাল কায়থলী (রহ.) স্বপ্নে তাহাকে খেরকা প্রদানের জন্য তাগিদ দিলেন। কিন্তু তবুও তিনি তাহা দিলেন না। বিলম্ব দেখিয়া হযরত শাহ কামাল কায়থলী (রহ.) পূনবার স্বপ্নে দর্শন দিয়া রাগতঃস্বরে বলিলেন, যদি তুমি পরকালের নিরাপত্তা কামনা কর এবং তরিকার নেসবত অটুট রাখতে চাও, তবে খেরকা শরীফ আজই হযরত শায়েখ আহমদ মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)-এর নিকট পেশ কর। নতুবা নেসবত ও কামালত সবই সলব করিয়া লওয়া হইবে। স্বপ্ন দেখিয়া হযরত শাহ সেকেন্দার (রহ.) ভীত হইয়া পড়িলেন, অতি প্রত্যুষে তিনি খেরকা শরীফ লইয়া হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)-এর বাসগৃহ অভিমুখে রওয়ানা হইলেন। হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) ফজরের নামাজের পর মোরাকাবায় রত ছিলেন। মোরাকাবা হইতে ফারেগ হইবার পর, শাহ্ সাহেব তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করিলেন এবং খেরকা শরীফখানি তাহার হাওলা করিয়া দিলেন। তিনি নির্জন কক্ষে গমন করিয়া খেরকা শরীফখানি পরম শ্রদ্ধাভরে পরিধান করিলেন। তিনি লক্ষ্য করিলেন, তাহাকে কেন্দ্র করিয়া বিষ্ময়কর ঘটনার প্রকাশ ঘটিতে লাগিল। খেরকা শরীফ পরিধান করার সঙ্গে-সঙ্গে কাদেরিয়া তরিকার নেসবত প্রবল হইল। কাদেরিয়া নূর তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। নকশবন্দিয়া নেসবত কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেল। পুনরায় নকশবন্দিয়া নেসবত প্রবল হইল এবং কাদেরিয়া নেসবতকে ঢাকিয়া ফেলিল। পর্যায়ক্রমে কয়েকবার এইরূপ ঘটিল। ইতোমধ্যে হযরত গাইসে আজম (রহ.) তাশরিফ আনিলেন। তাহার সহিত আসিলেন সৈয়্যেদেনা আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী কাররামুল্লাহু ওয়াজহাহু এবং কাদেরিয়া তরিকার অন্যান্য বিশিষ্ট বুযুর্গগণ । কিছুক্ষণ পর আসিলেন গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) ও তাহার সিলসিলার অন্যান্য বুযুর্গবৃন্দ। অতঃপর হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) সৈয়্যেদেনা আমিরুল মোমেনিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদি আল্লাহু আনহুসহ তাহার সিলসিলার সমস্ত বুযুর্গগণ হাজির হইলেন। ক্রমে-ক্রমে কিবরিয়া, আলিয়া, সোহ্রাওয়ার্দিয়া বুযুর্গগণও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এইবার আলোচনা শুরু হইল, প্রথমে উভয় হযরত-এর মধ্যে ইশারা বিনিময় হইল। হযরত গাইসে আজম (রহ.) বলিলেন, হযরত মোজাদ্দেদ (রহ.) শৈশবকালে আমার তরিকার বুযুর্গ হযরত শাহ কামাল কায়থলী (রহ.) এবং জিহবা চুষিয়া তরিকার সমুদয় কামালত হাসিল করিয়াছিলেন। সেই কারণে আমার তরিকার খেদমত করিবার জন্য তাহার উপর আমার দাবী প্রথম। হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) বলিলেন, আমার সিলসিলার খলিফা হযরত বাকী বিল্লাহ (রহ.)-এর মাধ্যমে তিনি রসুলেপাক (সঃ)-এর বিশেষ আমানত পাইয়াছেন, অতঃএব তিনি আমার সিলসিলার খেদমত করিবেন। গরীবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) বলিয়া উঠিলেন, তাহার পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন আমারই সিলসিলাভুক্ত। তিনি আমাদেরই কোলে প্রতিপালিত হইয়াছেন এবং সর্বপ্রথম আমার তরিকার খেলাফত লাভ করেন। তাই সর্বাপেক্ষা আমার দাবী অগ্রগণ্য। কিবরীয়া আলিয়া ও সোহ্রাওয়ার্দিয়া বুযুর্গগণও তাহাদের নিজ নিজ দাবীর স্বপক্ষে দলিল পেশ করলেন। বহুক্ষণ ধরিয়া আলোচনা চলিল, কেহই দাবী ছাড়িতে চান না। এই গুরুত্বপূর্ণ ও মনোহর মাহফিলে অংশগ্রহণ করিবার জন্য, এত অধিক সংখ্যায় অলি-আল্লাহগণের রুহ মোবারক উপস্থিত হইলেন যে, শেরহিন্দ শরীফের শহর ও শহরতলীর কোন জায়গায় খালি রহিল না। অবশেষে এই জটিল বিষয়ের নিষ্পত্তি করিয়া দিবার জন্য, হযরত রসুলেপাক (সঃ) তাশরিফ আনিলেন। অতঃপর বলিলেন, আপনারা আপনাদের নেসবতের কামালতসমূহ সম্পূর্ণরূপে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীকে সোপর্দ করুন। ইনি আপনাদের সকলেরই খলিফা, আপনারা সকলেই তাহার নিকট হইতে সমানভাবে পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।
কিন্তু যেহেতু নবীদের পরে শ্রেষ্ঠমানব হযরত সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) হইতে নবশবন্দিয়া তরিকার উৎপত্তি এবং ইহাতে আজিমাতের সহিত সুন্নতের অনুসরণ ও বেদাত বর্জন করা হয়। তাই তাজদীদের সংস্কারের বিশেষ খেদমত সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই তরিকাটি সর্বাপেক্ষা যোগ্যতাপূর্ণ। সব সমস্যার সমাধান হইয়া গেল। রসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ি প্রত্যেকই নিজ নিজ তরিকার পরিপূর্ণ কামালত হযরত মোজাদ্দেদ (রহ.)-কে প্রদান করিলেন। ইহার সহিত যুক্ত হইল ‘আলফেসানী’ মোজাদ্দেদের খাস কামালত ও নেসবত এবং রসুলেপাক (সঃ) কর্তৃক প্রদত্ত খাস কামালতসমূহ। ইহা ছাড়াও মিশ্রিত হইল ‘কাইয়্যূমিয়াত’, ‘ইমামত’ ও ‘খাজি নাতুর’ রহমত প্রভৃতি বিশেষ কামালত। জন্ম নিল এক সমষ্টিভুত তরিকা। সর্বপ্রকার কামালতের আধার নতুন এই সিলসিলার নাম হইল তরিকায়ে মোজাদ্দেদিয়া।
প্রশ্ন: মোজাদ্দেদিয়া তরিকার আমল করিলে চার তরিকার আমল কীভাবে আদায় হয়?
উত্তর: হযরত গাউসে আজম বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) বলিলেন, হযরত মোজাদ্দেদ (রহ.) শৈশবকালে আমার তরিকার বুর্যুগ হযরত শাহ কামাল কায়থলী (রহ.)-এর জিহ্বা চুষিয়া তরিকার সমুদয় কামালাত হাসিল করিয়াছিলেন। সেই কারণে আমার তরিকার খেদমত করিবার জন্য তাহার উপর আমার দাবী। হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দি বোখারী (রহ.) বলিলেন, আমার সিলসিলার খলিফা হযরত বাকী বিল্লাহ (রহ.)-এর মাধ্যমে তিনি রসুলেপাক (সঃ)-এর বিশেষ আমানত পাইয়াছেন। অতএব, তিনি আমার সিলসিলার খেদমত করিবেন। গরীবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) বলিয়া উঠিলেন, তাহার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন আমারই সিলসিলাভুক্ত। তাই সর্বাপেক্ষা আমার দাবী অগ্রগণ্য। কিবরীয়া আলিয়া ও সোহ্রাওয়ার্দিয়া বুযুর্গগণও তাহাদের নিজ নিজ দাবীর স্বপক্ষে দলিল পেশ করলেন। তাঁহাদের সকলের দাবী নিষ্পত্তি করিয়া দিবার জন্য, হযরত রসুলেপাক (সঃ) তাশরিফ আনিলেন। অতঃপর বলিলেন, আপনারা আপনাদের নেসবতের কামালতসমূহ সম্পূর্ণরূপে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীর কাছে সোপর্দ করুন। আজ হইতে শায়েখ আহমদ শেরহিন্দী মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) আপনাদের সকলেরই খলিফা। আপনারা সকলেই তাহার নিকট হইতে সমানভাবে পারিশ্রমিক লাভ করিবেন। সকলের দাবী সমাধান হইয়া গেল। রসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ি প্রত্যেকেই নিজ নিজ তরিকার পরিপূর্ণ কামালাত হযরত শায়েখ আহমদ শেরহিন্দী মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.)-কে প্রদান করিলেন।
হে সম্মানিত পাঠকগণ! আপনারাই চিন্তা করিয়া দেখুন, উপরোল্লেখিত চার তরিকার ইমামগণের কামালাত রসুল (সঃ)-এর মাধ্যমে, হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীর কাছে সোর্পদ বা ন্যাস্ত করা হইল। এ জন্য মোজাদ্দেদিয়া তরিকা আমল করিলে চার তরিকার আমল হইয়া যায়।